দেশে কি শেয়ার বাজার, সেবি ও কেন্দ্রীয় সরকার ত্রয়ীর ‘মনোপলি বাঁচাও’ সিন্ডিকেট কায়েম হয়েছে? তাদের লক্ষ্য কি—কেবল বাছাই করা কর্পোরেট, নির্দিষ্ট কোম্পানি এবং পছন্দের শেয়ারের জন্য মুনাফা নিশ্চিতকরণ? আর সেই নাফা ঘরে তুলবে কি ওই বিতর্কিত সিন্ডিকেটের সদস্যরাই? হ্যাঁ, একঝাঁক প্রশ্ন উঠে আসছে একসঙ্গে! কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধীও এই সাম্প্রতিক চর্চার সঙ্গে একমত। তাঁর সরাসরি অভিযোগ, ‘এই চক্রের নিয়ন্ত্রক তথা পরিচালক বসে আছেন দিল্লিতে সর্বোচ্চ পদে। তাঁর প্রশ্ন, ঠিক এই কারণেই কি সেবি প্রধানের বিরুদ্ধে মোদি সরকার উচ্চবাচ্য করার সাহস দেখাচ্ছে না?’ মঙ্গলবার কংগ্রেস থেকে বলা হল, ‘শেয়ার দুর্নীতির গুচ্ছ অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ সামনে আসার পরেও সরকার স্পিকটি নট!’ রাহুল গান্ধীর বিস্ফোরক সওয়াল, ‘মাধবী পুরী বুচ কি সরকারকে ব্ল্যাকমেল করছেন? তাঁকে সরিয়ে দেওয়া দূর, তাঁকে জেরা করার সাহসও কেন দেখাতে পারছে না কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা?’ পরিসংখ্যান পেশসহ সরব কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেড়াও, ‘মাধবী মুখ খুললেই ডুববেন নরেন্দ্র মোদি। সেবি প্রধান এটা জানেন বলেই সংসদীয় কমিটির তলবও উপেক্ষা করার হিম্মত দেখাতে পারছেন।’ মল্লিকার্জুন খাড়্গেও সরাসরি আঙুল তুলেছেন প্রধানমন্ত্রীর দিকে, ‘সেবিকে কলুষিত করেছেন মোদি।’ তবে পবন খেড়া আক্রমণ করেছেন আরও সরাসরি, ‘শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রকই সেবি। কিন্তু নিছক প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রক হয়ে থাকতে চাননি মাধবী, বরং শেয়ার বাজারকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করে তিনি রীতিমতো মুনাফার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন। কোন সংস্থার শেয়ারের দর কখন বাড়বে, কখন কমবে, কখন কিনতে হবে, কখন ছাড়তে হবে—সবই এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে!’ পবনের দাবি, ‘মাধবীকে মোদি সরকার কিছুই বলতে পারছে না। তিনি পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটির তলবও উপেক্ষা করার সাহস দেখাতে পারছেন।’
সোজা কথায়, কান টানলেই যেখানে মাথা আসবে, সেখানে কোনও পদক্ষেপই করা হচ্ছে না কেন? জনতার মনে সন্দেহ বাড়ছে—মাথাটা কি ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে না? সেবি প্রধান পরোক্ষে সম্ভবত এই বার্তাই দিচ্ছেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে সামান্যতম ব্যবস্থা নেওয়া হলে তিনি সকলকে নিয়েই ডুববেন, একা ডুবতে চান না। সব মিলিয়ে ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’ বুকনি এই ইস্যুতে গোপন কুলঙ্গিতেই সেঁদিয়েছে বললে ভুল হয় না।
মাধবী পুরী বুচের বিরুদ্ধে ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট’-এর অভিযোগ উঠেছে মাসকয়েক আগেই। উল্লেখ্য, ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট’ হল সেই পরিস্থিতি, যখন একজন পদাধিকারীর পদস্থ কাজকর্ম বা সিদ্ধান্তসমূহ থেকে তাঁর ব্যক্তিগত লাভালাভ অর্জিত হয়। সংশ্লিষ্ট বিতর্কে এটাই প্রতীয়মান হয় যে—সেবি’র তদন্ত এবং বিচারপতি সাপ্রে কমিটির পর্যালোচনা যে বিষয়ের উপর হয়েছে, তাতে মাধবী এবং তাঁর স্বামীর অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত ছিল। মাধবী তাঁর বিনিয়োগের কথা স্বীকার করে এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, ওই সমস্ত তখনই করা হয়েছিল যখন তিনি এবং তাঁর স্বামী ছিলেন ব্যক্তিগত নাগরিক (প্রাইভেট সিটিজেন)। সেবি’তে তাঁর নিয়োগ গ্রহণের পরই তাঁদের বিনিয়োগকৃত অর্থ তাঁরা ভাঙিয়ে (‘রিডিম’) নেন এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলিও তারপর নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে। আড়াই মাস আগে গুরুতর প্রশ্ন তোলেন বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান ও দেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। তাঁর বক্তব্য, মাধবীর পক্ষ থেকে অন্যায় করা হয়েছে কিংবা বাস্তবেই তাঁদের ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট’ ছিল কি না, সমস্যা কিন্তু সেটা নয়। সমস্যা এও নয় যে, সরকার কোনও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে বাঁচাতে মাধবীকে রক্ষা করছে কি না। সমস্যাটি বরং একেবারে সোজাসাপ্টা, মাধবী পুরী বুচ কি তাঁর অতীত যোগাযোগ এবং ক্রিয়াকলাপ (পাস্ট কানেকশনস অ্যান্ড অ্যাকশনস) খোলসা করেছেন? সম্ভাব্য ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট’-এর বিষয়টি কি তিনি—সেবি, সরকার, বিচারপতি সাপ্রে কমিটি এবং সুপ্রিম কোর্টের কাছে পরিষ্কার করে জানিয়েছেন? দৃশ্যত না। এমনকী, তদন্ত প্রক্রিয়া থেকেও নিজেকে সরিয়ে নেননি মাধবী। অন্তত এই একটি গুরুতর এবং জবাবদিহিতার উপযোগী ভুল মাধবী করেছেন। ব্যাপারটা তাঁর তরফে একবার প্রকাশ করে দেওয়া উচিত ছিল। আরও উচিত ছিল, সংশ্লিষ্ট মামলাটি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা। তাঁর অংশগ্রহণ তদন্তকে কলঙ্কিত করেছে। তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে, এবং এই অভিযোগের তদন্ত করতে হবে নতুনভাবে। কিন্তু এই দীর্ঘদিনেও মাধবী পদত্যাগ করেননি, এমনকী তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের সাহসও দেখাতে পারছে না মোদি সরকারের তদন্তকারী সংস্থা! আর জি কর কাণ্ডে প্রতিবাদীদের ভাষা ধার করেই তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, ‘মোদি সরকার তোমার কীসের ভয়? মাধবী পুরী বুচ তোমার কে হয়?’