প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
চীন অপেক্ষা করছে। দেশটি ধৈর্যশীল। চীন এই অহংকার করে না যে তারা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, কিংবা বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য দেশটি দিনক্ষণও নির্ধারণ করে না। একটি উদীয়মান শক্তিকেন্দ্রের জন্য এটি অবশ্যই বিরল গুণ। অন্যদিকে, চীন কোনও গণতন্ত্র নয় এবং গণতান্ত্রিক পরিসরে সুলভ স্বাধীনতা ওই দেশের মানুষজন ভোগ করার সুযোগ পান না। উল্টো দিকে, মোটামুটিভাবে ভারত একটি গণতন্ত্র। তবে বড্ড বেশি হট্টগোল চলে এবং ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। ভারতের আর একটি সমস্যা হল, এখানে ভীষণ আগাম উদযাপন হয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে প্যারিস অলিম্পিক ২০২৪-এর পদক তালিকার দিকে চোখ রাখা যেতে পারে:
পদকের এই বহর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের তুলনায় ভারতেই বেশি খুশির জোয়ার দেখেছি বইকি!
বৈপরীত্যপূর্ণ ঘোষণা
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বরাবর ‘টহল ব্যবস্থা’ নিয়ে দিনকয়েক আগে দু’দেশের মধ্যে চুক্তি সংক্রান্ত ঘোষণা নিয়ে অবশ্য বৈপরীত্য ধরা পড়ল। ২০২০ সালের মে মাসে দু’দেশ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। তারপর এটিই প্রথম অগ্রগতি। ভারতের তরফে বিদেশসচিব একটি সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর বক্তব্য জানান। অন্যদিকে একটি সাক্ষাৎকার দেন বিদেশমন্ত্রী। এছাড়া ভারতের সেনাপ্রধান একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন। বিদেশমন্ত্রী বলেন, ‘২০২০ সালের অবস্থায় ফিরে এসেছি আমরা।’ তবে, সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘আমরা ২০২০ সালের এপ্রিলের স্থিতাবস্থায় (স্টেটাস কো অফ এপ্রিল ২০২০) ফিরে যেতে চাই। তারপরে, আমরা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে সেনা প্রত্যাহার, উত্তেজনা প্রশমন এবং স্বাভাবিকতা ফেরাবার দিকে নজর দেব।’
অন্যদিকে, চীনের তরফে তাদের বিদেশ মন্ত্রকের এক মুখপাত্র একেবারে বাস্তব পরিস্থিতির উপর একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সীমান্ত সমস্যাগুলি নিয়ে চীন ও ভারত তাদের কূটনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে রয়েছে। প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলিতে বর্তমানে উভয় পক্ষই একটি সমাধানে পৌঁছেছে এবং চীন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই মূল্যায়ন করেছে তার। চীন, পরবর্তী ধাপে, উপরের সমাধান বাস্তবায়নের জন্য ভারতের সঙ্গে কাজ করবে।’ (টাইমস অফ ইন্ডিয়া) চৈনিক মুখপাত্র অবশ্য এই ব্যাপারে বিস্তারিত কোনও তথ্য প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন।
আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে
অবস্থানটা গত রবিবার পর্যন্ত যেখান ছিল, স্মরণ করলে কাজে লাগবে। চীনের লাল ফৌজ (পিএলএ) ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ এলএসি অতিক্রম করে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢোকে। চীনা সৈন্যদের এই অনুপ্রবেশের ব্যাপারটা ভারত প্রথম টের পায় ২০২০ সালের ৫ মে। অনুপ্রবেশকারীদের সরাতে গিয়ে দু’পক্ষের লড়াইতে ভারত তার ২০ জন বীর সেনাকে হারায়। ওই ঘটনায় তাদের তরফে হতাহতের সংখ্যা চেপে যাওয়া হলেও চীনকেও কিছু সংখ্যক সেনা জওয়ানকে হারাতে হয়েছিল। এই বিষয়ে সে-বছর ১৯ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি সর্বদল বৈঠক ডাকেন। বক্তব্য শেষ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়, ‘বাইরের কেউই ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেনি এবং ভারতের অভ্যন্তরে কোনও বহিরাগত নেইও।’ কিন্তু অনেক সামরিক কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞের মতে, আমাদের প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গার উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ আর নেই, অথচ ওইসব অঞ্চলে আমাদের সৈন্যরাই আগে টহল দিতে পারত!
নির্মম বাস্তব এটাই যে, পুরো গলওয়ান উপত্যকার উপর চীন তার দখলদারি চায়। তাদের দাবি হল, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা গিয়েছে ফিঙ্গার ৪ বরাবর, ফিঙ্গার ৮ ধরে নয়। হট স্প্রিংয়ের দাবি থেকেও চীন বিন্দুমাত্র সরেনি। ভারত কেবলমাত্র ডেমচোক এবং ডেপসাং নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু চীন সেটাও প্রত্যাখ্যান করেছিল। আকসাই চীনে এবং ভারতের সঙ্গে তাদের যে ৩,৪৮৮ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, তার পুরোটা জুড়েই সামরিক পরিকাঠামো নির্মাণ করছে চীন। অন্যদিকে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা পর্যন্ত ভারত বসিয়েছে ৫-জি নেটওয়ার্ক। প্যাংগং হ্রদের উপর একটি সেতুও নির্মাণ করা হয়েছে। সীমান্তে কিছু সামরিক সরঞ্জাম এবং কয়েক হাজার সৈন্যও মোতায়েন রেখেছে ভারত।
আমাদের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে ঘোষিত সরকারি অবস্থান হল, পূর্বের স্থিতাবস্থা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। সরকার ধারাবাহিকভাবে ‘সেনা প্রত্যাহার’ (ডিসএনগেজমেন্ট), ‘উত্তেজনা প্রশমন’
(ডি-এস্কালেশন) ‘সেনা সরানো’ (ডি-ইনডাকশন) এবং ‘প্রত্যাহার’ (উইদড্রয়াল)-এর মতো শব্দগুলি ব্যবহার করেছে। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে, বিদেশমন্ত্রক ‘পূর্বের স্থিতাবস্থায়’ (স্টেটাস কো অ্যান্টি) শব্দটি ব্যবহার করেনি। সরকার
প্রশংসনীয় ধৈর্য ও অধ্যবসায় দেখিয়েছে। যদি
সত্যিই একটি চুক্তি হয়—তখন ‘গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি’ হয়েছে টুকুই বলতে পছন্দ করে চীন। চীনের মতিগতি বোঝাই দায়—এই প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে টহল দেওয়ার ব্যাপারটি হবে সরকারের জন্য
একটি পুরস্কার।
শেষ কিংবা শুরু নয়
মনে হচ্ছে দুই দেশ টহল দেওয়ার ব্যাপারেই একমত হয়েছে, তার বেশি কিছু নয়।
দেখা যাচ্ছে যে, দু’পক্ষের মধ্যে একটি সমন্বয়ের ভিত্তিতে মাসে দু’বার করে সেনা টহল চলবে। তবে সৈন্যের সংখ্যা সীমিত থাকবে পনেরোতে। এই ব্যবস্থাগুলির মধ্যে সমতলের ডেমচোক এবং ডেপসাং অন্তর্ভুক্ত কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়। ২০১৭ সালে একটি চুক্তি হওয়ার পরেও পূর্ব লাদাখের ডেমচোক এলাকাটি চীন পুনরায় দখল করেছে এবং সেখানে তাদের উপস্থিতি জোরদার করেছে। অন্যদিকে সমতলের ডেপসাংয়ে ওয়াই-জংশনের বাইরের দিক থেকে এবং ১০, ১১, ১১এ, ১২, ১৩ প্রভৃতি ট্র্যাডিশনাল পেট্রলিং পয়েন্টে ভারতীয় সৈন্যদের প্রবেশ চীন রুখে দিয়েছে। আমাদের হশাতার আরও দিকগুলি হল—গলওয়ান, প্যাংগং হ্রদের উত্তর ও দক্ষিণ তীর এবং হট স্প্রিং। এই সমস্ত সমস্যার সমাধান করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়াটা নিছকই একটি বিশ্বাস। অবিশ্বাসের চোরাস্রোত এখনও বহমান।
ভারত-চীন সংঘর্ষ নিয়ে গত চারবছরে সংসদে একবারের জন্যও আলোচনা করতে দেওয়া হয়নি। এটাই আমাদের গণতন্ত্রের একটি দুঃখজনক দিক। চীনের সঙ্গে পেট্রলিং ডিল বা টহল চুক্তির বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনেরই পরামর্শ দিয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। এই বিষয়ে কংগ্রেস প্রাসঙ্গিক এবং স্পষ্ট প্রশ্ন উত্থাপন করলেও অন্য বিরোধী দলগুলি কিন্তু চুপ! অক্টোবরের ঐকমত্য কি বিশদ আলোচনার মাধ্যমে ভারত ও চীনকে একটি যথার্থ সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে? এই ব্যাপারে যা’ই বলবেন তা বড়ই আগাম বলা হয়ে যাবে।