প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
একইসঙ্গে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার জানিয়ে দিয়েছে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের ইতিহাসে ‘কলঙ্ক’ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আন্তোনিও গুতেইরেস। কারণ, সম্প্রতি প্যালেস্তাইনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজরায়েলের প্রায় ছয় দশকের দখলদারির অবসান চেয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রায় সব দেশ সেই প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন জানায়। ফলে ইজরায়েলও তার বদলা নেওয়া শুরু করেছে। দক্ষিণ লেবাননে রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিবাহিনীর উপর শুরু হয়েছে ইজরায়েলের বোমা বর্ষণ। একইসঙ্গে প্যালেস্তাইনের গাজা উপত্যকার উত্তরে জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে শুরু হয়েছে ইজরায়েলের নতুন আক্রমণ। এই একের পর এক হামলাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, রাষ্ট্রসঙ্ঘকে তারা পাত্তাই দেয় না!
নেতানিয়াহু এক আবেগপ্রবণ ও ক্যারিশম্যাটিক বক্তা। নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘকেই ‘অন্ধকারের ঘর’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। বলেছিলেন, এই ইহুদিবিদ্বেষী পিত্তে ভরা জলাভূমিতে অধিকাংশই ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতি অমানবিক। গত দশকে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে অনেক প্রস্তাব পাস হয়েছে। সবই ভণ্ডামি, দ্বিমুখী নীতি ও রসিকতা। নেতানিয়াহু প্রশ্ন তুলেছিলেন, আপনারা কাকে বেছে নেবেন? ইজরায়েল?
গণতন্ত্র ও শান্তির পাশে দাঁড়াবেন নাকি ইরানের সঙ্গে? নেতানিয়াহুর বক্তব্যের প্রতিবাদে অনেক বিশ্বনেতা সেদিন সাধারণ অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেছিলেন। কিন্তু তাতে ইজরায়েলের কিছু যায় আসেনি!
রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদকে বলা হয় বিশ্বের আইন পরিষদ। বিশ্বের সব দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে এখানে প্রায় সব আন্তর্জাতিক প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। আর এই সংস্থার বার্ষিক সাধারণ অধিবেশনকে এখন অনেকেই ব্যঙ্গ করে বলেন ‘টকিং শপ’। অধিবেশনের প্রথম এক-দুই দিন সবাই কান পেতে থাকেন। কারণ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা চীনা রাষ্ট্রপ্রধান সেই সময় ভাষণ দেন। সবাই তাঁদের কথা শুনতে, নিদেনপক্ষে সাংবাদিক হিসেবে ‘কভার’ করতে আগ্রহী। দিন যত যায়, আগ্রহ তত কমে। শেষের দিকে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে এমন রাজকীয় যে সাধারণ পরিষদকক্ষ, তাতে কথা শোনার লোক থাকে হাতে গোনা কয়েকজন। তা-ও অধিকাংশই যার যার নিজের দেশের নেতার ভাষণ শোনার জন্য। যেই সেই নেতার ভাষণ শেষ, তাঁর সমর্থকরাও এক এক করে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। নামেই বিশ্বসভা, আসলে রাষ্ট্রপ্রধানরা সবাই যাঁর যাঁর নিজের দেশের, নিজেদের সাফল্যের গান শুনিয়ে যান। বাকিরা কেন শুনবে সেসব কথা? আসলে এটাই রাষ্ট্রসঙ্ঘের বার্ষিক সাধারণ অধিবেশনের প্রকৃত চিত্র। এখানে কোনও দেশের সমস্যা সমাধানে কেউ চিন্তিত নন।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের বার্ষিক সাধারণ বিতর্ক ব্যাপারটা কতটা খেলো হয়ে উঠেছে, তার এক উদাহরণ দিয়েছিলেন ইয়ান উইলিয়ামস। যিনি একসময় রাষ্ট্রসঙ্ঘে সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেছিলেন, বেশ কয়েক বছর আগে, এক বক্তা তাঁর প্রতিবেশী দেশের উদাহরণ দিয়ে বললেন, পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের জাঁতাকলে দেশটির মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মরছে। সে কথা শুনে সবাই তো অবাক। কারণ, যে দেশটির কথা বলা হচ্ছে সেটি এক বছর আগেই স্বাধীনতা অর্জন করেছে। পরে জানা গেল, বক্তা এক বছর আগে দেওয়া ভাষণের কপি ভুল করে আবার পড়ে শোনাচ্ছেন। সম্ভবত তিনি নিজেই সেই ভাষণ দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও কারণে ভুলে গিয়েছিলেন।
অথচ, ১৯৪৫ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন আশা করা হয়েছিল এই বিশ্ব সংস্থাটি দুনিয়া থেকে যুদ্ধ, অনুন্নয়ন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঠেকাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যে দেশগুলি জার্মানি ও তার মিত্রদের পরাস্ত করে তারাই এই সংস্থা গঠনের আসল চালিকা শক্তি। রাষ্ট্রসঙ্ঘকে নিয়ে আশা ও উৎসাহের সেটাই আসল কারণ। কিন্তু খুব বেশি দিন লাগেনি দেশগুলির বন্ধুত্বে চিড় ধরতে। শুরু হয়ে গিয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই। যারা যুদ্ধ ঠেকাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, দেখা গেল তারাই যুদ্ধ বাধাতে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। বিশ্বকে এক করার বদলে তাকে বিভক্ত করে যার যার প্রভাব বলয়ে আনাই তাদের আসল লক্ষ্য। এরপর ৭৯টি বছর কেটে গিয়েছে। অবস্থা বদলায়নি, বরং বহুগুণে অবনতি ঘটেছে। একটা বিষয় লক্ষ্য করুন, পাঁচটি দেশকে তাদের সার্বিক গুরুত্বের কারণে এই সংস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে ‘ভেটো’ প্রদানের অধিকার দেওয়া হয়েছে। দেখা যায়, বহু অধিবেশনে সেই পাঁচ দেশের অনেকেই অনুপস্থিত থাকেন। গত বছর, ২০২৩ সালের কথাই ভাবুন। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পাঁচজনের একজন অনুপস্থিত ছিলেন। কারণ, তখন তিনি প্রতিবেশী এক দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় ব্যস্ত। আরও এক প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতির কারণ, এক রাজা তাঁর দেশে সফরে আসবেন, তাঁর দেখভাল করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। এমনকী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি—যিনি মাত্র সপ্তাহখানেক আগেই নিজের দেশে সাড়ম্বরে জি ২০–এর শীর্ষ বৈঠকে পৌরোহিত্য করেছিলেন— তিনিও অধিবেশনে থাকতে পারেননি। দুই দিনের বৈঠক করে তিনি হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন! বিশ্বনেতাদের জন্য কোনটা অগ্রাধিকার, এ থেকেই বোঝা যায়।
রাষ্ট্রসঙ্ঘ যে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে, সে কথা স্বয়ং মহাসচিব আন্তোনিও গুতেইরেস স্বীকার করেছেন। শান্তিরক্ষার বাইরে এই মুহূর্তে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ জলবায়ু–সংকটের মোকাবিলা। আর মাত্র ১০ বছরের মধ্যে যদি ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা কমিয়ে আনা সম্ভব না হয়, তাহলে বিশ্ব ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়বে। এ জন্য একদিকে প্রয়োজন জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, যেমন সূর্য বা বাতাসের ব্যবহার বাড়ানো। অথচ যাঁরা এই বিশ্বের হর্তাকর্তা, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি গ্যাস-তেলের কারবারি। ৭৭তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এক ভাষণে গুতেইরেস বলেছিলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বদলে আমরা বিশ্বকে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলছি। লক্ষ্য অর্জনের বদলে আমরা একে–অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এভাবে জড়িয়ে গিয়েছি যে সংস্থাটি তার চালিকাশক্তি হারিয়ে ফেলছে।’ মহাসচিব তাঁর স্বভাবজাত কূটনৈতিক ভাষা ত্যাগ করে সেই ভাষণে স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘আমাদের বিভক্তি বাড়ছে, অসাম্য বাড়ছে, লক্ষ্যপূরণ দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। বড় বিপদে পড়ে গিয়েছি আমরা।’
কোনও সন্দেহ নেই, এই বিপদের কারণ বিশ্বের বড় রাষ্ট্রগুলি নিজেরাই তৈরি করেছে। ২০২২ সালে প্রতিবেশী ইউক্রেন আক্রমণের মাধ্যমে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অন্যতম স্থপতি রাশিয়া নিজেরাই সংস্থাটির প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ সনদের একটি প্রধান প্রতিশ্রুতিই— কোনও দেশ, তা সে ছোট বা বড় যা–ই হোক, কোনও অবস্থাতেই অন্য কোনও দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন হয়, এমন কাজ করবে না। রাশিয়া ঠিক সেই কাজটি করেছে। রাশিয়া রাষ্ট্রসঙ্ঘে প্রতিশ্রুত পথে এগয়নি। শুধু তা–ই নয়, অসামরিক জনগণের উপর যে নির্বিচার বোমাবাজি রাশিয়া করে চলেছে, তাকে বলা হচ্ছে ‘জেনোসাইড’। স্বয়ং রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন যুদ্ধাপরাধের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘভুক্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। শুধু রাশিয়া নয়, রাষ্ট্রসঙ্ঘভুক্ত অধিকাংশ বৃহৎ রাষ্ট্র বেশিরভাগ দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সমস্যার মোকাবিলায় রাষ্ট্রসঙ্ঘের দ্বারস্থ না হয়ে নিজের পছন্দমতো রাস্তা খুঁজে নিচ্ছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ যে এখন নখদন্তহীন একটি পোষ্য মাত্র, তার এক বড় কারণ, এই সংস্থাটিকে এড়িয়ে বিশ্বের দেশগুলি যে যার মতো ছোট ছোট জোট গঠন করে নিয়েছে। বিশ্বের তিন মোড়ল আমেরিকা, চীন ও রাশিয়া— তাদের নেতৃত্বে নানা জোট গড়ে তুলেছে। যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘ গঠিত হয়েছিল, অর্থাৎ সব রকমের আন্তর্জাতিক প্রশ্নে সমন্বিত কাজ— তা অনুসরণের বদলে এখন বড় বড় দেশ যে যার মতো নিজেদের প্রভাবাধীন জোট গড়ে সেখানেই বিচারসভা বসাচ্ছে। জি ৭, জি ২০ বা ব্রিকস— এসবই এক অর্থে ছোট ছোট রাষ্ট্রসঙ্ঘ।
রাষ্ট্রসঙ্ঘ যে ক্রমেই তার প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে, তার এক বড় কারণ এই সংস্থা বিশ্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে বদলাতে ব্যর্থ হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের দিকে তাকান। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই পরিষদের ভূমিকা সবচেয়ে বড়। যে পাঁচটি দেশ সেই ১৯৪৫ থেকে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো অধিকার নিয়ে বসে আছে, তার তিনটিই ইউরোপের। ফ্রান্স বা ব্রিটেন একসময় বিশ্বশক্তি ছিল, এখন তারা নিজেদের অতীতের ছায়ামাত্র। তাহলে কী হবে? বাস্তবতা মেনে সরে দাঁড়াতে বললে তারা কখনই রাজি হবে না। আফ্রিকা মহাদেশ বা আরব দেশগুলি থেকে এই পরিষদে কোনও স্থায়ী সদস্য নেই। তৃতীয় বিশ্ব থেকে চীন আছে বটে, কিন্তু জনসংখ্যার দিক দিয়ে বৃহত্তম ভারত তেমন সুযোগ থেকে বঞ্চিত। লাতিন আমেরিকার কোনও দেশেরও সেখানে পা রাখার স্থায়ী কোনও জায়গা নেই। গত সাত দশকে বিশ্ব বদলেছে, কিন্তু বিশ্ব সংস্থা বদলায়নি। সবাই এ কথা মানেন, রাষ্ট্রসঙ্ঘকে ঢেলে সাজাতে হবে, কিন্তু ঢেলে সাজাতে হলে সবার আগে প্রয়োজন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের সম্মতি। সেই সম্মতিও আসবে না, অচলাবস্থারও নিরসন হবে না।
এরপরও রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে যদি কারও মনে কোনও দ্বিধা থাকে, দয়া করে গাজা, লেবাননের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হওয়া অনাথ শিশুদের অথবা এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত মার্কিন ছাত্রছাত্রীকে প্রশ্ন করুন। সঠিক উত্তর তাঁরাই দিতে পারবেন। আসলে ৭৯ বছর ধরে গোটা দুনিয়া জেনে গিয়েছে, রাষ্ট্রসঙ্ঘ এখন ‘লাইফ সাপোর্টে’!