প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
জনগণনা। সেন্সাস। আদমশুমারি। যে নামেই ডাকুন না কেন, এর অর্থটা কী? ভারত কবে চীনকে জনসংখ্যার নিরিখে পেরিয়ে যাবে, তার উত্তর মেলে এতে? তেমনটা কিন্তু নয়। এ এমন এক প্রক্রিয়া,
যার উপর দাঁড়িয়ে থাকে দেশের এবং সমাজের বর্তমান। এমনকী ভবিষ্যৎও। সেন্সাসের তথ্যের উপর নির্ভর করেই সরকার তৈরি করে সামাজিক সুরক্ষার ব্লু-প্রিন্ট। এখন যেমন ২০১১ সালের হিসেবের ভিত্তিতেই দেশ চলছে। তখন ভারতের জনসংখ্যা কত ছিল? ১২০ কোটি। তারপর মধ্যবর্তী সমীক্ষা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে? পরিপূর্ণ সেন্সাস যা তথ্য সরকারকে দেবে, তা কোনও ইন্টারিম সার্ভে দিতে পারে না। আর তাই ২০২১ সালে নির্ধারিত জনগণনার কাজ না হওয়ার বিস্তর
প্রভাব কিন্তু পড়ছে আম জনতার মধ্যে। পুরো আফটার শকটাই অনুভূত হচ্ছে সমাজের মাইক্রো লেভেলে। তাহলে কেন হচ্ছে না সেন্সাস? ২০২০ সালে না হয় কোভিড-হানা ছিল। আপামর দেশবাসীর হাতে ভ্যাকসিনের ছুঁচ ফোটাতেই সময় কাবার হয়ে গিয়েছিল কেন্দ্রের। একুশেও না হয় যথারীতি করোনা এফেক্ট ছিল। তাই সেন্সাসের সময় পাওয়া যায়নি। কিন্তু তারপর? একের পর এক বিধানসভা নির্বাচন
ও লোকসভা ভোট হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে গিয়েছেন, রামমন্দিরের উদ্বোধন হয়েছে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কার্যকর হয়েছে, শিল্পপতিরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের রাজকীয়ভাবে বিয়েও দিয়েছেন।
বাকি থেকে গিয়েছে শুধু সেন্সাস। কেন?
কারণ রাজনৈতিক হতেই পারে। এবং তা একটি নয়, একাধিক। যেমন, ১) দিল্লির দরবার থেকে যা খবর মিলছে, জনগণনার রিপোর্ট সামনে এলে সবার আগে নজর পড়বে মুসলিম জনসংখ্যায়। দেশ ১৪০ কোটি নাগরিকের মাইলস্টোন পার করলেও হিন্দু জনসংখ্যার তুলনায় মুসলিমদের অনুপাত কিন্তু কমবে। সেক্ষেত্রে সরাসরি ধাক্কা খাবে বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি। হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে—এমন একটা প্রচার আর ধোপে টিকবে না। তৃণমূল কংগ্রেসের মতো সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলির শাসকদের বিরুদ্ধে লাগাতার নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ তোপ দেগে থাকেন, তারা নাকি ভোটের স্বার্থে অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় দেয়। সেই রাজনৈতিক প্রচারও হালে পানি পাবে না। ২) এবার আদমশুমারিতে জাতিগণনার দাবি প্রতিদিন প্রবল হয়ে উঠছে। কংগ্রেস, আরজেডি এমনকী শরিক জেডিইউয়ের মতো দলও এই একটি দাবি নিয়েই কোমর বেঁধে নেমেছে। যুক্তিটা পরিষ্কার, ১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম জনগণনার সময় তফসিলি জাতি ও উপজাতির কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। কারণ, তারা পিছড়ে বর্গ। বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এই শ্রেণির মানুষকে সামনের সারিতে নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করেছিল নেহরু সরকার। এখন সেই একই ফর্মুলা ওবিসি বা অন্যান্য অনগ্রসর জাতির জন্য প্রযোজ্য হবে না কেন? ঠিক কতজন ভারতীয় নাগরিক ওবিসি ক্যাটিগরিতে পড়ছেন, সেন্সাস না হওয়া পর্যন্ত সেটা জানাটা অসম্ভব। সেই অঙ্ক সামনে চলে এলে তাঁদের জন্য বাড়তি সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে বিজেপির এলিট হিন্দু ক্লাসের রাজনীতি। ৩) খাও এবং খানে দো... তলে তলে গেরুয়া বাহিনীর এই আপ্তবাক্য এখন চর্চার কেন্দ্রে চলে এসেছে। নরেন্দ্র মোদি মুখে যতই বলুন, তাঁর সরকার দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স, ক্যাগ রিপোর্টেও কিন্তু উল্টো সুর শোনা যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া তকমা গায়ে সেঁটে ডাবল ইঞ্জিন রাজ্যগুলিতে যত মানুষ সুবিধা ভোগ করে আসছে, তাদের পায়ের তলার মাটি সরবে। সেইসঙ্গে ‘সোর্স’ কাটছাঁট হয়ে যাবে নেতাদেরও। হিসেব বলছে, দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষ সরাসরি বাদ হয়ে যাবে ‘ফ্রি রেশন প্রাপ্তির’ তালিকা থেকে। সবচেয়ে বেশি ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হবে ডাবল ইঞ্জিন উত্তরপ্রদেশ। সে আবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ক্ষেত্রও বটে। আর শুধু রেশন নয়, সব সামাজিক প্রকল্পেই এর প্রভাব পড়বে। তাই যতদিন ২০১১ সালের হিসেবে প্রকল্প বা উন্নয়নের ঝান্ডা তুলে রাখা যায়, ততই ভালো। ৪) ডিলিমিটেশন বা আসন পুনর্বিন্যাস আর একটা বড় কারণ। এই আর একটি ক্ষেত্র, যেখানে ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে সমস্যা বাড়তে পারে বিজেপির। প্রশ্ন হল, কেন? ২০০১ সালে সংশোধনী এনে ২৫ বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছিল আসন পুনর্বিন্যাস। অর্থাৎ, কোন রাজ্যে কতগুলি লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা বা পঞ্চায়েত আসন থাকবে, তার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০০১ সালে। তখন ভারতের জনসংখ্যা ছিল ১০২ কোটির সামান্য বেশি। ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ৪০ কোটি বেড়েছে মানে সেই অনুপাতে ভোটারও বেড়েছে। লক্ষ করার মতো বিষয় হল, জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার কিন্তু বেশিরভাগটাই উত্তর ভারতে। অর্থাৎ, গেরুয়া শিবিরের গড় বলে পরিচিত এমন রাজ্যগুলিতে। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে, স্বাক্ষরতার হার বেড়েছে, মাথা পিছু আয়ও আগের থেকে অনেক বেশি। সোজা কথায়, আর্থ-সামাজিক দিক থেকে উন্নতি করেছে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি। বিজেপির উৎফুল্ল হওয়ারই কথা। কারণ, ডিলিমিটেশন হলে দক্ষিণে আসন সংখ্যা কমবে, উত্তরে বাড়বে। গত লোকসভা ভোট পর্যন্তও অঙ্কটা এমন ছিল। তৃতীয় ইনিংস শুরু করার পর নরেন্দ্র মোদি আবিষ্কার করেছেন, সমীকরণটা এখন আর অতটা সহজ নয়। উত্তরে রীতিমতো ভাগ বসিয়েছে বিরোধীরা। বাকি থাকল পূর্ব এবং পশ্চিম। বহু চেষ্টার পরও বাংলা বা পাঞ্জাবের মতো রাজ্যের গেরুয়াকরণ করা যাচ্ছে না। অথচ আসন পুনর্বিন্যাস হলে পশ্চিমবঙ্গের আসন বাড়বে। সেটা আরও মাথাব্যথার বিষয়। উপায় একটাই, রাজ্য ভাগ। একমাত্র উত্তরবঙ্গ এবং বিহারের কিছু অংশ জুড়ে (সীমাঞ্চল) আলাদা রাজ্য তৈরি করতে পারলে এই ট্রেন্ড বিগড়ে দেওয়া সম্ভব। সেটাও হয়ে উঠছে না। কারণ, বাংলার মানুষই সেটা চায় না। রাজ্য ভাগ হলে বিজেপির ভোটই উল্টে কমে যাবে। তাই আগে রাজনৈতিক জমি শক্ত করে সেন্সাসে যাওয়া ভালো। মোদিজি হয়তো ভাবছেন, এক দেশ এক ভোট কার্যকর করে ফেলতে পারলে ওই ভিতের উপর ভালোভাবে সিমেন্ট মারা হয়ে যাবে। সত্যিই কি তাই? এটারও কিন্তু পরীক্ষা প্রার্থনীয়। তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত—চলতি বছরও ওসব জনসংখ্যা গোনাগুনতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাহলে মোদি সরকারের হাতে টালবাহানার জন্য কতদিন থাকল? মাত্র একটা বছর—২০২৫। কারণ, জনগণনা পিছনো গেলেও ডিলিমিটেশন নিয়ে এপাশ ওপাশ করা চলবে না। ২০২৫ সালে জনগণনা শুরু হলে রিপোর্ট পেতে পেতে ’২৬। ওই বছরই ডিলিমিটেশনের কাজ শুরু হবে। সেটা শেষ হতে আরও তিন বছর। অর্থাৎ ২০২৮। অর্থাৎ, এই ফর্মুলা বাস্তবায়িত হলে পরের লোকসভা ভোট নতুন আসন বিন্যাসেই যাবেন মোদিজি।
১৮৮১ সালে লর্ড মেয়োর হাত ধরে সেন্সাস শুরুর পর ১৪০ বছর কেটে গিয়েছে। এই প্রথম অতি প্রয়োজনীয় এই কর্মকাণ্ড হয়নি সঠিক সময়ে। হচ্ছেও না। এতে রাজনৈতিক দলগুলির হয়তো খুব বেশি কিছু আসে যায় না। কিন্তু ঘুম উড়ে যায় আমলা মহলের, নীতি নির্ধারকদের। কারণ, ওই ডেটার উপর নির্ভর করেই তাঁরা প্রশাসন চালান, নীতি ঠিক করেন। জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয় নতুন আইন। বদলেও যায়। প্রশাসন বুঝতে পারে, কোন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প বন্ধ করার সময় এসেছে বা কোন ধরনের প্রকল্প নতুন করে শুরু করতে হবে। ব্যবসায়ীরা বুঝে নেন বাজার। সাধারণ মানুষের উপার্জন বাড়ল কি না, তারা কোন ক্যাটিগরিতে পড়ল, সেই মতো উৎপাদন বাড়ানো হবে কি না... এই সবই নির্ভর করে সেন্সাসের রিপোর্টের উপর। রোজকার জীবন যাপনে আপনি-আমি হয়তো এর প্রয়োজনীয়তা খুব একটা টের পাই না। আমরা শুধু মূল্যবৃদ্ধির আঁচে সেদ্ধ হই। আর সেন্সাসে ঢিলেমির সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে সেঁধিয়ে যায় সমাজের মাইক্রো লেভেল। নিম্ন মধ্যবিত্ত। গরিব মানুষ। তারপরও আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল সেন্সাসের স্বপ্ন দেখেন। সেখানে একটি অ্যাপ লঞ্চ হবে। আমরা সবাই সেটা ডাউনলোড করব। তারপর ফর্ম ফিল আপ ও আপলোড। সে সব দেখে সমীক্ষকরা আমাদের বাড়িতে আসবেন এবং ফর্ম মিলিয়ে নেবেন। মোদিজি হয়তো ভুলে গিয়েছেন, আমাদের দেশে এখন ৭০ কোটির কাছাকাছি মোবাইল ফোন চলে। অনেকেরই আবার তার মধ্যে একাধিক হ্যান্ডসেট ও নম্বর রয়েছে। ৭০ কোটি একক ব্যবহারকারী ধরলেও কিন্তু আরও ৭০ কোটি মানুষ এখনও স্মার্টফোন ব্যবহার করে না। তাদের সেই ক্ষমতা নেই। কেনারও না, ব্যবহারেরও না। তাহলে ডিজিটাল সেন্সাস হবে কীভাবে? আর কবে?
বোধহয় আচ্ছে দিন এলে।