প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
অভয়ার বিচারের দাবি কানাগলিতে হারিয়ে গিয়েছে সেই কবেই। ধর্মতলার অনশন মঞ্চে গত দু’সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ দেখলে বেশ বোঝা যাচ্ছে, নির্যাতিতার বিচারকে ছাপিয়ে গিয়েছে জুনিয়র চিকিৎসকদের দশ দফা দাবি। তার অনেকটাই কিন্তু মেনে নিয়েছে কিংবা কার্যকর করার আশ্বাস দিয়েছে সরকার। কিন্তু সরকারি ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস, ওষুধ ও ডায়াগ্নোস্টিক কোম্পানির সঙ্গে সিন্ডিকেট বন্ধের কোনও দাবি সেখানে নেই কেন? জনমানসে প্রশ্ন একটাই, কোনও পরিকাঠামো নির্মাণ কি ২৪, ৪৮ কিংবা ৭২ ঘণ্টায় সম্ভব? কেন্দ্রীয় স্তরে রেফারাল ব্যবস্থা চালু করা, বেড খালির খতিয়ান, টানা ডিউটিতে ক্লান্ত ডাক্তারদের জন্য রেস্টরুম নির্মাণ, নিরাপত্তার স্বার্থে ক্যামেরা বাড়ানো, ডাক্তারদের জন্য আলাদা টয়লেট, নিরাপত্তা বৃদ্ধি, কাজের পরিবেশের উন্নয়ন সারাবছরই চলতে থাকে। এসবই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা যথারীতি আজও চলছে। ‘থ্রেট কালচার’ নিয়ে এত কথা বলা হচ্ছে কিন্তু আজকের সিনিয়র ডাক্তারদের সবিনয়ে প্রশ্ন করি, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, এর এক ফোঁটাও কি ছিল না বাম আমলে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের জমানায়? বিনা দ্বিধায় বলতে পারি, শুধু ছিলই না আরও কদর্যভাবে খুল্লামখুল্লা ছিল। এবং আজ যাঁরা প্রতিবাদে মুখর তাঁদের অনেকেই সেদিন ছিলেন ভয় দেখানো, হেনস্তা ও মারধরের প্রধান মুখ। আতঙ্কে কেউ মুখ খুলতে পারত না। যুগে যুগে এসবই ক্ষমতার বিষময় ফল। আবার কোনও উচ্চপদে আসীন ব্যক্তির দুর্নীতি ও অপরাধের দায় ষোলোআনা সরকারের উপর চাপানোও অনুচিত। কোনও একটা বিন্দুতে কিংবা সময় বেঁধে তাতে লাইন টেনে দেওয়াও সম্ভব নয়। স্বভাবতই রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে লাটে তুলে রাজপথে টানা অনশন কতটা যুক্তিসঙ্গত? মানতেই হবে ঘটনার ১০০ ঘণ্টার মধ্যেই তদন্তভার ন্যস্ত হয়েছে সিবিআইয়ের কাঁধে। সেই থেকে অভয়ার খুন ও ধর্ষণের তদন্ত ও বিচার রাজ্যের হাতে নেই। সিবিআই ও সুপ্রিম কোর্টের হাতে। একাধিক কর্তা, সিনিয়র আমলাকে বদলি করা হয়েছে। একমাত্র স্বাস্থ্যসচিব বাদে। কাকে কোন দায়িত্বে রাখা হবে, তা একটা নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্ত। এর সঙ্গে বিচারের কতটুকু সম্পর্ক। যদি না বাইরে থেকে কোনও উস্কানি থাকে, বৃহৎ কোনও রাজনৈতিক এজেন্ডা কাজ করে থাকে তাহলে চিকিৎসকদের জীবন বাজি রেখে এখনও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা। সর্বনাশ হচ্ছে গরিবের। আর ফুলে ফেঁপে উঠছে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম। তাদের গত দু’মাসের ব্যবসা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। রোজগার বেড়েছে অনেক নামী চিকিৎসকের। মুখে না বললেও তাঁরা চাইছেন, এই অরাজকতা চলুক। কে না চায় এই মওকায় দৈনিক আয় দেড় থেকে দ্বিগুণ হোক, অকাল বসন্ত দীর্ঘায়িত হোক! আর নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণকে স্বতঃস্ফূর্ত আখ্যা দিয়ে ফসিল হয়ে যাওয়া বামেরা নতুন করে জেগে উঠতে চাইছে। কিন্তু স্বপ্ন দেখলেও বিশেষ ভরসা রাখতে পারছে না। পাছে লাল ঝান্ডা বের করলেই জমায়েত নিমেষে খালি হয়ে যায়!
সরকার বিরোধী কুৎসা পিছু ছাড়েনি বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোতেও। পুজোর রাতে মণ্ডপে ভিড় বেশি না ধর্মতলার অনশন মঞ্চে, তা নিয়েও চলেছে বিস্তর আলোচনা। বলা হয়েছে, মা দুর্গাকে দেখতে হলে ধর্মতলা যান। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, আন্দোলনকারীরা বিচার চাইছেন না ক্ষমতা বদল। ক্ষমতা বদল ভারতের মতো কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এক অঙ্গরাজ্যে এভাবে হয় না। এটা বাংলাদেশ নয়। পাকিস্তানও নয়। সম্ভবত এই কথাটা তাঁরা হয় ভুলে গিয়েছেন কিংবা ইচ্ছে করে ভুলতে এবং ভোলাতে চাইছেন। সব জেনেও স্বার্থান্বেষী কোনও চক্র তাঁদের বিপথে চালিত করছে। আন্দোলনকারীদের মাথায় ঘুরছে হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকার মাটিতে সংগঠিত ‘দ্রোহ’ পর্বের পুনরাবৃত্তির অবাঞ্ছিত নেশা। সেই কারণেই সিবিআই তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়া, সর্বোচ্চ আদালতের উপর আস্থা না রেখে রাজপথে দ্রোহের কার্নিভালের অবতারণা। রেড রোডকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পাল্টা কার্নিভালের আসল ওজন বোঝা যাবে ভোটের ফলে, নাগরিক পদচারণায় নয়! ‘রাজপথ ছাড়ি নাই’ বলে সদর্পে হুঙ্কার দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। কিন্তু গণতন্ত্রে পথই কি বিচার আদায় করে নেওয়ার আদর্শ মঞ্চ? বোধহয় নয়। তাই এবার অপেক্ষা ভোটের কার্নিভালের, নির্বাচনী মহোৎসবের। অভিশপ্ত ৯ আগস্টের পর তিন মাস পেরিয়ে আগামী ১৩ নভেম্বর রাজ্যের ৬ বিধানসভা আসনে উপ নির্বাচন। গুরুত্বপূর্ণ মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা ভোটের পাশাপাশি বাংলা ও উত্তরপ্রদেশের ১৫টি বিধানসভা আসনের উপ নির্বাচনের অপেক্ষা। সবিনয়ে প্রশ্ন করি, এতকিছুর পরও রাজ্যের ৬টি আসনের মধ্যে ক’টায় লড়াই দেওয়ার মতো জায়গায় বিরোধীরা? নাকি তাঁরা ভেবে বসে আছেন ডাক্তারদের অনশন মঞ্চেই বুথ হবে, সেখানেই নিষ্পত্তি হবে কার জনসমর্থন বেশি।
কলকাতার লাগোয়া নৈহাটি ও হাড়োয়া। মেদিনীপুর, তালডাংরা। এবং উত্তরবঙ্গের সিতাই ও মাদারিহাট। আপাতত এই ৬ কেন্দ্রই পাখির চোখ। এক্সিট পোলের বিস্তর কেরামতি বাংলার মানুষ দেখেছে গত জুন মাসে। প্রায় অধিকাংশ সমীক্ষক দলই বুথ ফেরত সমীক্ষায় শাসক দলকে হারিয়ে দিয়েছিল সিংহভাগ আসনে। কিন্তু তার বিন্দুমাত্র কোনও প্রভাব দেখা যায়নি আসল ফলাফলে। বেশিদিন আগের কথা নয়। ৪ জুন বেরিয়েছিল লোকসভার ফল। ৪২-এর মধ্যে ২৮টিতে জিতে শুধু বিরোধীদেরই নিশ্চিহ্ন করেনি শাসক তৃণমূল, ভোট পণ্ডিতদেরও মাথা হেঁট করে দিয়েছে। এক্সিট পোল পণ্ডিতদের মাথা অবশ্য হেঁট হয়েছে সাম্প্রতিক হরিয়ানার ফলেও। একটি নয়, একাধিকও নয় প্রায় সবকটি এক্সিট পোলই সেখানে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। হলফ করে বলতে পারি, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গেও সমীক্ষকদের পূর্বাভাস মিলবে না। তিন সপ্তাহের সামান্য বেশি ব্যবধানে ৬টি কেন্দ্রে ভোট। একুশের ফল অনুযায়ী ছয় আসনের মধ্যে তৃণমূল জিতেছিল পাঁচটিতে। একটি মাত্র আসন আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাটে বিজেপি জেতে। এত আন্দোলন, দ্রোহ কার্নিভাল, পথে প্রান্তরে বিচার ছিনিয়ে নেওয়ার আকুতির পর কি সেই ফলের কোনও হেরফের হবে? নাকি ৫-১ বদলে এবার শাসকদলের পক্ষে ৬-০ ফল হবে। ভোটটা কিন্তু নাগরিক সমাজ লড়বে না। লড়তে হবে রেজিস্টার্ড রাজনৈতিক দলকে ঝান্ডা কাঁধে নিয়ে। সন্দেশখালি নিয়ে লাগাতার প্রচারের পরও বসিরহাট লোকসভায় ৩ লক্ষ ৩৩ হাজার ভোটে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী হাজি নুরুল। একদা নিরাপদ আসন বলে পরিচিত কোচবিহার লোকসভা আসনটাও হাতছাড়া হয়েছে বিজেপির। তাই সিতাইয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নও বাস্তবায়িত হওয়া কঠিন। মেদিনীপুর, তালডাংরা এবং নৈহাটিতে অঘটনের আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই চলে। তার উপর গত আড়াই মাসের আন্দোলনে তৃণমূল বিরোধী ভোট আরও একটু বেশিই কাটাকুটি হবে, আশঙ্কা এমনই। অভয়া আন্দোলন বিজেপির সিলেবাসের বাইরে। এটা মূলত বাম আর অতি বাম নকশালদের কিসসা। সঙ্গে দু’আনা এসইউসি। এই বিচিত্র ভোট কাটাকুটিতে শাসক দলেরই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা। বলা বাহুল্য, বিরোধীদের বুথ সংগঠন জেলায় জেলায় এখনও অত্যন্ত দুর্বল। তাই যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ড, গড়িয়া, বাগুইআটি, ধর্মতলায় বিচারের দাবিতে ভিড় হলেও তার প্রভাব দূর জেলার ভোটযন্ত্রে কতটা পড়ল, তা জানার জন্য ২৩ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে আমাদের।
একটা ধারণা আছে, সাধারণত উপ নির্বাচনে শাসকদলই জেতে। কারণ, এই ভোটের মধ্য দিয়ে সরকার বদলের সুযোগ থাকে না। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গেও ওই ৬টি আসনের ফলাফলে ক্ষমতার হাত বদলের কোনও শঙ্কা কিংবা সম্ভাবনা নেই। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের পরে রাজ্যে তিনটি বিধানসভার উপ নির্বাচনে সিপিএম তথা বামেদের পরাস্ত করে জিতেছিল তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। দেড় দশক আগে ২০০৯ সালে জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জে জিতেছিলেন খগেশ্বর রায়। ওই বছরই দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর পশ্চিম আসন (পুনর্বিন্যাসের পরে ওই কেন্দ্রটি এখন আর নেই) থেকে জিতেছিলেন মদন মিত্র। সিপিএম নেতা তথা তৎকালীন মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী প্রয়াত হন ২০০৯ সালের আগস্টে। তাঁর কেন্দ্র পূর্ব বেলগাছিয়া (পুনর্বিন্যাসের পরে এই কেন্দ্রটিও এখন আর নেই) সিপিএম প্রার্থী করেছিল সুভাষ-পত্নী রমলা চক্রবর্তীকে। তৃণমূলের প্রার্থী হিসাবে রমলাকে পরাস্ত করেছিলেন সুজিত বসু। সুজিতবাবু এখন বিধাননগর কেন্দ্রের বিধায়ক তথা রাজ্যের দাপুটে দমকল মন্ত্রী। সেরকম কোনও আশার আলো কি এই মুহূর্তে বাম কিংবা গেরুয়া শক্তি দেখতে পাচ্ছে? যদি সত্যি পেত, তাহলে নাগরিক আন্দোলনের আড়ালে মুখ ঢেকে টানা তিন মাস অক্সিজেন খুঁজত না। মুখোমুখি সামনে এসে দাঁড়াত পতাকা হাতে। সেই হিম্মত কিংবা মুরোদ নেই বলেই লাজুক লাজুক মুখ করে তারা স্রেফ সুযোগের সন্ধানে। ভগবান কিন্তু ডরপোক নয়, সর্বদা সাহসীদের সঙ্গেই থাকে। ২৩ নভেম্বর তা আবারও প্রমাণ হবে। বাংলার মানুষ কিন্তু চক্রান্তের জাল কেটে ভোটযন্ত্রে ‘বিচার’ পেতে মরিয়া।