প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
তাঁর কথাগুলিকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) তরফের বক্তব্য হিসেবেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। তার কারণ আরএসএস নামক সংগঠনটির প্রকৃতি ও কাঠামো এবং সেখানে তিনিই সরসঙ্ঘচালক বা সংগঠনের শীর্ষকর্তা। সকলের এটাই বিশ্বাস যে, সংঘ-প্রধানই আরএসএসে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী। তাই, মোহন ভাগবতের ভাষণগুলিকে অবশ্যই গুরুত্বসহকারে নেওয়া উচিত এবং, ইদানীং সেটাই হয়ে থাকে।
শীতল বাতাস
গত জুন মাসে, লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরপরই মোহন ভাগবত একটি ভাষণ দেন। সেখানে তাঁর উল্লেখযোগ্য পরামর্শের মধ্যে ছিল—‘অহংকার ত্যাগ করে বিনয়প্রদর্শনে অভ্যস্ত হয়ে উঠুন।’ লোকসভা নির্বাচনের পরে এটাই ছিল তাঁর প্রথম জনসাধারণের উদ্দেশে ভাষণ। তাতে তিনি আরও বলেছিলেন:
• রাজনৈতিক দলগুলির কাছে যে সভ্যতা ভদ্রতা শালীনতা প্রত্যাশিত, নির্বাচনী ভাষণে ব্যবহৃত মিথ্যা ও বিদ্বেষমূলক ভাষায় তা নষ্ট হচ্ছে।
• আপনার প্রতিপক্ষ কোনও শত্রু নন, তিনি একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন মাত্র। তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে শুধু বিরোধী বলুন। বিরোধীদের মতামতও বিবেচনা করা উচিত।
• এছাড়া, একজন সত্যিকারের ‘সেবক’ মর্যাদা বজায় রাখেন। ‘আমি এই কাজ করেছি’ বলার মতো অহংকার তাঁর ভিতরে থাকে না।
ভাগবতজির ওই ভাষণের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক মহল থেকে এটাই বলা হয়েছিল যে, কথাগুলির লক্ষ্য ছিলেন একজনই—নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর নির্বাচনী প্রচার।
মোহন ভাগবত তাঁর পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ভাষণটি দেন গত জুলাই মাসে। সেখানে তাঁর একটি উক্তি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে, ‘একজন মানুষ সুপারম্যান হতে চায়, তারপর হতে চায় একজন দেবতা এবং অবশেষে একজন ভগবান!’ নরেন্দ্র মোদি দাবি করেন যে তাঁর জন্ম ‘জৈবিকভাবে’ নয়। ভাগবতজির এই মন্তব্য স্পষ্টতই মোদিজির জন্মরহস্য তত্ত্বকেই খারিজ করে বইকি। মোদিজি গর্ভসঞ্চার, গর্ভধারণ এবং সন্তান প্রসবের ধারণাকে অস্বীকার করে থাকলে তিনি কি নিজেকে ‘সৃষ্ট’ বলে দাবি করছেন! আর এখানেই মোহন ভাগবত কি সেই ইঙ্গিতই করেছেন যে, নরেন্দ্র মোদি তাঁর বাগাড়ম্বরের সীমা অতিক্রম করেছেন?
একটি ঠান্ডা তরঙ্গ
আরএসএসের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষ্যে মোহন ভাগবত তাঁর তৃতীয় ভাষণটি দিয়েছেন গত ১২ অক্টোবর বিজয়াদশমীর দিন। সেটি আমি পড়েছি একটি সংবাদ প্রতিবেদন আকারে এবং ইংরেজিতে (টাইমসঅফইন্ডিয়া.ইন্ডিয়াটাইমস.কম)। তাঁর বক্তব্য আমাকে হতাশ করলেও আমি মোটেই আশ্চর্য হইনি। কেননা, আরএসএসের প্রতিষ্ঠিত আদর্শগত অবস্থানেই ফিরে গিয়েছেন মোহন ভাগবত। তাঁর ভাষণ ধর্ম, সংস্কৃতি, ব্যক্তিগত ও জাতীয় চরিত্র, শুভ ও ন্যায়ের জয় এবং আত্ম-গৌরব প্রভৃতি শব্দ ও প্রবাদে বিন্যস্ত ছিল। হামাস ও ইজরায়েলের মধ্যে সংঘাতের প্রতি দৃষ্টিপাত করেও ৪৩ হাজার মানুষের মৃত্যু নিয়ে তিনি কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচন প্রসঙ্গ এনেও তিনি শুভেচ্ছা জানাননি সেখানকার নতুন সরকারকে। মণিপুরের ঘটনা সম্পর্কে শুধু ‘উপদ্রুত’ শব্দটি উচ্চারণ করেই দায় সেরেছেন ভাগবতজি।
মোহন ভাগবতের ভাষণের বাকি অংশটি ছিল একদম মোদিসুলভ—একটি জাতি হিসেবে ভারত কীভাবে শক্তিশালী হয়েছে, কীভাবে দুনিয়া আমাদের সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধকে গ্রহণ করছে এবং কীভাবে বিশ্বমঞ্চে ভারতের ভাবমূর্তি, শক্তি, খ্যাতি ও অবস্থান ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে। তাঁর ভাষণে আরও ছিল—দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার প্রচেষ্টা প্ররোচনা পাচ্ছে, কিছু স্বঘোষিত উদারপন্থী দেশ অন্য দেশকে আক্রমণ করতে বা তাদের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলিকে অবৈধ বা হিংসাত্মক উপায়ে উৎখাত করতে দ্বিধা করে না, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করার মতলবি প্রচেষ্টা অব্যাহত প্রভৃতি। মোহন ভাগবত গুরুতর অভিযোগগুলির কোনও প্রমাণ অবশ্য দেননি। বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে টানা বলে গিয়েছেন তিনি। তাঁর ভাষণে উঠে এসেছে—‘কোনোরকম প্ররোচনা ছাড়াই হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্মম নৃশংস অত্যাচার’, ‘হিন্দুসহ সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাথার উপর বিপদের খাঁড়া ঝুলে আছে’ এবং ‘অবৈধ অনুপ্রবেশের’ বিপদ। তাঁর মতে, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশের ফলে ভারতের জনসংখ্যা ভারসাম্য হারাচ্ছে। পরিশেষে, মোদির মতোই উপসংহার টেনেছেন তিনি, ‘সারা পৃথিবীর এই শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যে, অসংগঠিত এবং দুর্বল হয়ে থাকার অর্থ, দুষ্টদের ঔদ্ধত্যকে আমন্ত্রণ জানানো।’
ব্যক্তিগত অভিমত
‘হিন্দু’ শব্দের পরিবর্তে ‘মুসলিম’ শব্দটি ব্যবহার করুন, বিশেষ করে উপসংহারে, এবং তখন এটাই দেখা যাবে যে, বক্তা প্রতিটি সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পক্ষে ওকালতি করছেন। মোহন ভাগবতের প্রতিটি চিন্তাভাবনা এবং শব্দ ভারতে মুসলমান ও দলিতদের দুর্দশার বর্ণনা করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। কথাগুলি সমানভাবে প্রযোজ্য হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ, বিশ্বযুদ্ধপূর্ব জার্মানিতে ইহুদি, মাতৃভূমিতে ফিলিস্তিনি, সংখ্যাগরিষ্ঠের দাপটে ভীত-শঙ্কিত প্রতিটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং সর্বত্র মহিলা প্রসঙ্গে। কে আগ্রাসী আর কে সেই আগ্রাসনের শিকার—তা নির্ভর করে একজন মানুষ কোন অবস্থানে বসে সেটা দেখছেন বা বিচার করছেন তার উপর।
আরএসএস আধুনিক রাজনৈতিক ভাষণের ভাষা আয়ত্ত করেছে বলেই মনে হচ্ছে। যেমন মোহন ভাগবত উদারভাবে সেই শব্দগুলি ব্যবহার করেছেন—ডিপ স্টেট, ওকিজম, কালচারাল মার্ক্সিস্ট, ফাইন্ডিং ফল্ট লাইনস এবং অলটারনেটিভ পলিটিক্স। ভাগবতজি ‘শহুরে নকশাল’ এবং ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ কথা দুটি মিস করেছেন! তিনি ‘আরব বসন্ত’ এবং ‘প্রতিবেশী বাংলাদেশে সম্প্রতি যা ঘটেছে’ তার উল্লেখ করেছেন। একইসঙ্গে ‘ভারতের চারপাশে একই ধরনের অপচেষ্টার’ বিরুদ্ধে আমাদের সতর্কও করেছেন তিনি। আমি আশ্চর্য হচ্ছি এটা ভেবে যে, আরব বসন্ত অথবা বাংলাদেশের একটি স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিদ্রোহের মধ্যে ‘মন্দ’ কী ছিল? উল্লেখ্য, বিরোধী নেতাদের কারাগারে বন্দি রেখে অনুষ্ঠিত এক নির্বাচনে ‘জয়ী’ হয়েছিল ঢাকার ওই সরকার।
মনে হচ্ছে, আরএসএস ও বিজেপি নিজেদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নিয়ে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের প্রতিস্পর্ধী হবেন না কেউ, তাহলে তিনি সাহসী হবেন তাঁর কর্তৃত্ব জাহির এবং বিরোধী দলের দুর্নাম করতে। একইভাবে মোদিজি তাঁর সেইসব নীতির অনুসরণে প্ররোচিত হবেন যাতে মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, বৈষম্য, ক্রনি পুঁজিবাদ, সামাজিক নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং অবিচার বহাল তবিয়তে চলতে পারে। এখন মোদিসুলভ আরও কথা এবং কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেকে তৈরি রাখুন।