প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
আজকের জমানা সামনে থেকে দেখলে কি রবি ঠাকুর এই শব্দগুলো একটু অদল বদল করে নিতেন? যেমন, প্রার্থনার বদলে ডিমান্ড? কিংবা মন্থনের জায়গায় ব্ল্যাকমেল? উত্তর পাওয়া যাবে না। কারণ, তিনি নিজে ছাড়া তাঁর সৃষ্টি রিক্রিয়েট করার ক্ষমতা কারও নেই। তাই দিকে দিকে এখনও রবি ঠাকুরকেই উদ্ধৃত করাটা ফ্যাশন। ছেলেবেলায় পরীক্ষায় রচনা লেখার সময় ওঁকেই কোট করতাম। এখনও তার অন্যথা হচ্ছে না। কে যেন ওই সময় শিখিয়েছিল, রবি ঠাকুরকে কোট করতে পারলে বেশি নম্বর পাওয়া যায়। এখনও আমরা সবাই তাঁকেই অবিকল ছেপে চলেছি। সুবিধাও আছে। কারণ, হেন কোনও বিষয় নেই, যে ব্যাপারে তিনি লিখে যাননি। কিন্তু আজও তিনি একইভাবে সমসাময়িক হয়ে থেকে গেলেন কীভাবে? কারণ একটাই—সমাজ তখন ছিল পেঁয়াজের মতো। আজও তাই। খোলা ছাড়ালেই নতুন দৃশ্য। আর সেই সঙ্গে ঝাঁঝ। তাই বলতেই পারি, রবি ঠাকুরের সময়ের তুলনায় আজ সমাজের ভাঁজ এবং ডিসপ্লে শুধু বদলেছে। চাহিদা বা আদায়ের ঢঙ মোটেও বদলায়নি। প্রথম দিনের সিসি ক্যামেরার দাবি দ্বিতীয় দিনে বদলে হয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় রেফারেল ব্যবস্থা, তো তৃতীয় দিনে সচিবকে সরানোর আব্দার। এই দাবিদাওয়া মেটাবে কে? কেন? সরকার মেটাবে! মুখ্যমন্ত্রী মেটাবেন! এই সব চাহিদা তিনি মেটাতে বাধ্য। প্রশাসনের মাথায় বসে আছেন। তাঁর একটা দায়িত্ব নেই? কী এমন কাজ করেন তিনি? বন্যা হলে প্রত্যন্ত গ্রামে ছুটে যান? ধস নামলে কি পাহাড়ে ছুটে গিয়ে সব সামলে আসেন? নাকি ১০০ দিনের টাকা কেন্দ্র আটকে দিলে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ান? কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার... এসব তো উৎকোচ! এই যে একটা রাজ্য চলছে... তার বিভিন্ন দপ্তর, ঘরে ঘরে জল, বিদ্যুৎ, আইন-শৃঙ্খলা, নানাবিধ পরিষেবা... এইসব তো এমনিই চলে। মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা কী? তাই তাঁর উচিত খবর পাওয়া মাত্র অবস্থান মঞ্চে এসে বসা। সর্বক্ষণ জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি শোনা এবং যা তাঁরা বলছেন, তক্ষুণি মেনে নিয়ে অফিসারদের তাড়িয়ে দেওয়া। এমনটা না করলেই তিনি মানব বিরোধী। আর যাঁরা এইসব দাবির দেওয়ালের পিছনে দাঁড়িয়ে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাটাকে লাটে তুলে দিয়েছেন? তাঁরা সংস্কারক। কর্তব্য পালন করছেন তাঁরা। কীভাবে? বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে রোগী দেখে! ‘ওটি’ করে!
গুপ্তবাবু যেমন করেছেন। তাঁকে যদি প্রশ্ন করি, ৯ আগস্ট থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত বেসরকারি হাসপাতালে ক’টা কাঁটাছেঁড়া করেছেন? গুনে শেষ করতে পারবেন তো? নার্সিংহোমের সংখ্যা তো কমপক্ষে ১২টা। ইনকাম তাহলে কত হয়েছে? আপনারই রেজিস্ট্রেশন নম্বর তো ‘জি’ দিয়ে শেষ হচ্ছে তাই না? তাহলে খুব ভুল করছি না। আর যেমন ডাক্তারিটা মন দিয়ে করেন মালাকার মশাই। তিনি তো শুনছি এই সময়ে শুধু স্বাস্থ্যসাথীতেই ১৬টা কেস করেছেন। যতদূর জানা যাচ্ছে, তাঁর রেজিস্ট্রেশন নম্বর শুরু হচ্ছে ‘সি’ দিয়ে। আর বলতে পারি শেখ সাহেবের কথা। তিনি আবার কলকাতার নন। দক্ষিণবঙ্গের একটু দূরের জেলার মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তার (রেজিস্ট্রেশন নম্বরের মাঝে ৫৪ নম্বরটি আছে)। ৫০টিরও বেশি কেস এই দু’মাসে হ্যান্ডল করেছেন তিনি। আয়ের অঙ্কটা? না হয় গোপনই থাক। এঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই মিল একটা বিষয়ে—এঁরা সবাই হাতিয়ার করেছেন রাজ্যের সাধারণ, গরিব মানুষকে। স্বাস্থ্যক্ষেত্র এমন একটা জায়গা, যার উপর আঘাত এলে কোনও সরকারই চোখ ঘুরিয়ে থাকতে পারবে না। খেটে খাওয়া, গরিব মানুষগুলো প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা খরচ করে সরকারি হাসপাতালের দরজায় হত্যে দেবে। তারপরও তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। অপারেশনের ডেট পড়লে তা বাতিলও হবে। বলা হবে, ‘সব নর্মাল হলে আসবেন।’ কবে হবে নর্মাল? সেই উত্তর কি দিতে পারবেন? ততদিন ওই গরিব মানুষটার রোগ অপেক্ষা করবে তো? তার প্রাণটুকু থাকবে তো শরীরে? আপনার বাড়ির কেউ মরণাপন্ন হলেও কি একই কথা বলবেন? ‘মা, আর একটু অপেক্ষা করো। সব নর্মাল হলে হাসপাতালে নিয়ে যাব।’ না বলবেন না। তাঁকে আপনি নিয়ে যাবেন বেসরকারি হাসপাতালেই। কারণ, সেখানে কর্মবিরতি নেই। আপনি বা আপনার কোনও সহকর্মী সেই হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত। যে প্যাথলজিক্যাল টেস্ট সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে হয়, সেটাই ওই নার্সিংহোমে বিল হবে বিশ হাজার টাকার। যে অস্ত্রোপচার পিজি বা মেডিক্যাল কলেজে রাজ্যের প্রথম সারির ডাক্তাররা নিখরচায় করেন, তার জন্য ওই বেসরকারি হাসপাতালে গুনতে হবে লক্ষ লক্ষ টাকা। তাহলে খেটে খাওয়া ওই মানুষগুলোকে সত্যিই কি দাবি আদায়ের হাতিয়ার বলা যায়? না শব্দটা আরও নির্দিষ্ট—তাঁরা আজ ‘পণবন্দি’। দাবি মানুন, না হলে স্বাস্থ্য ধর্মঘট। এটা কোনও সুনাগরিকের বক্তব্য হতে পারে? এটা কি থ্রেট কালচার নয়? বাম জমানায় জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে কী আচরণ করা হতো, তা জানার জন্য ইতিহাসবিদ হতে হয় না। একটু খোঁজখবর করলেই জানা যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপরাধ, তিনি এই আন্দোলনের প্রতি নমনীয়। অভয়া কাণ্ডের বিচার সিবিআই করছে। তাও সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে। আর জি করে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের তদন্তভারও কেন্দ্রীয় এজেন্সির হাতে। তাহলে রাজ্য সরকার কোন দাবি পূরণ করবে? মেডিক্যাল কলেজগুলোতে নির্বাচন? তার জন্য মুখ্যমন্ত্রী চার মাস সময় চেয়েছেন। আন্দোলনকারীরা তাতেও খুশি নন। এছাড়া তাঁদের দাবি, স্বাস্থ্যসচিবকে সরাতে হবে। কেন? তিনি নাকি দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ? সন্দেহ আছে। তাহলে কীসের ভিত্তিতে তাঁর মতো একজন আইএএস অফিসারকে রাজ্য সরকার সরিয়ে দেবে? কাদের কথায়? যাঁরা একদিকে আন্দোলন চালাবেন, আর অন্যদিকে ‘পণবন্দি’ গরিব রোগীদের বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে যেতে বাধ্য করবেন?
বাম জমানার শেষের দিকেও কখনও সরকারি হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজে গিয়েছেন? আর ইদানীং? ফারাক কি কিছু চোখে পড়েছে? রোগীর চাপ তখনও ছিল। এখনও আছে। কিন্তু পরিকাঠামো, চিকিৎসা ব্যবস্থা, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি... বদল এসেছে। সেটা দেখার জন্য কোনও পার্টির চাদর গায়ে জড়াতে হয় না। বরং নিরপেক্ষ চোখ লাগে। আর দালালরাজ। সেটা সব জমানাতেই ছিল। ভবিষ্যতেও থাকবে। তার জন্য দায়ী আমরাই। মুর্শিদাবাদ বা পুরুলিয়া থেকে প্রথমবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এসে রোগীর পরিজন মাঝসমুদ্রে পড়েন। কোথায় যাবেন, কার সঙ্গে কথা বলবেন, ভর্তির জন্য কী করতে হবে... কূল পান না তাঁরা। ওই রোগীর বাড়ির লোকজনই তখন খুঁজে বের করেন দালাল। দুটো পয়সা নিক, কিন্তু কাজটা হয়ে যাবে। সেই দালাল কিন্তু বোড়ে মাত্র। ওই চেইনটা পাড়ি দেয় উপরতলা পর্যন্ত। কর্তৃপক্ষ হতে পারে, রোগী কল্যাণ সমিতি, বা ইউনিয়ন। নির্বাচিত ইউনিয়ন বা রোগী কল্যাণ সমিতিতে প্রতিনিধিত্ব থাকলে এই সবই থাকবে হাতের মুঠোয়। সবচেয়ে বড় কথা, তা যদি শাসক দলের না হয়, তাহলে তো পোয়া বারো। সরকার অপছন্দের কোনও নির্দেশিকা জারি করলে তার বিরোধিতা করা যাবে সরকারিভাবেই। দাবি না মানলে? ‘পণবন্দি’ গরিব রোগীগুলো তো আছেই! আর সঙ্গে আছে নাগরিক সমাজ নামে তথাকথিত এলিট ক্লাসের একটা অংশ। তারা কোনওদিন সরকারি হাসপাতালে যাবে না, টিকিট কেটে ওপিডির লাইন দেবে না, অপারেশনের ডেট পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষাও করবে না। শুধু সোশ্যাল মিডিয়া নামক একটি অস্ত্রে শান দিয়ে প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করবে। তারা এটাও ভাববে না, ফেবু করে বাংলায় অন্তত ভোট প্রভাবিত করা যায় না। জনমতও তৈরি হয় না। কারণ, সমাজের খেটে খাওয়া যে শ্রেণির ভরসায় আমরা ফুটানি মারি, তারা কিন্তু এই আন্দোলনকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। কারণ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারাই। সরাসরি। আর ‘পণবন্দি’ ওই শ্রেণিটাকে সামনে রেখে সরকার-মন্থন চলছে। অমৃত যা মিলবে, তাদের। আর বিষ? সেটা কে পান করবে? অমৃত বেরলে তো বিষ আসবেই। এটাই নিয়ম। এটাই ভবিতব্য। সংসারের ব্যালান্স। সেই বিষও কিন্তু সমাজকেই পান করতে হবে। যাঁরা আজ অনশন করছেন, আন্দোলনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন, তাঁদের অধিকাংশই সৎ। নিজেদের দায়িত্বের এবং কর্তব্যের প্রতি তাঁদের আস্থা আছে। সমাজে একটা ইতিবাচক দাগ রেখে যাওয়ার চেষ্টাও হয়তো করছেন তাঁরা। কিন্তু বুকে হাত রেখে বলুন তো, সাধারণ মানুষকে ‘পণবন্দি’ বানিয়ে এই আন্দোলনের সুফল ভোগ করা যাবে তো? আপনারা কিন্তু গুটিকয়। ওই বোড়ের মতোই। আসল নেপথ্যচারীরা আপনাদের সামনে রেখেই স্বার্থসিদ্ধি করছেন এবং করবেন। কেউ কাইন্ডে। আবার কেউ ক্যাশে। কেউ আবার ভবিষ্যতে রাজনীতির মূলস্রোতে যাবেন। তারই ভিত মজবুত করা চলছে। অভয়ার দোষীদের শাস্তি হোক। দুর্নীতি থাকলে তদন্ত হোক। ব্যবস্থা নিক সরকার। কিন্তু সাধারণ মানুষের যন্ত্রণার বিনিময়ে নয়। আন্দোলন আপনাদের। পথ আপনারাই বের করবেন। সেই পথে সততা থাকলে, সেই পথ ক্ষতিকর না হলে মানুষও আপনাদের পাশে থাকবে। তার জন্য কোনও রাজনীতির ঝান্ডা লাগবে না। সরকার হাত জোড় করবে। কিন্তু জোড়হাত হতে হবে আমাদেরও। প্রত্যেক মানুষের পাশে দাঁড়াতে না পারলে সিংহাসনে জোর খাটে না... ‘রাজারও না, প্রজারও না।’ এই শিক্ষাটাও তো ‘মুক্তধারা’য় রবি ঠাকুরই দিয়ে গিয়েছেন। রাজাকে। প্রজাকেও।