প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
দেশের মানুষের কাছে অতিপরিচিত চরকা শোভিত ত্রিবর্ণ পতাকা, যা ছিল তৎকালীন জাতীয় কংগ্রেসের, সেটাই হল আজাদ হিন্দ সরকারের পতাকা। ব্যাঘ্র শোভিত ত্রিবর্ণ হল আজাদ হিন্দ সরকারের সামরিক দপ্তরের আজাদ হিন্দ ফৌজের নিশান। সরকারের উপদেষ্টা হলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। আর রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী, যুদ্ধমন্ত্রী, বৈদেশিক মন্ত্রী এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য ও সদস্যাদের মধ্যে আজাদ হিন্দ ফৌজের মতোই হিন্দু, মুসলিম, শিখ, ইশাহি প্রভৃতি সব ধর্মের মানুষজন ছিলেন। তাঁদের হাতে ছিল প্রচার, শিক্ষা, অর্থ প্রভৃতি দপ্তর। সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েকদিনের মধেই নেতাজির আজাদ হিন্দ সরকারকে প্রকাশ্যে একে একে লিখিতভাবে স্বীকৃতি জানায় বিভিন্ন রাষ্ট্র। তাদের মধ্যে ছিল জার্মানি, জাপান, ক্রোয়েশিয়া, চীন, মানচুকো, ফিলিপাইনস, বার্মা, ইতালি, থাইল্যান্ড প্রভৃতি। এছাড়া স্বীকৃতি জানান আয়ারল্যান্ডের ডি-ভ্যালেরা। পরবর্তীকালে আরও জানা যায় যে, রাশিয়ার স্তালিনও আজাদ হিন্দ সরকারকে সমর্থন করেছিলেন। এমনকী সে-দেশে এই নয়া সরকারের দূতাবাস খোলারও ব্যবস্থা হয়। সরকার প্রতিষ্ঠার দিন সিঙ্গাপুরের ক্যাথে হলে ছিল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ অগণিত গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের ভিড়। সুভাষচন্দ্র আবেগমথিত কণ্ঠে বলেন, ‘ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে বলছি যে, আমি সুভাষচন্দ্র বসু ৩৮ কোটি ভারতবাসীর মুক্তির জন্য আমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব।’
কিছুদিনের মধ্যেই আজাদ হিন্দ সরকার পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী ভারতীয়দের একান্ত আপন হয়ে উঠল। লোকবল আর অর্থবলে বলীয়ান আজাদ হিন্দ প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠল ভারতের মুক্তি সংগ্রামের জন্য প্রকৃত ভারতীয় মুক্তি ফৌজ। বিশ্বে নজির সৃষ্টি করে তৈরি হল নারী বাহিনী, ঝাঁসি রেজিমেন্ট, বালসেনা ও আজাদ হিন্দ দল। ভারতীয় মুক্তি সংঘ হয়ে উঠল আজাদ হিন্দ সরকারের অন্যতম চালিকা শক্তি। আজাদ হিন্দ সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করল আমেরিকার বিরুদ্ধে। মূল লক্ষ্য, ভারত থেকে ব্রিটিশকে হটানো—ইংরেজ রাজশক্তিকে তাদের দেশেই ফিরে যেতে হবে। ভারত হল ভারতবাসীর জন্য। প্রবাসী ভারতীয়দের স্বতঃস্ফূর্ত দানের অর্থেই গড়ে উঠল আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক। জাপান থেকে বিপুল সমরাস্ত্র ও উপকরণ ক্রয়ের দাম ও বৈদেশিক ঋণ মেটানো হয় দেশবাসীর অর্থে। ক্রমশ ব্যাঙ্কের সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
সাধারণ সিভিল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা সেনা
ও গোয়েন্দা বাহিনীর জন্য তিন থেকে আট মাসের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। মোট নয়টি জায়গায় স্থাপন করা হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেগুলি তৈরি হয় পেনাং, সোনান, সেরামবান, ইপো, সালেটার, কুয়ালালামপুর, স্যান্ডিক্রাফট এবং রেঙ্গুনে। নিসুনে অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ট্রেনিদের দৈহিক, মানসিক এবং আত্মিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সেনা বাহিনীকে নেতাজি হুঁশিয়ার করে দেন, বিপক্ষের নারীদের প্রতি যেন কোনোরূপ অসম্মান প্রদর্শন করা না-হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন দেশের সেনা বাহিনীর মধ্যে নারীর অপমানের অনেক ঘটনা ঘটেছিল। সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ, তাদের হাতে কোথায় নারীর অসম্মানের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ৩০৩ রাইফেল, রিভালভার, বেয়নেট, মেশিনগান, অ্যান্টি ট্যাঙ্ক, মাইনস, মর্টার, হাতবোমা প্রভৃতির ব্যবহার শেখানো হতো। এছাড়া দেওয়া হতো সামান্য জাপানি ভাষার জ্ঞান এবং জুডো, ড্রিলের সঙ্গে গেরিলা প্রশিক্ষণও।
আজাদ হিন্দ বাহিনীতে নেতাজি সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে এসেছিলেন। তৎকালীন প্রেক্ষিতে ব্যাপারটি প্রায় অসম্ভবই ছিল। সৈন্যরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একই পাচকের রান্না একসঙ্গে বসে আহার করতেন। অংশ নিতেন একে অন্যের ধর্মীয় উৎসবে। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, জাঠ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এমনকী পার্বত্য জনজাতির মানুষজনও নেতাজির প্রতি এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীর উপর আস্থা রেখেছিলেন। নেতাজি সায়গন, সিঙ্গাপুর, টোকিও, রেঙ্গুন ও ব্যাঙ্ককে আজাদ হিন্দ বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। দৈনিক ‘আজাদ হিন্দ’ পত্রিকা, ইয়ং ইন্ডিয়া, স্বতন্ত্র ভারতম, স্বতন্ত্র ইন্ডিয়া, যুব ভারতম প্রভৃতি পত্র-পত্রিকা ইংরেজি, তামিল ও মালয়ালম ভাষায় নিয়মিত প্রকাশ হতে থাকে। প্রবাসী ভারতীয়রা স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে আজাদ হিন্দ সরকারের শরিক হয়ে ওঠেন।
জাপানের সুপ্রিমো জেনারেল তোজো লিখিতভাবে জানান, ভারতের কোনও জমি যদি জাপ সৈন্য কিংবা আজাদি সেনা দখল করে, সেই জমি হবে আজাদ হিন্দ সরকারের। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপ দুটি আজাদ হিন্দ সরকারকে অর্পণ করেন তিনি। ১৯৪৩-এর ৩০ ডিসেম্বর অখণ্ড ভারতের প্রথম ভূখণ্ড আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারে প্রথম আজাদ হিন্দের জাতীয় পতাকা ওড়ে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপের নামকরণ করা হয় যথাক্রমে ‘শহিদ দ্বীপ’ ও ‘স্বরাজ দ্বীপ’। ভারতের মূল ভূখণ্ড দখলের লড়াইয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনারা অসামান্য বীরত্বের পরিচয় দেন। সেটা বিরোধী পক্ষের সেনানায়কেরাও স্বীকার করেন। এই ব্যাপারে ইম্ফল, কোহিমা এবং আরাকানে আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে ইংরেজ বাহিনীর যুদ্ধ উল্ল্যেখযোগ্য। কালাদান উপত্যকায় জাপানি এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যরা ইংরেজ সেনাদের উপর চরম আঘাত হানেন। হাকাফালাম-সহ বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। ১৯৪৪-এর এপ্রিলে মণিপুরের মৈরাংয়ে আজাদ হিন্দের বিজয় পতাকা উড়েছিল কর্নেল সৌকত মালিকের নেতৃত্বে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের মোরে থেকে আরম্ভ করে প্যালেল, বিষেণপুর, মৈরাং প্রতি অঞ্চলে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈন্যরা ১৫০০ বর্গমাইল দখল করেন। কোনও কোনও জায়গায় আজাদ হিন্দ সেনাদের সঙ্গে ইঙ্গ-মার্কিন সেনাদের হাতাহাতি এবং মরণপণ যুদ্ধও হয়েছে। হাজার হাজার আজাদি সেনার বুকের তাজা রক্তে উত্তর পূর্ব ভারতের পার্বত্য মাটি ভিজে গিয়েছিল। অবশ্য সেই বিজয় সাড়ে তিনমাসের বেশিকাল ধরে রাখা যায়নি।
পার্বত্য বর্ষার সমস্যা ছিল। ওইসঙ্গে বাধা হয়েছিল সমরাস্ত্র ও খাদ্যের অপ্রতুলতা। কয়েকজনের বিশ্বাসঘাতকতার আঘাতও
নেমে এসেছিল। সর্বোপরি ছিল জাপানের শক্তিক্ষয়ের মতো মহাবিপদ। আজাদ হিন্দ যুদ্ধবন্দিদের বিচারকে কেন্দ্র করে ভারত জুড়েই প্রবল গণ আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্র-যুব-নৌ-বিদ্রোহ সারা ভারতে ইংরেজ শাসনের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়। ফলে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় ইংরেজ।
নিরুদ্দেশ যাত্রার প্রাক্কালে ১৫ আগস্ট, ১৯৪৫-এ স্বাক্ষরিত এক বিশেষ নির্দেশনামার শেষে নেতাজি লিখেছিলেন, ‘... পৃথিবীতে কোনও শক্তি নেই যা ভারতকে পরাধীন রাখতে পারে। ভারত স্বাধীন হবেই এবং খুব শীঘ্রই।’
বিদেশি ও বিপক্ষের ঐতিহাসিক, সেনানায়ক এবং রাষ্ট্রপ্রধানরাও একবাক্যে স্বীকার করেন যে, আজাদ হিন্দ বাহিনীর রক্তক্ষয়ী মরণপণ লড়াই ইংরেজকে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতীয় উপমহাদেশের বাসিন্দাদের এক চিরন্তন উত্তরাধিকার। সেখানে দেশের মুক্তির জন্য জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে প্রকৃত স্বাধীনতার সাধনাই ছিল শেষকথা। ২১ অক্টোবর আজও সমান প্রাসঙ্গিক। বর্তমান ও আগামীর ভারতবর্ষকে এই দিনটি এখনও পথ দেখাতে পারে। জয় হিন্দ।