প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
অভয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাংলায় তৈরি হয়েছিল গণআন্দোলন। তা থেকে বিজেপি যাতে ফায়দা তুলতে না পারে, তারজন্য গোড়া থেকেই সতর্ক ছিল চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁরা গেরুয়া শিবিরকে ধারেকাছে ঘেঁষতে দেননি। কিন্তু বামেদের প্রতি তাঁদের দুর্বলতাও চাপা থাকেনি। আর জি কর কাণ্ডে সিপিএম বুঝিয়ে দিয়েছে, ভিত্তিহীন বিষয়কে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলায় বিজেপির চেয়েও তারা অনেক এগিয়ে।
২০২১ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর যে হতাশা বাম শিবিরকে গ্রাস করেছিল আর জি কর কাণ্ড সিপিএমকে তা থেকে কিছুটা বের করে এনেছে। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে প্রশাসনকে ধাক্কা দেওয়ার ক্ষমতা বঙ্গ বিজেপির চেয়ে সিপিএমের যে বেশি, সেটাও প্রমাণ হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপ নির্বাচন হতে চলেছে।
ফলে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি হল কি না, তা যাচাইয়ের একটা সুযোগ বামেদের সামনে এসেছিল। কিন্তু সিপিএম চ্যালেঞ্জটা নিল না। উল্টে সিপিআই(এমএল)-এর সঙ্গে জোট করে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলল।
২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির ভোট কমে ২৩ শতাংশ, আর বামেদের বেড়ে ১৩.২ শতাংশ হয়েছিল। পূর্ব বর্ধমান জেলায় আবার বামেরা ছিল বিজেপির থেকে অনেকটা এগিয়ে। ভোট বৃদ্ধিতে খুশি সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ শমীক লাহিড়ী দলীয় মুখপত্রে লিখেছিলেন, ‘দম ধরে রাখতে হবে, খেলা ঘুরছে।’ খেলা ঘোরানোর একটাই ফর্মুলা, রামে যাওয়া ভোট বামে ফেরানো। তারজন্য দরকার ছিল বিজেপি বিরোধী আক্রমণ তীব্র করা। কিন্তু সিপিএম সে রাস্তায় না হেঁটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লাগাতার আক্রমণ করে বিজেপিরই সুবিধে করে দিয়েছে।
বঙ্গ বিজেপি বুঝেছে, সিপিএমের ভোট আরও টানতে না পারলে তৃণমূলকে টেক্কা দেওয়া অসম্ভব। আর রামের ভোট বামে ফিরলে তো সর্বনাশ। তাই আর জি কর ইস্যুতে বামেদের মিছিলে ভিড় বাড়তেই সিপিএমকে আক্রমণ তীব্র করেছে বিজেপি। সিপিএমের হিন্দু ভোটকেই তারা টার্গেট করেছে।
২০১১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে বামফ্রন্টকে উৎখাত করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই কংগ্রেসের সঙ্গেই ২০১৬ সালে জোট করেছিল সিপিএম। সেটা বামপন্থায় বিশ্বাসী শিক্ষিত লোকজন মানতে পারেননি। পরবর্তীতে কংগ্রেস এবং সিপিএম যৌথভাবে কর্মসূচি নেওয়ায় জোটের ভিত মজবুত হতে থাকে। উভয় দলের কর্মীদের মধ্যে বোঝাপড়াও তৈরি হয়। ঠিক তখনই ফাটল ধরল বাম-কংগ্রেস জোটে। উপ নির্বাচনে কংগ্রেসকে ছেড়ে নকশালদের হাত ধরল সিপিএম। তাতে বাংলার রাজ্য-রাজনীতিতে জন্ম হল এক নতুন সমীকরণের।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শুভঙ্কর সরকারকে প্রদেশ সভাপতি করাতেই কি সিপিএম বুঝে গিয়েছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসকে তারা আর পাশে পাবে না! তাই কি তারা ‘ঠেকনা’ পাওয়ার আশায় নৈহাটির আসনটি নকশালদের ছেড়ে দিল? নাকি এর পিছনে আছে অন্য অঙ্ক?
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই সিপিএম নানাভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চাপে ফেলার চেষ্টা করেছে। তারজন্য নীতি বিসর্জন দিয়ে কখনও কংগ্রেসের, কখনও আইএসএফের হাত ধরতে কুণ্ঠা করেনি। তবে, তাতে কোনও লাভ হয়নি। কিন্তু আর জি কর ইস্যুতে এই প্রথম তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কিছুটা হলেও বেগ দিতে সক্ষম হল। আর সেটা হয়েছে অতিবামেরা তাদের পাশে থাকায়। অতিবামেরা পাশে ছিল বলেই উৎসবের মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ও ‘দ্রোহের কার্নিভাল’ করার আগুনে ফুঁ দেওয়ার বল পেয়েছে।
ইতিহাস বলছে, সিপিএম যখনই কোণঠাসা হয়েছে, তখনই ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যাকে প্রয়োজন মনে করেছে, তার সঙ্গেই হাত মিলিয়েছে। নীতিনৈতিকতার ধার ধারেনি। ১৯৯৮ সালে ‘গণরোষে’র জেরে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলির বিস্তীর্ণ এলাকার দাপুটে সিপিএম নেতারা গ্রামছাড়া হয়েছিলেন। পুলিস অনেক চেষ্টা করেও গ্রামের দখল ফিরিয়ে দিতে পারেনি। শেষপর্যন্ত ২০০০ সালে মাওবাদী ও পুলিসের যৌথ প্রচেষ্টায় গ্রামের দখল নিয়েছিল সিপিএম। শর্ত ছিল, গড়বেতার সন্ধিপুর অঞ্চলে নকশালদের সংগঠন করতে দেবে সিপিএম। যদিও সেই শর্ত পরে সিপিএম মানেনি। তারজন্য উভয়ের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়। পরবর্তীতে জঙ্গলমহল অশান্ত হওয়ার কারণ নাকি সেটাই বলে অনেকে মনে করেন।
এই উপ নির্বাচনের ফলের উপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে না। তবে, এই উপ নির্বাচন ছাব্বিশে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোটের জল্পনা উস্কে দিয়েছে। অনেকেই মনে করছে, সিপিএমের হাত ছেড়ে দেওয়ায় ছাব্বিশে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে আর বাধা রইল না। তবে, এরপরেও
সিপিএম ফের কংগ্রেসের হাত ধরে ছাব্বিশে শূন্যের গেরো কাটাতে চাইলে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার অবশিষ্টটুকুও থাকবে না।
তৃণমূল এ রাজ্যের ক্ষমতায় টানা প্রায় ১৩ বছর রয়েছে। কেন্দ্রের ক্ষমতায় বিজেপি রয়েছে প্রায় সাড়ে দশ বছর। ক্ষমতায় থাকলে নানা কারণে শাসক দলের বিরুদ্ধেই অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর কাজ করে। এ রাজ্যে বহু মানুষেরই উভয় দলের বিরুদ্ধেই ক্ষোভ রয়েছে। তাঁরা শাসক হিসেবে কোনও দলকেই হয়তো চান না। কিন্তু তাঁদের সামনে বিকল্প নেই। তাঁরা মনে করেন, বামেদের ভোট দেওয়ার অর্থ ভোট নষ্ট করা। তাই বিজেপির উপর যাঁরা বিরক্ত তাঁরা বাধ্য হয়ে তৃণমূলকে ভোট দেন। আবার তৃণমূলের উপর ক্ষুব্ধরা বিজেপিকে ভোট দিতে বাধ্য হন। এই পরিস্থিতিতে সিপিআই(এমএল) কি আস্থার জায়গাটা তৈরি করতে পারবে? পারলে বাংলার রাজনীতির চাকা হয়তো অন্যভাবে ঘুরবে।
সিপিএমের মতো সিপিআই(এমএল)-এর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাপারে ছুঁতমার্গ নেই। সিপিআই(এমএল)-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য নানা ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করেছেন। জাতীয় রাজনীতিতে সিপিএম সবসময় তৃণমূলকে বাইরে রাখার পক্ষে। কিন্তু দীপঙ্করবাবু বারবার বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে আক্রমণের অভিমুখ ঘোরানো হোক ‘বড় বিপদ’ বিজেপির দিকে। কিন্তু সিপিএম সব সময় তাঁর এই লাইনের বিরোধিতা করেছে।
সীতারাম ইয়েচুরি বলেছিলেন, ‘কেউ যদি বলেন, বিজেপিকে পরাস্ত করতে গেলে তৃণমূল সহ সকলকে নিয়ে চলতে হবে, সেটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।’ এ হেন সিপিএম উপ নির্বাচনে আসন সমঝোতা করল সিপিআই(এমএল)-এর সঙ্গে। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা তো দূরের কথা, সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলেও তাদের ‘ঠেকনা’ লাগে। কংগ্রেস সরে যাওয়ায় সিপিআই(এমএল)কে ‘ঠেকনা’ বানাতে চাইছে সিপিএম।
তবে, নকশাল শব্দটি বাংলার আম জনতা খুব একটা পছন্দ করে না। কারণ এখনও অনেকে মনে করেন, নকশাল মানেই খুনোখুনি। বিশৃঙ্খলা, হটকারিতা... আরও অনেক কিছু। তবে, তা সবটাই শোনা ও বইয়ে পড়া। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এই প্রজন্মের নেই। ফলে নাক সিঁটকানো থাকলেও সক্রিয় বিরোধিতার জায়গাটা তৈরি হয়নি। উল্টে অতিবামের প্রতি যুবসমাজের একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। তার উপর রাজ্যপাট না চালানোয় ক্ষমতায় থাকার ‘কাদা’ তাদের গায়ে নেই। সেটা জনসমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে সিপিআই(এমএল)-এর একটা বাড়তি সুবিধা।
সিপিএম নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণেই বাংলায় বিজেপি আজ প্রধান বিরোধী দল। তা সত্ত্বেও রাজ্যের বহু শিক্ষিত ও গরিব মানুষ বামপন্থায় বিশ্বাসী। কিন্তু তাঁরা দিশেহারা। নেতৃত্ব প্রদানে যোগ্যতার প্রমাণ দিলে তাঁদের সমর্থন যাবে সেদিকেই। তাতে বদলাতে পারে পরিস্থিতি। ২০২০ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমকে অনেকটাই পিছনে ফেলে দিয়েছে সিপিআই(এমএল)। বাংলাতেও কি তারা সেই লক্ষ্যেই এগতে চাইছে? উদ্দেশ্য সেটা হলে বলতেই হবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টাইট দিতে গিয়ে সিপিএম নিজেদের সর্বনাশের রাস্তাটা নিজেরাই তৈরি করে দিল।