সমস্যার সাগরে হাবুডুবু খেয়েও যাঁরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে চেয়েছেন, দেবীপক্ষে রইল তাঁদেরই কথা।
পৌরাণিক যুগে, সুরথ রাজা এবং সংসারে বীতশ্রদ্ধ সমাধি নামক বৈশ্যর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দেবী বর দিয়েছিলেন— যখনই সমস্যায় পড়ে ডাকবে, আমি আবার আসব এবং শত্রুনাশ করব। রামচন্দ্রও মহাবিপদে পড়ে তাঁকে ডেকেছিলেন। সেটি ছিল দেবতিথির বিচারে ‘অকাল’। যখনই বিপদ ও সমস্যার মেঘ ঘনায়, সেই তো অকাল। দেবী তো তাঁকে ডাকার কোনও কাল নির্দিষ্ট করেননি। প্রয়োজনে স্মরণ করলেই তিনি আসবেন বলে কথা দিয়েছেন। পুরাণ থেকে আরম্ভ করে ইতিহাসের সরণি বেয়ে আধুনিক যুগ পর্যন্ত লক্ষ করলে দেখতে পাব, দুর্গা এসেছেন বারবার— সমস্যার সাগরে হাবুডুবু খেয়েও যাঁরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে চেয়েছেন, সেই সমস্ত হৃদয়ে সাহস রূপে, মনে দুর্জয় শক্তি রূপে। সাধারণের ভিড়ে মিশে থাকা এযুগের এমনই কয়েকজন ‘অ-সাধারণ’ দুর্গার কথা শোনাব।
পশ্চিমবঙ্গের এক অখ্যাত গ্রামের চাষি পরিবারের মেয়ে সুবাসিনী। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে, আর ২৩ বছর বয়সেই চারটি সন্তানের মা। স্বামী সব্জি বিক্রেতা। অভাবের সংসার। স্বামী পড়লেন কঠিন অসুখে। সরকারি হাসপাতালে বেড-এর অভাবে ভর্তি করানো গেল না। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো সাধ্যের বাইরে। একরকম বিনা চিকিৎসায় স্বামী মারা গেলে চারটি সন্তান নিয়ে অকূল পাথারে পড়লেন ২৪ বছরের তরুণী বিধবা সুবাসিনী। এই দুঃসময়ে সাহায্য করতে পারে, এমন কেউ নেই। বাধ্য হয়ে কোলের ছেলেটিকে রেখে বাকি তিনটি সন্তানকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিলেন। বাঁচার তাগিদে লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে, ধাপার মাঠে ময়লা ঘেঁটে কয়লা তুলে, পথের ধারে সব্জি বেচে চলল অমানুষিক লড়াই। ২০ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে জমা হল পিঁপড়ের সঞ্চয়— ২০ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে কিছু বেসরকারি সংস্থার সাহায্য নিয়ে ছেলে অজয়কে ডাক্তারি পড়িয়েছেন। এত বছরের লড়াই একটা হাসপাতাল করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে—তাঁর স্বামীর মতো আর কোনও গরিব মানুষকে যেন বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারাতে না হয়। ঠাকুরপুকুর বাজার লাগোয়া হাঁসপুকুরে ১০ হাজার টাকায় কিনে ফেললেন ১৯ কাঠা জমি। কিন্তু দরকার আরও অর্থ। প্রথমে তাঁর কথায় কেউ গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু ততদিনে লড়াকু বৃদ্ধা সুবাসিনীর অন্তরে ‘দুর্গা’ জাগ্রত হয়েছেন। ধানজমিতে কোমরজল ঠেলে মাথায় মাটি বয়ে জমি ভরাট করার কাজ শুরু করে দিলেন নিজেই। এরপর আশপাশের মানুষ এগিয়ে এল, তৈরি হল ট্রাস্ট। কেউ অর্থ দিয়ে, কেউ মাটি, কাঠ ইত্যাদি কাঁচামাল দিয়ে সাহায্য করল। গড়ে উঠল ৪৫ শয্যার ‘হিউম্যানিটি হসপিটাল’, এখানে গরিব রোগীদের চিকিৎসা, ওষুধে কোনও টাকা লাগে না। আইসিসিইউ, ভেন্টিলেশন, আউটডোর ছাড়াও মেডিসিন, সার্জারি, গাইনোকোলজি, আই, ইএনটি, ইউরোলজি, পেডিয়াট্রিক, ইউরোলজি-সহ একাধিক বিভাগ রয়েছে। ডাক্তার ছেলে এসে দাঁড়িয়েছেন মায়ের পাশে। স্বেচ্ছাশ্রম দেন অজয়ের বন্ধুরাও। পদ্মশ্রী ও অন্যান্য পুরস্কারে সম্মানিতা সুবাসিনী যেন জ্যান্ত দুর্গারই এক রূপ।
আবার ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ অঞ্চলে সবুজ গাছগাছালি ঘেরা গ্রামের কৃষক পরিবারের মেয়ে যমুনা টুডু। ফসলখেতে বীজ থেকে মাথা তোলা নবীন অঙ্কুর তাঁর কাছে সদ্যোজাত শিশুর মতোই স্নেহের। শৈশব থেকেই গাছপালা ও পরিবেশের প্রতি এই মমতার বোধ মনে গেঁথে দিয়েছিলেন বাবা। ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে চাকুলিয়া ব্লকের মুতুরখাম গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে আসেন। পরদিনই স্বামী তাঁকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাতে বেরলে যমুনা লক্ষ করলেন, সম্পূর্ণ বৃক্ষশূন্য একটি বন। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, চোরাকারবারিরা ইচ্ছেমতো কাঠ কেটে নিয়ে যায়। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। সেইদিনই বন-সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিলেন। একটি তরুণীর পক্ষে এত বড় দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সহজ ছিল না। কিন্তু শুভ সংকল্পে অন্তরের দুর্গা জেগেছিল। প্রথম দিকে কেউই তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনেক বুঝিয়ে পাঁচটি মেয়েকে রাজি করিয়ে গঠন করলেন বন-সুরক্ষা সমিতি। শুরু হল কাটারি, কাস্তে, কুঠার ইত্যাদি নিয়ে বন পাহারা দেওয়ার কাজ। তার মাশুলও দিতে হয়েছে। বাড়ির লোকেদের শাসিয়ে যাওয়া, বাড়িতে ডাকাতি, এমনকি যমুনার স্বামীকে প্রচণ্ড মারধর পর্যন্ত করেছিল গুন্ডারা। কিন্তু কিছুতেই দমে যাননি যমুনা। জীবনদায়ী অরণ্যকে বাঁচানোর জন্য তাঁর এই অদম্য সাহস ও সদিচ্ছা দেখে ক্রমে গ্রামের আরও মেয়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াতে আরম্ভ করে। ধীরে ধীরে আশপাশের ৩০০টি নগরের প্রায় ১০ হাজার মেয়ের একটা বন-রক্ষক দল গড়ে ওঠে। ১৯৯৮ সাল থেকে আরম্ভ করে গত ২৫ বছর ধরে যমুনার নেতৃত্বে পূর্ব ভারতের প্রায় ৫০ হেক্টর অরণ্য সংরক্ষণ করেছেন গ্রামের মহিলারা। একটা সময় ছিল, যখন যাতায়াতের পথে দুর্বৃত্তরা ঢিল ছুঁড়ত, ওদের ঠেকাতে হাতে টাঙি বা কুঠার তুলে নিতে হতো। ‘প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যমুনা বলেন, আশপাশের কোনও গ্রামে কোনও মেয়ের জন্ম হলে তাঁরা সব গ্রামে একটি করে গাছ লাগান। ভালোবেসে ভাইয়ের মতো গাছে বেঁধে দেন রাখি। এতে পরিবেশের সঙ্গে মানুষের একটা আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে। ২০১৯ সালে পদ্মশ্রী-সহ নানা পুরস্কার দিয়ে এই নিরলস নির্ভীক দুর্গাকে সম্মান জানানো হয়েছে। যমুনার গল্পও যেন দুরাচারী অসুর দমন করে দুর্গা হয়ে ওঠারই আখ্যান!
ময়ূরভঞ্জ ছাড়িয়ে এবার লখনউ। এখানকার আম্বেদকর নগরের মেয়ে অরুণিমা সিনহা। খেলাধুলো ভালোবাসতেন। ভলিবল খেলতেন। প্যারামিলিটারি ফোর্স জয়েন করার জন্য ইন্টারভিউ দিতে ১২ এপ্রিল ২০১১ দিল্লি রওনা হয়েছিলেন। ট্রেনে একদল দুর্বৃত্ত ওঁর ব্যাগ ও সোনার চেন ছিনতাই করতে আসে। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে ওরা তাঁকে চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। এই সময় উল্টোদিক থেকে আসা আর একটি ট্রেন প্রচণ্ড আঘাতে অরুণিমার পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল! কাটা পড়ল হাঁটুর নীচ থেকে একটি পা। তাঁর অচৈতন্য দেহ সারারাত লাইনের উপর পড়ে রইল। পরদিন সকালে স্থানীয় লোকজন সংজ্ঞাহীন অরুণিমাকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে এল। রেল কোম্পানি ও ভারতীয় ক্রীড়া মন্ত্রক ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল, সঙ্গে চাকরির প্রস্তাবও। দিল্লি এইমস বিনা খরচে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে এবং দিল্লির এক বেসরকারি সংস্থা একটি কৃত্রিম পা (প্রস্থেটিক লেগ) দান করে তাঁকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করেছে। কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত ধনরত্ন দিয়েও মানুষের জীবন, অঙ্গ বা সম্মানহানির মূল্য দেওয়া যায় না। যে অবস্থায় পড়ে নিরাশার অন্ধকারে ডুবে গিয়ে মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারে, সেই অবস্থাতেই অরুণিমা এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন দেখলেন! আশ্চর্য হলেও সত্যি।
এভারেস্ট জয়ী প্রথম ভারতীয় মহিলা বাচেন্দ্রী পালের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন অরুণিমা। তাঁর কাহিনী শুনে বাচেন্দ্রী বলেছিলেন, ‘কৃত্রিম পা নিয়ে যে তুমি এভারেস্টেআরোহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছ, জেনে রাখো, তুমি পৌঁছেই গেছ। শুধু তারিখটা জগতের জানার অপেক্ষা!’
সেই ভয়ানক দুর্ঘটনার দু’বছর পর, ২১ মে, ২০১৩, অরুণিমা স্পর্শ করেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শিখর, মাউন্ট এভারেস্ট। একটি কাপড়ের উপর ভগবান শিব ও স্বামী বিবেকানন্দের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা লিখে বরফের উপর বিছিয়ে দিয়েছিলেন।
এখন তাঁর স্বপ্ন বিশ্বের সব ক’টি উচ্চতার শিখর ছুঁয়ে দেখার। অটুট মনোবলের অধিকারিণী এই তরুণীকে ২০১৫ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয়। দরিদ্র ও বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ‘শহীদ চন্দ্রশেখর খেল একাডেমি’ নামে একটি অবৈতনিক স্পোর্টস একাডেমি গঠনের সংকল্পে মনপ্রাণ নিয়োজিত করেছেন অরুণিমা।
এগুলো রূপকথা নয়। ভীড়ের মধ্যে মিশে আছে এমনই অনেক দুর্গার মুখ,আমাদেরই আশপাশে। কারও লড়াই জানতে পারি, কেউ থেকে যান লোকচক্ষুর অগোচরে। আজ থেকে শতাধিক বছর আগে, নিশ্চিত যুগ প্রয়োজনেই, শ্রীরামকৃষ্ণ ষোড়শী পূজার মাধ্যমে সারদা দেবীর দেহ-মন অবলম্বন করে মহাশক্তির উদ্বোধন করে গিয়েছিলেন। ধীরে ও নিঃশব্দে পুঞ্জীভূত হয়ে বিশ্বের সর্বত্র, প্রতিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে সেই শক্তিস্বরূপিণীর এক একটি কিরণ। শারদীয়া উৎসবে আমরা মৃন্ময়ীতে চিন্ময়ীর আবাহন করি। যে নিজ অন্তরে সেই মহাশক্তির আবাহন করবে, সে-ই হয়ে উঠবে জ্যান্ত দুর্গা। জাগো দুর্গা, প্রতি ঘটে। ‘প্রাপ্য বরান্ নিবোধত’— তোমার লক্ষে না পৌঁছে থেমো না।
সুমনা সাহা