মহাভারত ও রামায়ণ। দুই মহাকাব্য। ভারতীয় সনাতন সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতির এক চিরন্তন উপাখ্যান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর বহু অনুবাদ, ভাবানুবাদ হয়েছে। সবই পরিণত মনস্কদের জন্য। কিন্তু, শিশুরা বাদ যায় কেন! এগিয়ে এলেন অনেকেই। অগ্রণী ভূমিকায় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। বাল্মীকি রামায়ণ ও ব্যাসদেবের মহাভারতের মূল ভাবনা, নির্যাস শিশু মনোপযোগী ও মনোগ্রাহী করে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলেন তিনি। জন্ম নিল ‘ছোট্ট রামায়ণ’, ‘ছেলেদের রামায়ণ’ ও ‘ছেলেদের মহাভারত’। তবে বলে রাখা ভালো, এখানে ‘ছেলে’ বলতে শিশুদের কথা বলা হয়েছে। গদ্য ও পদ্য—দুই আঙ্গিকেই রামায়ণকে তুলে ধরেছিলেন তিনি। ভাষাবিদদের বক্তব্য, আদ্যন্ত সাধু ভাষায় লেখা হলেও উপেন্দ্রকিশোরের গদ্য ছিল অত্যন্ত সরল ও সতেজ। ফলে শিশুদের পড়তে এবং তা আত্মস্থ করতে কখনও কোনও সমস্যায় পড়তে হয়নি। লেখনির এই সারল্য আরও বেশি করে ধরা দিয়েছে ‘ছোট্ট রামায়ণ’ বইটিতে। আদিকাণ্ডে তাড়কা রাক্ষসীর আক্রমণের বিবরণে বিখ্যাত এই শিশু সাহিত্যিক লিখেছেন, ‘হাঁই-মাঁই-কাঁই’ করি ধাঁই-ধাঁই ধায়,/ হুড়মুড়ি ঝোপঝাড় চুরমারি পায়।/ গরজি-গরজি বুড়ি ছোটে, যেন ঝড়,/ শ্বাস বয় ঘোরতর ঘড়র-ঘড়র। / কান যেন কুলো তার, দাঁত যেন মূলো।/ জ্বল-জ্বল দুই চোখে জ্বলে যেন চুলো।/ হাঁ করেছে দশ গজ, তাহে জিভ খান/ লকলকে চকচকে, দেখে ওড়ে প্রাণ।’ বর্ণনায় কোথাও কোনও মহাকাব্যিক গাম্ভীর্য নেই। শিশুদের চেনা রূপকথার রাক্ষসীকেই শব্দের সৌন্দর্যে জীবন্ত করে তুলেছেন উপেন্দ্রকিশোর। একইভাবে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে ভরতের সেনাবাহিনীর আহারেও স্থান পেয়েছে বাংলার মিষ্টি, বাঙালির খাবার। অযোধ্যা কাণ্ডে তিনি লিখেছেন, ‘ঘোল, চিনি, ক্ষীর, সর, দধি, মালপুয়া, রাবড়ি, পায়েস, পিঠা, পুরী, পানতুয়া।’ এখানেও সেই মহাকাব্যিক জটিলতা এড়িয়ে চেনাপরিচিত রসেই শিশুদের সিক্ত করেছেন কালজয়ী কবি। যাতে সহজেই খুদেদের মনে ধরা দেয় মহাকাব্যের কাহিনি।