নিজস্ব প্রতিনিধি, নয়াদিল্লি: শেষ কবে এভাবে কোনও ইস্যুতে দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে গোটা বিশ্ব? শেষ কবে পশ্চিমি দুনিয়ায় সম্পূর্ণ একঘরে এবং চরম সমালোচিত হয়েছে সর্বশক্তিমান আমেরিকা? মনে করতে পারছেন না আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা। নয়ের দশকের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় জর্জ বুশ সমালোচিত হলেও বহু পশ্চিমি বন্ধুকে পেয়েছিলেন পাশে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি একেবারে আলাদা। শুক্রবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে আলোচনা এবং চুক্তির জন্য ডেকেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট। আর সেখানে তাঁরা যে ভাষায় হুমকি দিয়েছেন, অপমান করেছেন জেলেনস্কিকে, সেটাই নিমেষের মধ্যে গোটা ইউরোপকে যেন জোটবদ্ধ করে দিল মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।
গোটা ঘটনায় বিশ্ব কূটনীতি এবং ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের ভারসাম্য এতই টালমাটাল যে, ন্যাটো গোষ্ঠী ভাঙনের মুখে। ফ্রান্স থেকে স্পেন, জার্মানি অথবা পোলান্ড, ডেনমার্ক, চেক রিপাবলিক, ফিনল্যান্ড কিংবা ইতালি— প্রত্যেকেই ট্রাম্প বনাম জেলেনস্কির তর্কবিতর্কের ঘটনায় সম্পূর্ণভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে ইউক্রেনের। এই বিপুল সমর্থনে আপ্লুত জেলেনস্কি। শনিবার ইওরোপীয় ইউনিয়নকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘আমরাও শান্তি চাই। কিন্তু সম্মান বিসর্জন দিয়ে নয়। আমাদের সম্মান দিতে হবে। কারণ, আমরা আক্রমণকারী নই, আক্রান্ত।’ ঠিক এই আবহে এদিন আমেরিকার সবথেকে বিশ্বস্ত এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত স্থায়ী বন্ধু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি।
শুধুই কি অন্য দেশ বা ট্রাম্পের বিরোধীরা সমালোচনায় সরব? একেবারেই নয়। আমেরিকা, এমনকী স্বয়ং ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টিতে পর্যন্ত বিভাজন এই ঘটনায়। দলের নেব্রাস্কার প্রতিনিধি ডন বেকন চরম ক্রুদ্ধ। বলেছেন, ‘রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে এটা ছিল শ্রেষ্ঠ একটি দিন। কারণ, দু’জন অনুগত ভৃত্যকে তিনি পেয়ে গেলেন। তাঁদের নাম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স। যেভাবে এই দু’জনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে ঘরে ডেকে নিয়ে এসে সর্বশক্তি দিয়ে অপমান করলেন, সেটা পুতিনের কাছে বিরাট উপহার। আর আমেরিকার বিদেশনীতির পক্ষে এক কালো দিন।’ মার্কিন মুলুকজুড়েও ঝড় উঠেছে। ডেমোক্র্যাট সেনেটর চাক শ্যুমার বলেছেন, ‘অতিথি হিসেবে আসা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যেভাবে বিশ্বের মালিকসুলভ ভাষায় কথা বলেছেন ট্রাম্প এবং ভান্স, সেটা মার্কিন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ভেঙেচুরে খান খান করে দিল।’
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ বলেছেন, ‘আমাদের কাছে রাশিয়া আক্রমণকারী ছিল, আছে, থাকবে। আমরা ইউক্রেনের পাশে আছি।’ পোল্যান্ড, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড প্রকাশ্যে বলেছে, ‘প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি আপনি একা নয়। আমরা আছি।’ জার্মানি কনজারভেটিভ পার্টির বক্তব্য, ‘আক্রান্ত এক দেশের প্রেসিডেন্টকে নিজের দেশে ডেকে এনে পিছন থেকে ছুরি মারা! এর থেকে ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে?’ গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ভারত সফরে আসা ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভ্যান ডারও সাহস জুগিয়েছেন জেলেনস্কিকে। সাফ বলেছেন, ‘ইউক্রেন সাহস রাখুক। আমরা পাশে আছি।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দুনিয়ায় এই প্রথম পৃথিবীর ক্ষমতার সমীকরণ আমূল বদলে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য জোটবদল! একদিকে ইউরোপ এবং অন্যদিকে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন। কোনদিকে যাচ্ছে পৃথিবী? কোনদিকে থাকবে এশিয়া? উত্তর জানা যাবে শীঘ্রই।