এক বৈশাখে
প্রদীপ দে সরকার: প্রসাদি থালা হাতে ঠাকুরঘর থেকে নামার সময় সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে হঠাৎই ব্যালান্স হারিয়ে পড়ে গেল মানসী। ঠিক পড়ল না, পড়তে পড়তেও সিঁড়ির রেলিং ধরে ফেলায় পতন খানিকটা স্লো মোশানে হল। তবে মানসী চিৎকারে কোনও খামতি রাখল না। রান্নাঘর থেকে সরমা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ছুটে এল। জিষ্ণুও নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
মেঝেতে থেবড়ে বসে মানসীকে সুর করে কাঁদতে দেখে সরমাও গলা মিলিয়েছিল কিন্তু জিষ্ণুর হালকা ধমকে দু’জনকেই থামতে হল। জিষ্ণুর কাঁধে ভর দিয়ে একটা চেয়ারে এসে বসল মানসী। জিষ্ণু জিজ্ঞেস করল, ‘ঠিক কোথায় কোথায় লেগেছে বল তো? হাঁটতে পারছ যখন পায়ে হয়তো তেমন বড় কিছু হয়নি। কোমরে লেগেছে?’
মানসী এখন খানিকটা ধাতস্থ হয়েছে। বলল, ‘না রে, হাঁটার সময় হাঁটুটা একটু কটকট করছিল। আর কোমরটাও টনটন করছে। আর, আর...’। মানসী ভাবার চেষ্টা করে।
মানসীকে আর বেশি ভাবতে না দিয়ে জিষ্ণু বলল, ‘মা, তোমার হাঁটু আর কোমরের ওই কটকট টনটন সারা বছরই থাকে। যাক, ভাগ্য ভালো যে বড় কোনও চোট পাওনি। কতবার বলেছি সিঁড়ি দিয়ে এত ওঠানামা কোরো না। কিন্তু কারও কথা শুনলে তো! দিনে দশবার ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠছ আর নামছ। এত ঠাকুর ঠাকুর কর কেন? দিল তো আছাড় মেরে ফেলে’।
মানসী নিজের ব্যথা ভুলে ধমক দেয় ছেলেকে, ‘আমি ঠাকুর ঠাকুর করি বলেই এখনও সবাই ভালো আছিস। আজ পয়লা বৈশাখ, সকালে চান করে একটু পুজো না দিলে হয়? সারাটা বছর ...’। কথা বলতে বলতেই মানসী হঠাৎ থেমে যায়।। জিজ্ঞেস করে, ‘হ্যাঁ রে, তোর বাবাকে দেখছি না তো? ঘরে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল অথচ তার দেখা নেই কেন রে? নাকি আমি পড়ে-ধরে মরলে বাঁচে।’
বড় কিছু ঘটেনি দেখে বোধহয় খানিকটা নিরাশ হয়েই সরমা এর মধ্যে রান্নাঘরে ফিরে গিয়েছিল। সেখান থেকেই উত্তর দিল, ‘সে কী! তুমি জানতে না দাদাবাবু বেরবে? তুমি ঠাকুর ঘরে যাওয়ার পরে পরেই ধুতি পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে গেল। কী সাজ দিয়েছে গো বউদি। সোনালি পাড়ের কালো ধুতি আর ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি’।
মানসী তার কোমরের টনটন, হাঁটুর কটকট সব ভুলে উঠে দাঁড়াল। ছেলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই জিষ্ণু বলল, ‘হ্যাঁ, আমাকে বলে গেল তো, তোর মাকে বলে দিস বেলা করে ফিরব’।‘কোথায় গেল কিছু বলেনি?’ জিষ্ণু ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ে। মানসী খেঁকিয়ে উঠল, ‘বাপ সেজেগুজে বেরচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে সেটাও জানার প্রয়োজন মনে করিস না তুই?’রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে সরমা বলল, ‘সিঁথি’।
মানসী অবাক হয়ে তাকালো সরমার দিকে। ‘তুই কী করে জানলি? তোকে বলেছে?’
সরমা রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, ‘আমাকে বলবে কেন? আমি যখন সকালের চা দিতে গেলাম তখন তো দাদাবাবু ফোনে কথা বলছিল। বলল, সিঁথির মোড়ে পৌঁছে ফোন করে নেব’।
জিষ্ণু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে মাসি? বাবা ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছে তুমি তা আড়ি পেতে শুনতে যাচ্ছ কেন? ভেরি ব্যাড ম্যানার্স।’
মানসী খেঁকিয়ে ওঠে, ‘রাখ তোর ম্যানার্স। হ্যাঁ রে, কার সঙ্গে কথা বলছিল জানিস?’
জিষ্ণু বিরক্ত হয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দেয়। সরমা প্রায় ফিসফিসিয়ে, রহস্যময় গলায় বলে, ‘একজন মেয়ে মানুষের ফোন গো। তবে বাবা, আমি আর কিছু বলব না। তোমার ছেলে আবার রেগে যাবে’।
এই কথাগুলো মারাত্মক। অনেকটা থ্রিলার ওয়েব সিরিজের এক একটা পর্বের শেষ দৃশ্যের মতো। পরের পর্ব না দেখা পর্যন্ত শান্তি নেই। এই মুহূর্তে সরমার পুরো কথা না শোনা পর্যন্ত শান্তি নেই মানসীর। ধমকে বলল, ‘জিষ্ণুকে নিয়ে ভাবতে হবে না, তুই যা জানিস আমাকে বল’।
সরমা এবার আরও এগিয়ে আসে। তারপর চোখেমুখে এবং কণ্ঠস্বরে আরও রহস্য মাখিয়ে বলে, ‘দাদাবাবু তো কানে তার গুঁজে ভিডিও কল করছিল। আমি একঝলক দেখেছি। কী দেখতে গো বউদি। লাল পাড় জামদানি পড়েছে আর কপালে এত্তবড় একটা লাল টিপ। অনেকটা লিলি চক্রবর্তীর মতো দেখতে।’
মানসীর মনে মেঘ জমে। ক’দিন ধরে লক্ষ করছে বিশেষ কোনও একটা ফোন ধরতে সঞ্জয় বারান্দায় চলে যায়। তারপর নিচু গলায় কথা বলে, কথা বলতে বলতে হাসে। সব লক্ষণ একেবারে দু’য়ে দু’য়ে চারের মতো যে মিলে যাচ্ছে। সে শঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘বুড়ি লিলি না জোয়ান লিলি?’
‘জোয়ান নয়, আবার তেমন বুড়িও নয়। এই তোমার মতন।’
মানসী ফোনে ধরার চেষ্টা করে সঞ্জয়কে। ফোন সুইচড অফ। মানসীর মনে হল সঞ্জয় নিশ্চয় গাড়ি নিয়েই বেরিয়েছে। তাহলে তো রতন আছে সঙ্গে। রতনকে ফোনে পাওয়া গেল এবং জানা গেল ওরা সিঁথিতেই আছে।
রতনের কাছে আরও জানা গেল, ‘কাকাবাবু বলল, বুঝলি রতন সেই কলেজের বান্ধবী আমার। এত দিন পর আজ পয়লা বৈশাখে তার বাড়ি যাচ্ছি, ভালো মিষ্টি নিয়ে যেতে হবে তো। তারপর বড় মিষ্টির দোকান থেকে এত্ত বড় হাঁড়ি ভর্তি রসগোল্লা আর বড় প্যাকেট ভর্তি দামি সন্দেশ কিনল। আমিই তো দোকান থেকে বয়ে আনলাম, আবার ওই বাড়িতে বয়ে নিয়ে গেলাম। ঠিক করেছি না কাকিমা? আমি থাকতে কাকাবাবু অত ভারী ভারী ওজন বইবে কেন?’
‘আদিখ্যেতা!’ বলে রাগে ফোন কেটে দেয় মানসী।
সরমা জিষ্ণুর ঘরের দিকে উঁকি মেরে দেখে নিয়ে মানসীর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ব্যাপারটা খুব একটা সুবিধের নয় গো বউদি। শুনলে তো কলেজে একসঙ্গে পড়ত। আমার মনে হচ্ছে দাদাবাবু প্রেমে পড়েছে। নইলে ওই বউটার সঙ্গে অমন মিষ্টি করে হেসে হেসে কথা বলবে কেন? আর আমি তো একবার আড় চোখে দেখলাম, বউটা মনে হল ফ্লাইং কিস দিল দাদাবাবুকে। ও পাড়ার অয়ন ঘোষাল, ওই যে গো টাক মাথা বুড়ো লোকটা, সেও তো নাকি এমনি করেই ভিডিও কল করত। তারপর একদিন সব জানাজানি হতে বউকে ডিভোর্স দিয়ে বাড়ি ছেড়েই চলে গেল। মনে নেই? এই তো গেল বচ্ছরের কথা।’
মানসী এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কাঁদ-কাঁদ মুখে কঁকিয়ে বলল, ‘কী বলছিস রে সরমা! আমার তো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে রে।’
‘তাহলে আর বলছি কী বউদি। নইলে বচ্ছরের প্রথম দিনেই তোমাকে না বলে কয়ে বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করার জন্য অমন ফসফস করে সেন্ট মেখে বেরিয়ে যায়?’
‘সে কী রে, সেন্ট মেখেছে আগে বললি না তো।’
‘সব কথা বলার আর সময় দিলে কোথায়?’
মানসী এবার কেঁদেই ফেলল। সরমা মানসীর হাত ধরে বলল, ‘এখন ভেঙে পড়ার সময় নয় গো বউদি। শক্ত হও। রিমঝিমদিকে একটা খবর দাও। ওরাও আসুক। তারপর সবাই মিলে একটা কিছু কর। আমার বোনের শ্বশুরবাড়ির ওদিকে ভালো বশীকরণের লোক আছে, মাচানবাবা। সকাল থেকে লোক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চাইলে তার কাছ থেকে একটা তাবিজ-কবচ আনিয়ে দিতে পারি। দেখবে ওসব ভূত মাথা থেকে নেমে যাবে।’
মানসী খানিকক্ষণ থম মেরে বসে থাকে। এ তো আর যেমন তেমন ভূত নয়, একেবারে শাঁখা-সিঁদুর পরা শাঁকচুন্নি। ঘাড় না মটকে কি নামবে? সঞ্জয় ওর থেকে বছর চারেকের বড় হলেও এখন আর বয়সের ফারাকটা বোঝা যায় না। বরং বেশ খানিকটা মুটিয়ে গিয়ে তার নিজের চেহারায় একটু বুড়োটে ছাপ পড়েছে। ওদিকে সঞ্জয়ের প্রায় ছ’ফুট হাইট, এখনও টানটান চেহারা। মাথা ভর্তি কাঁচা-পাকা চুল। যে কোনও পোশাকে মানানসই। আর ধুতি-পাঞ্জাবি পরলে বেশ একটা অভিজাত ভাব ফুটে ওঠে চেহারায়। মেজাজ ভালো থাকলে চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। সব মিলিয়ে মাঝ বয়সি যে কোনও মহিলাই সঞ্জয়ের প্রেমে পড়ে যেতে পারে। আবার এই বয়সে নাকি পুরুষ মানুষের প্রেমের ইচ্ছে নতুন করে জেগে ওঠে। আর ভাবতে পারছে না মানসী। জীবনের শেষ প্রহরে এসে কি এই ছিল পাওনা? তারপর আর কিছু ভাবতে না পেরে মেয়েকে ফোন করে। ‘শিগরিরি আয়, তোর আদরের বাপি ...।’ এরপর আর কিছু বলতে পারে না মানসী। আসলে কী বলবে ঠিক ভেবে পায় না। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
এমন ফোন পেলে যা হওয়ার তাই হল। রিমঝিমও ‘কী বলছ গো মা, বাপির সঙ্গে তো কাল রাত্তিরেও কথা হল,’ বলে কাঁদতে শুরু করে। পয়লা বৈশাখে অফিস ছুটি। তাই শৌর্যও বাড়িতেই ছিল। সে ছুটে এসে রিমঝিমের হাত থেকে ফোন তুলে নেয়। তারপর শাশুড়ি মাকে শান্ত করে সব কথা শোনে। ফোন স্পিকারে না থাকলেও পাশ থেকে রিমঝিম সবই শুনতে পাচ্ছে। প্রথমে সে সাংঘাতিক কিছু ভেবে ফেলেছিল। আস্তে আস্তে তার মুখ চোখ বদলাচ্ছে। ওদিকে শৌর্যর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে যেন মজা লুটছে। রিমঝিম ফোন কেড়ে নিয়ে মাকে বলল, ‘এসব কথা আমাকেই তো বলতে পারতে। জামাইকে বলার কী ছিল। এখন রাখ এক্ষুনি আসছি আমরা।’
শৌর্য এমন সুযোগ ছাড়বে কেন। বেশ রসিয়ে বলল, ‘তোমার বাপি তো খেলা জমিয়ে দিল গো। বাষট্টি বছরে পৌঁছে কলেজের বান্ধবীর সঙ্গে প্রেম। আহা কী রোমান্টিক! কী ইনস্পায়ারিং ক্যারেক্টার!’
রিমঝিমের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। কিন্তু বিশেষ কিছু বলতে পারছে না। ব্যাট ছাড়া ক্রিজে নেমে পড়ার মতো অবস্থা ওর। সব রাগ আছড়ে পড়ছে বেচারা তুতুলের ওপর। তিন বছরের তুতুল সদ্য গুছিয়ে কথা বলা শিখেছে। সে বলে, ‘আমি আবাল কী কলেছি?’
শৌর্য তুতুলকে কোলে তুলে নিয়ে গলা তুলে বলে, ‘তুমি কিছু করনি সোনা। যা করার তা তোমার দাদুভাই করছে। স্লগ ওভারে চালিয়ে খেলছে।’
চতুর্দিকের এত সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত জিষ্ণু। তার নিজের দু’বছরের প্রেমটা সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রায় কেটে গেছে। সিঞ্জিনী বিয়ের জন্য তাগাদা দিচ্ছিল। কারণ বাড়িতে নাকি চাপ বাড়ছে। কিন্তু জিষ্ণু বাড়িতে জানানোর জন্য আর একটু সময় চাইছিল। শৌর্যদাকে শুধু জানিয়েছিল। শৌর্যদা বলেছিল, ‘এত তাড়াহুড়োর কী আছে ব্রাদার। বাড়িতে না জানিয়ে প্রেম করা একটা দারুণ থ্রিলিং ব্যাপার, ঠিক ফ্রিজ থেকে চুরি করে মাখন খাওয়ার মতো। সবাইকে জানিয়ে-টানিয়ে বিয়ে করলেই তো সব শেষ। এই আমায় দেখছ না? লাইফ হেল হয়ে যাবে ভাই। প্রেম হল গিয়ে বসন্ত ঋতু, একটা ফুরফুরে ব্যাপার। আর বিয়ে হচ্ছে বসন্তের পরের স্টেজ, প্রখর গ্রীষ্ম, জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবে। যতদিন পার বসন্তে আটকে থাক।’ জিষ্ণুও তাই প্রেমপর্ব টেনে যাচ্ছিল। কিন্তু বেশি টানতে গিয়ে ছিঁড়েই গেল। শেষমেশ খেপে গিয়ে সিঞ্জিনী এখন আর কথাই বলছে না। এদিকে যা শোনা যাচ্ছে সব যদি সত্যি হয় তাহলে বাবা তার পুরনো প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করার জন্য পয়লা বৈশাখে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে পৌঁছে গেছে। এখন যা পরিস্থিতি নিজের বিয়ের বদলে বাপের বিয়ে না খেতে হয়।
রিমঝিমরা বাড়িতে ঢোকার মুখেই রতনের ফোন এল, দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে তিনি ফিরবেন। রতন জানাল, ‘কাকাবাবু আমাকেও এখানে খেয়ে নিতে বলছে।’
মানসী রাগে ফুটছে, ‘আমার শ্রাদ্ধতেও গিলিস হতভাগা। কিন্তু তোর কাকাবাবু নিজে ফোন না করে তোকে দিয়ে ফোন করাচ্ছে কেন?’
‘কাকাবাবুর ফোন তো খারাপ হয়ে গেছে। আর কাকাবাবু ফোন করবে কী। এ বাড়ির কাকিমণি, ওই যে গো কাকাবাবুর সঙ্গে কলেজে পড়ত, তার সঙ্গে গান গাইছে কাকাবাবু। কী সুন্দর গলা কাকাবাবুর! কেউ ছাড়তে চাইছে না। আরও কত লোক এসেছে এ বাড়িতে। উৎসব চলছে গো কাকিমা।’
মানসী ফোন কেটে দিয়ে নিজের মনেই গজগজ করতে থাকে, উঁ, কাকিমণির সঙ্গে গান গাইছে। এদিকে আমার সঙ্গে একটু হেসে কথাও বলতে পারে না। প্রেম একেবারে উথলে পড়ছে। আসুক বাড়ি। সরমাকে বলে, ‘তুই শিগগির তোর ওই মাচানবাবাকে খবর দে। এ বাড়িতে আসতে হবে, এক্ষুনি, যা লাগে লাগুক।’
শৌর্য রিমঝিমকে শুনিয়ে বলল, ‘বাবা বোধহয় একেবারে ফাইনাল করেই ফিরবে।’
বিকেলের মধ্যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মাচানবাবার জন্য ছাদে মাচা বাঁধা হয়ে গেছে। পাড়ার বোস গিন্নি কোত্থেকে খবর পেয়ে হাজির হয়েছে। মানসী নিশ্চিত, সরমাই খবর পাচার করেছে। ওর বোন বোস গিন্নির বাড়িতে কাজ করে। এ বাড়ির ব্রেকিং নিউজটা বোনের মাধ্যমেই লিক করিয়েছে। কিন্তু সরমাকে ধরা যাচ্ছে না, সে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
বোস গিন্নি হাতে করে একটা পুঁচকে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে এসেছে। প্যাকেটটা মানসীর হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘নতুন বছরে একটু দেখা করতে এলাম ভাই। তুমি নাকি সকালে পড়ে গিয়েছিলে?’ তারপর মানসীর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলতে থাকে, ‘দেখ, এই বয়সটা তো খুব খারাপ। কার যে কখন পা পিছলে যায় বলা মুশকিল।’
কথার ইঙ্গিত ধরতে অসুবিধে হয় না মানসীর। মনের রাগ মনেই চেপে রেখে ঠোঁটে হাসি লেপটে বলে, ‘তোমরা তো আছ, পড়ে গেলে একটু দেখ না হয়।’
সঞ্জয় হাসি মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরল শেষ বিকেলে। পিছনে মিষ্টির হাঁড়ি হাতে রতন। রাগে মানসীর গা জ্বলে যাচ্ছে কিন্তু বোস গিন্নি বসে থাকায় ফেটে পড়তে পারল না। সঞ্জয় নিজস্ব মেজাজে সোফায় গা এলিয়ে বসে বলল, ‘বুঝলে মানু, বিয়েটা একেবারে ঠিক করেই ফেললাম, এবার শুধু তারিখটা তোমরা ঠিক কর।’
মানসী থপ করে সোফায় বসে পড়েছে। রিমঝিম মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে, জিষ্ণু নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাপির কথা শুনে পুরো ভেবলে গেছে। একমাত্র বোস গিন্নির চোখে মুখে খুশির ঝিলিক, ‘কী বলছেন দাদা, এই বয়সে বিয়ে একেবারে ঠিক করে ফেললেন?’
সঞ্জয় ভারিক্কি স্বরে বলল, ‘এই বয়সেই তো মানুষ অভিজ্ঞতায় ভর করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়।’
মানসী ডুকরে কেঁদে ওঠে। শৌর্য বলে, ‘এত কান্নাকাটির কী আছে মা? বিয়ে ঠিক হয়েছে, শাঁখ বাজান, উলু দিন, সবাইকে মিষ্টি খাওয়ান।’
শৌর্য যে এতটা ফক্কড়ি করবে ভাবতে পারেনি রিমঝিম। ধমকে বলে, ‘কী অসভ্যতা করছ শৌর্য?’
সঞ্জয় মেয়েকে থামিয়ে বলে, ‘অসভ্যতার কী আছে? আজ বাদে কাল বিয়ে, বাড়িতে শাঁখ বাজবে না?’
শৌর্য এবার এগিয়ে আসে, ‘বাবা, অনেক নাটক হয়েছে, এরপর আর বাড়াবাড়ি হলে মায়ের হার্ট অ্যাটাক হবে। যতই বকাঝকা করুক হার্ট তো আপনাকেই দিয়ে রেখেছে।’
সঞ্জয় হা হা করে হাসিতে ফেটে পড়ে, ‘ভালো বলেছ। আরে তুমিই তো খবরটা দিলে। নইলে হতভাগা তো আমাদের কিছু না জানিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে ছিল।’
রিমঝিম থাকতে না পেরে শৌর্যকে বলল, ‘কী হচ্ছে একটু খুলে বলবে কি?’
শৌর্য জিষ্ণুর প্রেম কাহিনি সংক্ষেপে বলার পর সঞ্জয় বলল, ‘তারপর শৌর্য ফেসবুক খুলে মেয়েটির ছবি দেখাতে জানতে পারলাম, আরে, এ তো আমার কলেজের বান্ধবী অঞ্জনার মেয়ে। ব্যস, মেসেঞ্জারে মেসেজ করে ফোন নম্বর নিয়ে অঞ্জনার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।’
শৌর্য বলল, ‘আমিই বললাম, বাবা, বিয়ের পাকা কথা পয়লা বৈশাখে সারুন। আপনার ছেলে, এসো হে বৈশাখ, গেয়েই না হয় জীবনের অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করুক।’
রিমঝিম বলল, ‘এসব তো এমনিই করতে পারতে। এত নাটক করতে গেলে কেন?’
সঞ্জয় হাসতে হাসতে বলল, ‘তোর মা যা সন্দেহবাতিক, তার সঙ্গে সরমা আছে ধুনো দেওয়ার জন্য। মনে হল ওদের একটু ঘোল খাওয়াই। সরমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ভিডিও কল করলাম। আর রতনকে দিয়ে ফোনে দুয়েকটা ইনফরমেশন দিলাম। ব্যস, বাকি গল্পটা ওরাই তৈরি করে নিয়েছে।’
সারাদিনের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ যেন হঠাৎই ঝলমলে সান্ধ্য জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। এমন আনন্দের আবহে একমাত্র বোস গিন্নি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছে আর ভাবছে মিষ্টি কেনার টাকাটা জলে গেল।
14th April, 2024