বহু প্রচেষ্টার পর পারিবারিক সম্পত্তি বিভাজনে শরিকি সহমত। ব্যবসা, পেশা ও ধর্মকর্মে শুভ সময়। ... বিশদ
দুই পর্যায়ে ভোটের পর মোদির পেটোয়া সংস্থারাও আর ভরসা দিতে পারছেন না। নির্বাচন কমিশনও মোদিকে জেতাতে অসহায়। ইডি, সিবিআইকে অস্ত্র করে মোদিজির প্রতিহিংসার চিহ্নগুলি মানুষ বুঝে নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হচ্ছে না। তাই দুই পর্যায়ের ১৯০ আসনের মধ্যে মোদির পোষ্য প্রাইভেট গোয়েন্দারা পঞ্চাশও আশা করছেন না। এর আগের নির্বাচনে এই ১৯০ আসনের মধ্যে বিজেপি তাদের ব্যাগে পুরেছিল ৯৪টি আসন। মোদি বলেছিলেন, ‘আব কী বার চারশো পার’। সেই স্লোগান এখন অতীতের একটা জীর্ণ স্বপ্নমাত্র। মানুষ বলছেন, ‘আব কী বার, পার্লামেন্ট সে বাহার!’
বিজেপি সবথেকে বেশি ভয় পেয়েছে এবারের দুই পর্যায়ের ভোটের টার্ন আউট দেখে। প্রতিটা রাজ্যে কয়েক শতাংশ করে ভোট কমেছে। এর মধ্যে দেখা গিয়েছে, বেশ কিছু কেন্দ্রে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় যখন ভোটদান কমেছে, তখন সেই কেন্দ্রেরই মুসলিম মহল্লায় ঢেলে ভোট হয়েছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর। সেখানে হিন্দু ও মুসলিমদের শতকরা হার যথাক্রমে ৫৭.৫১ এবং ৪১.৩০ শতাংশ। এই লোকসভা কেন্দ্রের মুসলিম এলাকাগুলিতে ভোটের হার মোটামুটি আগের মতোই আছে। তাই হিন্দু ভোটের আগ্রহ কমে যাওয়া এবং মুসলিম ভোটের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার ঘটনাকে বিজেপি সিঁদুরে মেঘ হিসাবে দেখছে। এমন ঘটনা বিভিন্ন রাজ্যের অনেকগুলি কেন্দ্রে ঘটেছে।
বিজেপি নেতৃত্ব বারবার আকুল হয়ে ভাবছে, কেন হিন্দু ভোটাররা আর মোদির ভাবমূর্তিতে আকৃষ্ট হচ্ছেন না! আসলে প্রত্যেক স্বৈরশাসকই নিজেকে ‘অবতার’ বলে মনে করেন। অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের ‘মহাপুরুষ’ ছবির মতো। তিনি সূর্যদেবকে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠান। মোদিও এবার নির্বাচনের আগে আত্মবিশ্বাসের উত্তুঙ্গ শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এজেন্সিকে দিয়ে বিরোধীদের পিঠে দুর্নীতির ছাপ্পা মেরে জেলে ভরলেই খেলাটা সহজ হয়ে যাবে। তা যে হচ্ছে না, সেটা তিনি সম্যক বুঝতে পেরেছেন। মানুষও বুঝতে পারছেন, মোদির ফেরা মানে সংবিধান বদলের আশঙ্কা। মোদির ফেরা মানে আরও বেশি শক্তি সংগ্রহ করে এক স্বৈরাচারীর প্রত্যাবর্তন, মোদির ফেরা মানে দেশজুড়ে এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, মোদির ফেরা মানে দেশে আরও হিংসার বাতাবরণ, মোদির ফেরা মানে দেশের সম্পত্তি বিক্রি হয়ে যাওয়া, মোদির ফেরা মানে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার অবসান, মোদির ফেরা মানে পাকিস্তানের মতো ভারত নামক এক মৌলবাদী রাষ্ট্রের জন্ম, মোদির ফেরা মানে আরও কয়েকটি গোধরা। এমনকী অনেকেই ভাবছেন, মোদির ফেরা মানে এটাই হয়তো শেষ নির্বাচন। গণতন্ত্রের কবরে পোঁতা হতে পারে শেষ পেরেক। তাই মানুষ খুব সাবধানী। তাঁদের কাছে রামনামের চেয়ে ভাতের প্রার্থনা অনেক বেশি কাম্য। হিংসার দাপাদাপির থেকে শান্তি ও সুস্থিতি বেশি কাম্য। তাই একসুরে বাজছে দেশবাসীর মন। এক ব্যর্থ শাসকের খপ্পর থেকে মুক্তি চান দেশের মানুষ।
কেন এমন হল? তাই নিয়ে গবেষণায় বসেছেন গেরুয়া শিবিরের থিংক ট্যাঙ্করা। কীভাবে আবার দেশবাসীকে মোদি ম্যাজিকে ভোলানো যায়, তাই নিয়ে পথ খোঁজার চেষ্টা চলছে। দলের নেতারা বুঝতে পারছেন, আজ মোদির শত্রু মোদির ইমেজই। কিন্তু সেকথা বলার ক্ষমতা দলের কারও নেই। এক ইলেকশন বন্ডই মোদির ইমেজকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছে। সকলের দিকে যিনি এতদিন আঙুল তুলে ‘চোর চোর’ বলে চেঁচিয়েছেন, তাঁর কাপড়ে লেগে গেল দুর্নীতির কলঙ্ক। অনেক চেষ্টা করেছিলেন সেটা চাপা দেওয়ার। কিন্তু লুটমারির সেই বাস্তব চিত্র দেখে দেশের মানুষ তাঁর প্রতি এক লহমায় সব বিশ্বাস হারিয়েছেন। অভিযোগ, স্বাধীন ভারতের সবথেকে বড় কেলেঙ্কারির পাণ্ডা হলেন মোদি। পার্টির লোকেরাও আর নির্বাচনী প্রচারে বুক বাজিয়ে বলতে পারছেন না, মোদি কোনও দুষ্কর্ম করেননি। তাই বহুদিন পর পুরনো স্লোগান আবার নতুন রূপে ফিরে এসেছে, ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, মোদি সরকার চোর হ্যায়’। আত্মবিশ্বাস হারিয়েছেন মোদিও। সমস্ত নির্বাচনী ভাষণে নেই কোনও উন্নয়নের কথা। বিজেপির নির্বাচনী ভাষণ লক্ষ্য করে দেখবেন, শুধু পঞ্চ ম-কার। মোদি, মুসলমান, মঙ্গলসূত্র, মছলি, মুঘল। এই মন্ত্র আউড়ে চারশো পার করার স্বপ্ন বিলাসিতা নয়, হারিকিরি।
মোদির অন্ধ ভক্তরা তাঁকে না চিনলেও ভালো করে চিনতে পেরেছে আরএসএস। আজ সঙ্গ পরিবারের কাছেও শিরঃপীড়ার কারণ মোদির স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ। এতদিন পর্যন্ত বিজেপির সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রক ছিল সঙ্ঘ পরিবার। কিন্তু মোদির আমিত্ব সেসবকে পরোয়া করছে না। মোদির ক্যারিশমার ওপর অটুট ভরসা ছিল আরএসএসের। মোদি নিজেই সেই ভরসা ছিন্ন করেছেন। নিজের স্বভাবদোষে সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে বেড়েছে তাঁর দূরত্ব। একে তো যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে মো-শা জুটির দীর্ঘদিনের মন কষাকষি। তার ওপর রামমন্দির নিয়ে মোদির একগুঁয়ে আধিপত্যবাদ দেশের একশ্রেণির সাধু-সন্ন্যাসী মানতে নারাজ। অসম্পূর্ণ মন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা নিয়ে যা হয়েছে, তা নিয়ে খোলাখুলি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চার শঙ্করাচার্যই। তাঁদের অনুগামী অসংখ্য হিন্দু রয়েছেন। তাঁদের কাছে মোদি নন, শঙ্করাচার্যই হিন্দুধর্মের শেষ কথা। রামকে নিয়ে রাজনীতি করার জন্য প্রাণপ্রতিষ্ঠা কর্মসূচি বয়কটের ডাক দিয়েছিল হিন্দু মহাসভা। তারা সেই অনুষ্ঠান নিয়ে বলেছিল, ‘এটা একটা রাজনৈতিক সার্কাস।’ তাই বহু হিন্দুই আজ মোদির হিন্দুত্বকে মানেন না। মোদির রাজনৈতিক হিন্দুত্ব আসলে ক্ষমতা দখলের একটা টোপ। এসব দেখে আরএসএসও এখন প্রমাদ গুনছে। তারা বুঝতে পেরেছে, একদিন দেশে হিন্দুত্বের শ্রীবৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা লাটাইয়ের সুতো ছেড়ে মোদিকে অবাধে উড়তে দিয়ে ভুল করেছিলেন। দলের প্রচারক থেকে তাঁকে ধাপে ধাপে মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল। একদিন তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করা নিয়ে মতবিরোধ হয়েছিল বাজপেয়ি এবং আদবানির মধ্যে। আদবানিও যে সবসময় মোদিকে পছন্দ করতেন, তা নয়। গোধরার সেই কলঙ্কিত গণহত্যার পর আদবানি অত্যন্ত কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘এই তালিবানি হিন্দুত্ব আমি মানি না।’ গোধরা কাণ্ডের পর বাজপেয়ি চেয়েছিলেন, রাজধর্ম পালন করতে মোদি অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। কিন্তু সেদিন আরএসএস মোদির পিছনে দাঁড়িয়েছিল। বাজপেয়ি হিন্দুত্বের ধার ধারতেন না। তিনি ছিলেন সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ। আদবানির দায়বদ্ধতা ছিল পার্টির প্রতি বেশি। আর মোদির দায়বদ্ধতা স্বৈরতন্ত্রের কাছে।
আরএসএস ও মোদির দ্বন্দ্বটা শুরু সেই ২০১৪ সাল থেকেই। বিজেপির জয়ের পর অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘মোদিই ম্যান অব দি ম্যাচ।’ তখন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত সেকথাকে খণ্ডন করে বলেছিলেন, ‘এই জয় কোনও একক ব্যক্তির নয়। এটা সামগ্রিক লড়াইয়ের ফল।’ কথাটা নরেন্দ্র মোদির পছন্দ হয়নি। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত কোনওদিন মোদি ও ভাগবতের মুখোমুখি একান্ত বৈঠক হয়নি। মোহন ভাগবত চাইলেও মোদি সময় দেননি। মোদি নাগপুরে গেলেও আরএসএস দপ্তরে যাননি। ২০১৪ থেকে আরএসএস-মোদির মধ্যে যোগসূত্র রচনা করে চলেছেন অমিত শাহ। ভাগবত প্রথম থেকেই চেয়েছিলেন মোদিকে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। সেটা সম্ভব হয়নি। তাই এখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে সঙ্ঘ পরিবার বুঝতে পারছে, মোদিরাজ মানে সঙ্ঘের ক্ষতি। তারা এখন বিকল্প হিসাবে যোগীরাজকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু মোদির শক্তির সঙ্গে এখনই এঁটে ওঠা সম্ভব নয়। তাই সঙ্ঘ চাইছে, মোদি যেন কখনওই সোয়া দুশো পার করতে না পারে। মোদি যেন চাপে থাকেন, সেক্ষেত্রে মো-শা জুটিকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হবে। এ যেন সেই ইঁদুরের বিড়াল থেকে বাঘ হয়ে ওঠার গল্প! সেই বাঘ একদিন মুনিকেই খেতে গিয়েছিল। আরএসএস তা হতে দেবে না। তাদের কামড়ে খাওয়ার আগেই তারা বলে উঠতে চাইছে, পুনর্মূষিকো ভব।
সারা দেশও সেই সুরে সুর মিলিয়ে বলছে, পুনর্মূষিকো ভব। তবে মানুষের ভোটের ইঙ্গিত বলছে, ভাটার টানে আসন সংখ্যা দুশোর আগেই থমকে যাবে। সেই অবস্থায় জোটসঙ্গীরা একছুটে পালাবে। এবারের নির্বাচন দেখবে সেই আকাশচুম্বি ঔদ্ধত্যের পতন।