সব কর্মেই অর্থকড়ি উপার্জন বাড়বে। কর্মের পরিবেশে জটিলতা। মানসিক উত্তেজনা কমাতে চেষ্টা করুন। ... বিশদ
‘আমাকে কঠোর হতে বাধ্য করবেন না। গঙ্গারামপুরে একজন ভাইবোনের গায়ে হাত পড়লে যে ক’দিন চেয়ারম্যান থাকবেন, তারচেয়ে বেশি দিন ইডি-সিবিআইয়ের হাতে থাকবেন।’ বক্তার নাম ডঃ সুকান্ত মজুমদার। বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা বালুরঘাটের বিদায়ী সাংসদ। এবারও তিনি একই কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী।
বিজেপির এই দুই প্রার্থীই উচ্চশিক্ষিত। সুকান্তবাবু কলেজের অধ্যাপক। মানুষ গড়ার কারিগর। তাই রাজনীতিতে যেমন তাঁর অনুগামী আছে, তেমনই আছে অনেক গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রী। এহেন সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং সম্মাননীয় ব্যক্তিরাও বিরোধীদের ‘হুমকি’ দিচ্ছেন। বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের কথা না শুনলে যেতে হবে তিহার জেলে। কেন্দ্রীয় এজেন্সি যে বিজেপি নেতাদের কথাতেই চলে, সেটা সুকান্তবাবুরাই প্রমাণ করে দিচ্ছেন।
এই সব হুমকির উদ্দেশ্য বিরোধীদের চমকানোর পাশাপাশি দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করা। রাজনীতিতে এটা নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে নানাভাবে বিরোধীপক্ষকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে, আগামীতেও হবে। তবে, বদলে যাচ্ছে হুমকি-ধমকির ধরন। আগে যা হতো গোপনে, এখন তা হচ্ছে প্রকাশ্যে। খুল্লামখুল্লা।
তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’ সিনেমাটার কথা মনে আছে? বৃষ্টিভেজা রাতে ‘শিক্ষক’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজের চোখে ছাত্রকে খুন করতে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন। মাস্টারমশাইয়ের চোখেমুখে ঠিকরে পড়ছে আতঙ্ক। মাস্টারমশাই সব দেখে ফেলেছেন জানার পর ছাত্র ঠান্ডা মাথায় হুমকি দিয়ে বলেছিল, ‘আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি মাস্টারমশাই।’
সিনেমাটা তৈরি হয়েছিল বাম আমলে। এটাই ছিল তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতি। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অন্যায়, অত্যাচার মানুষ মুখবুজে মেনে নিত। বলা ভালো, মানতে বাধ্য করা হতো। রাজ্যের রাজনীতিও চলত সেই ছকেই। বিরোধীদের দমিয়ে দেওয়ার জন্য আঁটা হতো নিত্যনতুন ফন্দি। নেওয়া হতো এমন সব কৌশল যাতে বিরোধিতা করার ইচ্ছাটাই কর্পূরের মতো উবে যায়।
সিপিএমের ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড গড়ার পিছনে ছিল বিরোধীদের দমিয়ে রাখার নানান ফর্মুলা। তবে ‘থান থিওরি’র ধারেকাছে কেউ ছিল না। রাতের অন্ধকারে বিরোধী দলের ডাকাবুকো নেতার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হতো থান কাপড়। সঙ্গে ছোট্ট চিরকুট, ‘বেশি বাড়াবাড়ি করো না।’ ইঙ্গিত স্পষ্ট, রাজনীতি নিয়ে মাতামাতি করলে স্ত্রীকে হতে হবে বিধবা। এভাবেই লড়াকু বিরোধী নেতার পায়ে ‘বেড়ি’ পরানোর দায়িত্বটা দেওয়া হতো বাড়ির মহিলাদের উপরেই। আতঙ্কটা পৌঁছে যেত একেবারে বাড়ির অন্দরে। মূলত সিপিএমের এই থিওরিতেই বাংলায় নেমে এসেছিল শ্মশানের শান্তি।
তবে গ্রামবাংলাকে মুক্তাঞ্চল বানানোয় সিপিএমের সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্রটির নাম ছিল ‘খেতমজুর বয়কট’। কেউ মাথা তোলার চেষ্টা করলেই জারি হতো ‘খেতমজুর বয়কটে’র হুলিয়া। মাঠের পাকাধান মাঠেই পড়ে থাকত, খামার পর্যন্ত পৌঁছত না। পার্টি অফিসে গিয়ে মুচলেকা দিয়ে তুলতে হতো বয়কটের ফতোয়া। তারপরও কেউ ‘বেয়াদপি’ করলে ধোপা-নাপিত বন্ধ। পাড়ার লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ। যার নাম ছিল ‘সামাজিক বয়কট’। আর তা তোলার জন্য দিতে হতো মোটা অঙ্কের জরিমানা।
রাজ্যে ক্ষমতা পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু বিরোধীপক্ষকে দমিয়ে রাখার মানসিকতা বদলায়নি। কর্তৃত্ব কায়েমের জন্য কোনও তৃণমূল নেতা দিয়েছে সিপিএমের সঙ্গে সাপের মতো আচরণ করার নির্দেশ। আবার কেউ দিয়েছে অনুষ্ঠান বাড়িতে সিপিএমের লোকজনকে নিমন্ত্রণ না করার পরামর্শ। পুলিসকে বোমা মারার হুমকি দিয়ে সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন অনুব্রত মণ্ডল। তবে বিখ্যাত হয়েছিল তাঁর ‘গাঁজা কেস’। অবশ্য খেলা জমিয়ে দিয়েছে বিজেপি। তারা দেখিয়ে দিচ্ছে ক্ষমতায় থাকলে বিরোধীদের কতভাবে হেনস্তা করা যায়!
তৃণমূলের নেতারা ‘বাঘ’ মেরেছে মুখে। আর বিজেপি সেটা কাজে করে দেখাচ্ছে। ক্ষমতা দখলের পথে ‘কাঁটা’ হলেই তা উপড়ে ফেলার জন্য চলে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় এজেন্সি। বারবার ডেকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, হয় আত্মসমর্পণ, না হয় জেল। হাতেগরম উদাহরণ অরবিন্দ কেজরিওয়াল। সেই তালিকায় নাকি রয়েছে আরও নাম। অনেকেই ভেবেছিলেন, নির্বাচন ঘোষণার পর বন্ধ হয়ে যাবে কেন্দ্রীয় এজেন্সির ধরপাকড়, হয়রানি। কারণ সবই চলে যাবে কমিশনের নিয়ন্ত্রণে। তখন আর কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে এজেন্সি দাপাদাপি করতে পারবে না। কিন্তু হচ্ছে উল্টো। দিন দিন বেড়েই চলেছে। কমিশনও কিছু করতে পারছে না। কারণ আইনে নাকি কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে নিয়ন্ত্রণের সুস্পষ্ট গাইড লাইন নেই। থাকবেই বা কী করে? এমন অভূতপূর্ব ঘটনা আগে ঘটেনি।
বিজেপি ক্ষমতায় ফেরার জন্য রাষ্ট্রশক্তিকে নির্লজ্জভাবে কাজে লাগাচ্ছে। বেছে বেছে বিরোধী দলের পোড়খাওয়া নেতাদের টার্গেট করছে। প্রথমে তাঁদের দুর্নীতিতে অভিযুক্ত করছে। তারপরই পৌঁছে যাচ্ছে এজেন্সির হাজিরা নোটিস। আর তাতেই
হচ্ছে বাজিমাত। জেলযাত্রা এড়াতে অধিকাংশই আত্মসমর্পণ করছে। মাথা নোয়ালেই ‘ওয়াশিং মেশিনে’ ধুয়ে যাচ্ছে ময়লা। দুর্নীতিতে অভিযুক্তরাই হয়ে যাচ্ছে বিজেপির ‘সম্পদ’।
সম্প্রতি সর্বভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্ট বলছে, দেশে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত বিরোধী দলের ২৫জন নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তারমধ্যে ২৩ জনই আপাতত ‘কলঙ্কমুক্ত’। বিজেপিতে যোগ দিলেই সাত খুন মাফ, এটাই বিরোধীদের অভিযোগ। সেই অভিযোগ খণ্ডন না
করে বিজেপি তাকে ‘প্রোমোট’ করছে। কারণ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত বিরোধী দলের নেতারাই বিজেপির হালটা শক্ত করে ধরছে। তাতে নরেন্দ্র মোদির ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে লড়াই শিকেয় উঠলেও তাঁর হ্যাটট্রিকের রাস্তা হবে মসৃণ।
ভোটের মুখে কেজরিওয়ালকে জেলে পাঠানোর পিছনেও রয়েছে সেই অঙ্ক। কিন্তু অনেকেই বলছেন, কেজরিওয়ালকে জেলে পাঠিয়ে বিজেপির লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। কেজরিওয়াল জেলে গেলেও আম আদমি পার্টিতে ভাঙন ধরেনি। তাই মোটা টাকার টোপ দেওয়ার পাশাপাশি চলছে ধমকি, হুমকি। বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বিজেপিতে যোগ না দিলে যেতে হবে জেলে।
দিল্লি বিজেপির এই হুমকি-কালচার দ্রুত রপ্ত করে ফেলেছেন সুকান্ত মজুমদার, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়রা। রাজনীতির বাইরেও তাঁদের পেশাগত একটা পরিচয় আছে। সেই সূত্রে অনেকেই তাঁদের সম্মান করেন। কিন্তু তাঁরা যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে সেই সম্মানের ভিত ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি তাঁরাও জানেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা ‘রকের ভাষায়’ হুমকি দিচ্ছেন। কিন্তু কেন?
পঞ্চায়েত ভোটে গাইঘাটার আংরাইলে গিয়ে বিজেপির বিধায়ক স্বপন মজুমদার বলেছিলেন, ‘শাসক দলের সেসব নেতা পুলিস দিয়ে মানুষকে চমকাচ্ছে, মিথ্যে কেস দেওয়াচ্ছে তাদের বলে দিতে চাই, আগামী দিনে এই পুলিস দিয়েই তাদের এনকাউন্টার করাব।’ তাঁর এই হুমকিতে বিতর্ক হয়েছিল বিস্তর। কিন্তু দল স্বপনবাবুকে সতর্ক করেনি, উল্টে তিনি পুরস্কৃত হলেন। এবার তিনিই বারাসাত লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী। দিল্লির বিজেপি নেতৃত্ব এভাবেই বুঝিয়ে দিচ্ছে, তৃণমূলকে যে যত হুমকি দেবে, দলে তার স্কোর তত বাড়বে।
এতদিন বলা হচ্ছিল, সিএএ নাগরিকত্ব দেওয়ার, কেড়ে নেওয়ার নয়। কিন্তু বিদায়ী কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের গলায় এখন অন্য কথা। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ‘যারা তৃণমূল করে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।’ এক্ষেত্রে প্রথমে ঝোলানো হয়েছিল ‘গাজর’। তাতে কাজ না হওয়ায় এখন দেওয়া হচ্ছে হুমকি। একেই কি বলে, বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি!
বিজেপিতে শুরু হয়েছে ‘বেলাগাম’ হওয়ার প্রতিযোগিতা। যাঁর আক্রমণ যত তীক্ষ্ণ দিল্লিতে তাঁর কদর তত বেশি। সেই প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছেন প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়,
অধ্যাপক সুকান্ত মজমুদাররাও। অধ্যাপকের মুখে সিনেমার ভিলেনের ভাষা শুনে অনেকেই বিস্মিত হচ্ছেন। কিন্তু প্রাক্তন বিচারপতির হুমকিতে অবাক হননি কেউই। কারণ এজলাসে বসেই তিনি দিয়েছিলেন ‘ঢাকি সহ বিসর্জনে’র হুমকি। সেই জন্যই বোধহয় ‘বামপন্থায় বিশ্বাসী’ অভিজিৎবাবু দ্রুত মিশে গেলেন ‘গেরুয়া কালচারে’।