নিকটজনের স্বাস্থ্য সমস্যায় মানসিক অস্থিরতা। মুদ্রণ বা সংবাদপত্রের ব্যবসা,বৃত্তি শিক্ষাকেন্দ্রের পরিচালনায় সাফল্য। ... বিশদ
একসময় ননী পালকিওয়ালা সংবিধানের ‘মূল কাঠামো’ অবিকৃত (unalterable and unamendable) রাখার তত্ত্ব সংশ্লিষ্ট মহলের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করেছিলেন। তখন কিছু পণ্ডিত ও আইনজ্ঞ তাঁর যুক্তিটি নিয়ে উপহাস করতে ছাড়েননি। একটা সার্বভৌমের সংসদের সংবিধান সংশোধনের (অনুচ্ছেদ ৩৬৮) যে ক্ষমতা রয়েছে, সেটা সরকারি প্রশাসন (executive) কীভাবে খর্ব করতে পারে কিংবা তাদের দ্বারা নিযুক্ত বিচারপতিদের বিবেচনার উপর সেটা ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে—সেই প্রশ্ন তাঁরা সেদিন তুলেছিলেন। দিনের শেষে তেরোজন বিচারপতির ভিতরে মাত্র সাতজন পালকিওয়ালাজির সেদিনের মহান যুক্তিটি মেনে নিয়েছিলেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে আজ আমরা বলতে পারি যে—ভাগ্যিস, ওইক’জন বিচারপতি তাঁর যুক্তিটির সঙ্গে সহমত হয়েছিলেন!
সবার জন্য বিচার কই?
ভারতের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য এটাই যে সে সমস্ত ‘নাগরিক’-এর জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ‘সুবিচার’... ‘সুনিশ্চিত’ করার ব্যবস্থা করেছে। এখানে ‘সামাজিক সুবিচার’-এর মতো প্রতিটি কথাই গভীর অর্থবহ। এই কথাগুলিই অগণিত মানুষের মনে বিরাট প্রত্যাশার পারদ চড়িয়ে রেখেছে এবং প্রত্যাশা এমনভাবেই জেগে রয়েছে। আগামী ২৬ জানুয়ারি, ২০২০-তে আমরা আমাদের সংবিধানের ৭০তম বর্ষ উদযাপন করতে চলেছি।
এটাই মোক্ষম প্রশ্নগুলি করার সময়: সামাজিক ন্যায়বিচার (social justice) কারা পেয়েছে এবং কারা পায়নি? অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার (economic justice) কাকে বলে এবং সব নাগরিক কি অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার পেয়ে থাকেন? এমনকী, যখন সব নাগরিকের রাজনৈতিক ভোটাধিকার রয়েছে, তখনও কি তাঁরা সকলে রাজনৈতিক সুবিচারটি পেয়ে থাকেন?
শত শত বছর যাবৎ পিরামিডের সবার নীচে রয়ে গিয়েছে তফসিলি জাতি (এসসি) এবং তফসিলি জনজাতিগুলি (এসটি)। অন্যান্য অনগ্রসর জাতিগুলি (ওবিসি) এবং তাদের ভিতরে যারা সবচেয়ে নীচে পড়ে রয়েছে, এবং সংখ্যালঘু শ্রেণীগুলিকে অন্য পিছিয়ে-পড়া গোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করতে হবে। একশো বছরের বেশিকাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন কৃষ্ণাঙ্গরা ছিলেন, তেমনি অবস্থায় আজকের ভারতে পড়ে রয়েছেন দলিতরা, জনজাতিগুলি এবং মুসমানরা। এক গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে আমেরিকায় ক্রীতদাসপ্রথা নির্মূল হয়েছিল এবং ১৯৬৩-তে তৈরি হয়েছিল নাগরিক অধিকার আইন (Civil Rights Act)। তারপর দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গদের গ্রহণযোগ্যতা, তাদের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং সমান সুযোগ-সুবিধা। ভারতে আমাদের যে সংবিধান, তা অস্পৃশ্যতাকে ভালো চোখে দেখে না এবং ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। এসি, এসটিদের সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছে এই সংবিধান। তার পরেও বাস্তবটা হল যে অবহেলিত শ্রেণীগুলি সামাজিক ন্যায়বিচার থেকে যথেষ্ট বঞ্চিত। মানব উন্নয়নের অন্য সূচকগুলির সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সরকারি চাকরি তাদের নাগালের বাইরে রয়ে গিয়েছে।
বৈষম্যের শিকার ও দরিদ্র
গৃহ, অপরাধ, বিচারাধীন মানুষ, ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব প্রভৃতি সংক্রান্ত তথ্যের উল্লেখ করছি না, যেগুলি থেকে প্রমাণ হতে পারত যে এসসি, এসটি এবং মুসলিমরা সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার এবং তারা অবহেলা, অপমান ও অত্যাচারের পাত্র।
সামাজিক ন্যায়েরই সুফল হল অর্থনৈতিক ন্যায়। অবহেলিত এবং অনগ্রসর শ্রেণীরাই লেখাপড়ার সুযোগ কম পায়, তাদের সহায়-সম্পত্তিও কম, সরকারি চাকরি বা উচ্চমানের চাকরিতে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় সামান্যই। স্বাভাবিকভাবে তাদের আয়ও কম এবং তারা কেনাকাটা বা খরচাপাতিও করতে পারে না অন্যদের মতো। নীচের সারণি থেকে এর একটা চিত্র খুঁজে পাওয়া যেতে পারে:
চরমতম ব্যর্থতা
তৃতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল রাজনৈতিক ন্যায়বিচার (political justice)—সেটা পূরণের ক্ষেত্রে দেখা গেল চরমতম ব্যর্থতা। সংরক্ষিত নির্বাচন কেন্দ্রগুলিকে ধন্যবাদ। এটার জন্যই সমস্ত রাজ্য বিধানসভা এবং সংসদের মতো নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে সন্তোষজনক অনুপাতে এসসি এবং এসটি প্রতিনিধিত্ব পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক ন্যায়বিচার সেখানে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে বলেই মনে হয়। অনেক রাজনৈতিক দলেই সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রগুলিতে এসসি, এসটি প্রতিনিধিত্ব ঠিকমতো নেই, যেটুকু আছে সেটাকে নিয়মরক্ষার অতিরিক্ত বলা যাবে না। এমনকী এসসিদের নিজেদের বলে পরিচিত পার্টিগুলিতেও (যেমন বিএসপি, ভিসিকে) যদি এসসিদের খুঁজে পাওয়া যায় তো দেখবেন, তাদের প্রতি সমর্থনটা এসসি ভোটারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছ। যতক্ষণ না তারা বৃহত্তর সামাজিক জোট (বহুজন) বা রাজনৈতিক গাঁটবন্ধন তৈরি করতে পারছে, ততক্ষণ তারা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছে। দুর্দশা মুসলিমদের ক্ষেত্রে আরও বেশি।
মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলির নিজস্ব ‘সংখ্যালঘু সেল’ থাকে, কিন্তু অগ্রণী নেতাদের মধ্যে সংখ্যালঘুদের কাউকে বিশেষ একটা রাখা হয় না। বিজেপি খোলাখুলি মুসলিমদের সম্পর্কে সাবধান থাকে এবং তাদেরকে এনআরসি-সিএএ-এনপিআর-এর ভয় দেখায়। অন্যদিকে, আইইউএমএল কিংবা এআইএমআইএম-এর মতো যেসব দল মুসলিমদের সামনে রেখে রাজনীতি করে তারা বড়জোর ‘কোয়ালিশন পার্টনার’ অথবা ‘স্পয়লার’ হতে পারে, কিন্তু কখনোই ‘উইনার’ তারা হয় না।
মুসলিমদের পক্ষে সবচেয়ে গুরুতর ব্যাপার এই যে তারা দেশবাসীর বিশেষ সমর্থন পায় না অথবা প্রবল বিরোধিতার মুখে তাদের পড়তে হয়। এই প্রসঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের কথাটা ভাবুন। আমার তো মনে হয়, কাশ্মীর উপত্যকার ৭৫ লক্ষ মানুষের স্বার্থের কথাটি দ্রুত চাপা পড়ে যাচ্ছে। গত ৫ আগস্ট থেকে উপত্যকা (যেটাকে অবশ্য অর্ধেক এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করে দেওয়া হয়েছে) অবরোধের মধ্যে রয়েছে। জঙ্গি কার্যকলাপের খতিয়ান নিলে দেখবেন, ২০১৯ সালটা এই প্রশ্নে এক দশকের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে।
স্বভাবতই সাধারণ মানুষও সবচেয়ে বেশি হতাহত হয়েছেন। সেখানে ৬০৯ জনকে বিনা কারণে হেপাজতে নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীও। লিখিত সরকারি বিবৃতি অনুসারে সংবাদ মাধ্যম অবশ্য কাশ্মীর উপত্যকায় ‘স্বাভাবিক’ অবস্থা ফিরেছে বলে ‘রিপোর্ট’ করছে। বাকি ভারত মনে হয় কাশ্মীরি জনগণের কথা ভুলে গিয়ে তাদের অন্যসকল জরুরি বিষয়ে মনোনিবেশ করেছে। ২০১৯-এর আগস্টে যে ‘হেবিয়াস করপাস পিটিশন’ দাখিল করা হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্ট পরে সেটার রায় দেবে বলে সংরক্ষিত রেখেছে।
লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাপ্য ন্যূনতম সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার খারিজ করে দিয়ে রোজ সংবিধান লঙ্ঘন করা হচ্ছে। জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে যেটা চলছে সেটাকে সংবিধানের পবিত্রতা নষ্ট করা বলা চলে, কিন্তু আদালতের রায়ের জন্যই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ৭০ বছর পর কী দেখছি? সমস্ত নাগরিককে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্তত অর্ধেকের কাছে তা অপূর্ণ রয়ে গিয়েছে এবং বাকি অর্ধেক নাগরিক পেয়েছেন বটে তবে ছিটেফোঁটাই।