নিকটজনের স্বাস্থ্য সমস্যায় মানসিক অস্থিরতা। মুদ্রণ বা সংবাদপত্রের ব্যবসা,বৃত্তি শিক্ষাকেন্দ্রের পরিচালনায় সাফল্য। ... বিশদ
ফিরে যাই ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারিতে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন বিকেলে অসুস্থ শরীরে উপর থেকে নেমে এসে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন উদ্যান ধরে। সেখানেই দেখা হল পরমভক্ত গিরিশচন্দ্র, রামচন্দ্র, অতুল, নবগোপাল, হরমোহন, বৈকুণ্ঠ, কিশোরী (রায়), রামলাল, অক্ষয়, হারান প্রমুখের সঙ্গে। তাঁরা প্রণাম করার পর ঠাকুর গিরিশকে বললেন, তুমি যে সবাইকে এত কথা বলে বেড়াও তা তুমি আমার মধ্যে কী এমন দেখেছ? গিরিশচন্দ্র বিচলিত না হয়ে ঠাকুরের পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে বললেন, ব্যাস বাল্মিকী যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেননি আমি তাঁর সম্বন্ধে বেশি কী আর বলতে পারি! মুগ্ধ ঠাকুরের মুখ থেকে এরপর গিরিশকে উপলক্ষ করে বেরিয়ে আসে সেই অবিস্মরণীয় উক্তি—‘‘তোমাদের কী আর বলব, আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হোক।’’ অত্যন্ত সহজ সরল লোকশিক্ষার কথা। যার তাৎপর্য আজও বিভিন্ন রূপে বিভিন্নভাবে প্রতি মুহূর্তে নিষ্ঠাবান ভক্তের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। ঠাকুরের ‘কল্পতরু’ হওয়া আসলে পরমরূপে তাঁর আত্মপ্রকাশেরই কাহিনী। একইসঙ্গে এই কল্পতরু হওয়া ভক্তের হৃদয়কেও সম্যকভাবে প্রস্ফুটিত করার অনবদ্য প্রয়াসও বটে।
শোনা যায়, সেদিন ঠাকুরের কল্পতরু হওয়ার মুহূর্তে ঘটনাস্থলে না থাকলেও তাঁর প্রিয় শিষ্য নরেন কিন্তু কাছেই ছিলেন। সেদিন সামান্য কয়েকজন ভক্ত প্রত্যক্ষভাবে ঠাকুরের কৃপালাভে ধন্য হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম জনৈক হারানচন্দ্র দাস। ভাবাবিষ্ট ঠাকুর তাঁর মাথায় পাদপদ্ম রেখে কৃপা করেছিলেন। এই প্রথম এমন ঘটনা বলে তাঁর সেদিনের ভক্তরা সাক্ষ্য দিয়েছেন। ঠাকুরের ভাইপো রামলালও ওই ঘটনার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন। ঠাকুরের কৃপাধন্য রামলাল বলেছিলেন, আগে ইষ্টমূর্তি ধ্যান করতে বসে তাঁর শ্রীঅঙ্গের কিছুটামাত্র মানসচক্ষে দেখতে পেতাম। যখন পাদপদ্ম দেখেছি তখন তাঁর মুখ অদৃশ্য থাকত। আবার কখনও মুখ থেকে তাঁর কটিদেশ পর্যন্তই হয়তো দেখতে পেতাম। তখন তাঁর শ্রীচরণ দেখতে পেতাম না। আবার ওইরূপে যা দেখতাম সেটাকে সজীব বলেও মনে হতো না। আজ ঠাকুর স্পর্শ করামাত্র ‘সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ ইষ্টমূর্তি’ সহসা হৃদয়পদ্মে আবির্ভূত হলেন। একসময় নড়ে চড়ে ঝলমল করে উঠলেন!
সেই অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা আজও সমানভাবে বাস্তব। ১৩৪ বছর আগে ঠাকুরের সেই উক্তি এবং তাঁর অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক অভিঘাত আজও গোটা বাংলায় ফি-বছর ১ জানুয়ারি ঝড় তোলে। আর তাতে ভেসেই বিটি রোড দিয়ে জনস্রোত এগিয়ে চলে কাশীপুর উদ্যানবাটীর দিকে। এই ‘ব্রিগেডে’ তিনিই বক্তা, তিনিই পথপ্রদর্শক। ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’—ওই কথার বাইরে আর কিছুই তো তিনি বলে যাননি। অথচ ওই একটা উক্তির জোরেই গোটা সিঁথি কাশীপুর বরানগর বছরের শুরুতেই এমন পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। এই বরানগরেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে ঠাকুরের পদধূলি পড়েছে। কোনও মাদুলি, তাগা, পয়মন্ত পাথর তিনি ভক্তদের দেননি। শুধু নিষ্কাম নিঃস্বার্থ ভক্তি এবং দৃঢ় বিশ্বাসের জোরে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা ও তার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরলাভের পথ বাতলে দিয়েছিলেন অগণিত ভক্তকে। বলা বাহুল্য, কল্পতরু শব্দটার মধ্যে একটা ভোজবাজির গন্ধ আছে। কিন্তু ঠাকুরের সেই ঐতিহাসিক লীলাখেলা কল্পতরু নামে খ্যাত হলেও ঝাড়ফুঁক ওষুধ তাবিজ দেওয়ার জাদুকর তিনি ছিলেন না। তাঁর ঈশ্বরসাধনা ছিল স্বার্থগন্ধশূন্য। তাই আজও এত যুগ পরেও ওই একটি কথার টানেই মানুষ ছুটে যায় কাশীপুর উদ্যানবাটীতে। আর এঁকে বেঁকে পাঁচ-ছ’ঘণ্টা অপেক্ষার পর ভেতরে প্রবেশ করে ঠাকুরের সামনে নত হয়ে প্রণাম করে আবার যে যাঁর কাজে চলে যান। একবার ঠাকুরের অত্যন্ত আপনজন হৃদে প্রশ্ন করেছিল, মামা, মায়ের কাছে গিয়ে কিছু শক্তি চেয়ে নাও না। কিছু সিদ্ধাই চাও। ভাগ্নের কথা শুনে মায়ের কাছে শক্তি বা সিদ্ধাই চাইতে গিয়ে ঠাকুরের সে এক ভয়ানক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’র পাতায় তা সবিস্তারে বলা রয়েছে। মায়ের কাছে ভর্ৎসিত হওয়ার পর ঠাকুর বেরিয়ে এসে হৃদেকে বলেছিলেন, তুই কেন আমায় এরূপ কথা শিখিয়ে দিলি। তোর জন্যই তো মায়ের কাছে শক্তি চাইতে গিয়ে আমার এরূপ দশা হল।
ঠাকুর বলছেন, যাদের সিদ্ধাই থাকে তাদের প্রতিষ্ঠা লোকমান্য এসব হয়। কত লোক আসছে, যাচ্ছে, ঘরে জিনিস থইথই। কত জিনিস কত লোক এনে দিচ্ছে। কিন্তু সে যদি মনে করে তার এমন শক্তি হয়েছে যে শত শত লোককে খাওয়াতে পারে, তাহলে ঠাকুরের সেই নিষ্কাম স্বার্থহীন ভগবান সাধনার কী হবে? তাই ঠাকুরের কাছে সিদ্ধাই গুরুগিরি ছিল আসলে ‘বেশ্যাগিরি’র মতো। ওই পাঁকে তিনি কখনোই আটকে পড়েননি। তাঁর শিষ্যদেরও আটকে পড়তে দেননি। এমনকী তাঁর মানসপুত্র নরেনকেও তিনি সিদ্ধাই আর ঝাড়ফুঁকের মত বিষয়ের অনেক বাইরে রেখেছিলেন। নরেনকে জ্ঞানের কল্পতরু হিসেবেই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাই তীব্র অনটনের মধ্যেও নরেন মা ভবতারিণীর কাছে গিয়ে ‘বিবেক’ আর ‘বৈরাগ্য’-এর অতিরিক্ত কিছুই চাইতে পারেননি। এর নেপথ্যে যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণেরই প্রভাব ও লীলা কাজ করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পিছন থেকে সুতোটা আগাগোড়া যে ধরা ছিল ঠাকুরের হাতেই। ঠাকুরের সেই দেখানো পথেই আজ মানব কল্যাণে নিয়োজিত রামকৃষ্ণ মিশনের কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত, যা না-দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না।
ঠাকুর যদি সত্যিই মাদুলি দিতেন, পাথর দিতেন তাহলে তাঁর জীবৎকালেই কামারপুকুরকে সোনা দিয়ে মুড়ে দেওয়া সম্ভব হতো। আগামী অঘ্রাণে তোমার মেয়ের বিয়ে পাকা কিংবা ফেব্রুয়ারিতেই তোমার ছেলের চাকরির যোগ আছে—এই সস্তা গুরুগিরি আজীবন ছিল তাঁর না-পসন্দ। এসব দেখলে শুনলে তিনি ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নিয়ে বলতেন, ‘ছিঃ, হ্যাক থুঃ!’ আজীবন নিজেকে এবং নিজের সাধনাকে তিনি বিক্রি করেননি, হাট করে খুলে দেননি অলৌকিক শক্তির দোকান। সেই কারণেই আজও রামকৃষ্ণ মিশন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার কর্মকাণ্ড আরও বিস্তারলাভ করছে। সেই আদর্শই আজও লাখো মানুষকে ঠাকুরের অনবদ্য লোকশিক্ষায় শুধু উদ্বুদ্ধই করছে না, আশ্রয়ও দিচ্ছে। তবে আক্ষেপ একটাই, তাঁর এই অনবদ্য লোকশিক্ষার সবটুকু অনুভব করলেও কেন যেন আমাদের চৈতন্যটা শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয় না। এভাবেই সময় যায়, আবার একটা ১ জানুয়ারি ফিরে ফিরে আসে।