সাধনার সোপান-পরম্পরার সঙ্গে একান্তভাবে সংযুক্ত ও অখণ্ড মালিকার মতো সুগ্রথিত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার যে অর্থের অনুধাবন করছি, এবং সেই অর্থের অনুধাবন করতে করতে আমরা এখন যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছি, তাকে আমরা একটি উপমার সাহায্যে বুঝবার চেষ্টা করতে পারি। সেটি হচ্ছে এই যে, কোনো মন্দিরে প্রবেশ করবার সময় আমরা যেমন ক্রমশ ক্রমশ তার বাইরের নাটমন্দির বা গোপুরম্ ইত্যাদি অতিক্রম করে গর্ভগৃহের দিকে, যেখানে দেবতা অধিষ্ঠিত আছেন তার দিকে ক্রমশঃ এগিয়ে যাই, এখানেও এই ষষ্ঠ অধ্যায়ে শ্রীভগবান সাধককে এনেছেন সেই অন্তঃপুরে, গর্ভগৃহে। তার আগে ঐ যে চতুর্দিকের পরিবেষ্টনী, মন্দিরের প্রাকার তিনি রচনা করেছেন, যা তৃতীয় অধ্যায় থেকে আরম্ভ করেছিলেন, সেটির নাম আমরা শুনেছি। ‘যজ্ঞ’। যজ্ঞের মধ্যে আমরা দুটি জিনিস দেখতে পেয়েছিলাম। একটি হল, কোনো ব্যাপক বা মহান আদর্শের জন্য, বিরাট আদর্শের জন্য কর্ম করা, সেইটির নাম হচ্ছে ‘বিষ্ণু’। যজ্ঞের অধিষ্ঠাতা ছিলেন বিষ্ণু, ‘বেবেষ্টি সর্বম্,’ সর্বব্যাপী যাঁর সত্তা। সেই সর্বব্যাপী সত্তার উদ্দেশ্যে আমার সমস্ত ক্রিয়া যখন অর্পিত হয়, তখনই আরম্ভ হয় যজ্ঞ। আর একটি জিনিস হল যজ্ঞের ‘বিধি’। এখন বিধিবোধিত কর্ম শুরু হয়েছে জীবনে। এতদিন জীবন অনিয়ন্ত্রিত ছিল, বিধিবোধিত ছিল না, এখন যজ্ঞেতে তা বিধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে আরম্ভ করল। একটি নির্দিষ্ট পরিধির মধ্যে এবং একটি বিশিষ্ট উদ্দেশ্যের দিকে আমাদের সমগ্র কর্মস্রোত প্রধাবিত হতে থাকল। এই যে একটি কেন্দ্রের দিকে লক্ষ্য রেখে আমি কর্মস্রোতকে নিয়ে চলেছি, সেই কেন্দ্রের সঙ্গে আমার ক্রমশ ক্রমশ আরও নৈকট্য, আরও গভীর গভীরতর সান্নিধ্যলাভের এই যে প্রয়াস, তারই নাম হচ্ছে যোগ। সেই যোগের কথা শ্রীভগবান শোনালেন অর্জুনকে ষষ্ঠ অধ্যায়ে, এবং এটা হচ্ছে চিত্তকে, ইন্দ্রিয়কে, মনকে ক্রমশঃ গুটিয়ে আনা। বাইরের ছড়ানো জিনিস এখন ক্রমশ গুটিয়ে আসছে কেন্দ্রের দিকে। সেই গোটানোর সাধনা, কেমন করে চিত্তকে গুটিয়ে আনতে হয়, তারই কথা তিনি এখানে বললেন। চিত্ত বা মনকে নিয়ন্ত্রণ করা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার, কারণ মন অতি সূক্ষ্ম ও অগোচর থাকায় সে আমার ধরা-ছোঁওয়া বা নাগালের বাইরে থেকে যায়। আমার গোচরে যা স্থূলরূপে আছে তা হল আমার দেহ। আর সেই দেহের মধ্যেই আছে প্রাণ ও মন। তাই ছড়ানো চিত্তকে গোটাবার আগে, স্থির করার পূর্বে চিত্ত যাতে অধিষ্ঠিত, সেই দেহকে স্থির করতে হয়ঃ
শুচৌ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরমাসনমাত্মনঃ।
নাত্যুচ্ছ্রি তং নাতিনীচং চৈলাজিনকুশোত্তরম্।।
আসনকে কোথায় কেমন করে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে? একটি শুচি পবিত্র স্থানে। ‘সমং কায়শিরোগ্রীবং’ রূপে দেহকে সমান করে, সুস্থির করে বসতে হবে, ছড়ানো এলোমেলো দেহকে প্রথম নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। সেই দেহ নিয়ন্ত্রণের দ্বারা তার মধ্যে অধিষ্ঠিত প্রাণ ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রিত হবে। প্রাণ সুনিয়ন্ত্রিত হলেই আস্তে আস্তে তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত মনও সুনিয়ন্ত্রিত হয়ে আসবে, কেন্দ্রাভিমুখী হবে। সমত্বের সাধন দেহ থেকেই আরম্ভ করতে হবে ‘সমং কায়শিরোগ্রীবং’ দিয়ে। তারপর এগিয়ে যেতে হবে, ‘প্রাণাপানৌ সমৌ কৃত্বা’। শেষে মনের স্তরে সমত্ব আসবে ‘সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ’। এই হল গীতার সমত্বের ক্রম। এইটি হল যোগের মূল কথা। কিন্তু এ সবকিছুই, এই ষষ্ঠ অধ্যায় পর্যন্ত ভগবান যা-কিছু করতে বলেছেন, সবটাই সাধকের নিজের দায়িত্ব, সেইটেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বিশেষ করে:
উদ্ধরেদাত্মননত্মাং নাত্মানমবসাদয়েৎ।
আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ।।
গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের ‘গীতার কথা’ থেকে।