আগে ধারণা ছিল ডেঙ্গু শুধুমাত্র শহরে হয়, কারণ শহরে প্রচুর বাড়ি ঘর তৈরি হয়। ফলে জল জমে নির্মীয়মান ইমারতে। এর ফলে সেখানে মশা ডিম পাড়ার সুযোগ পায়। মজার ব্যাপার হল, এখন গ্রামীণ এলাকাতেও প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে। গড়ে উঠছে পাকা বাড়ি। ফলে বাড়ছে নির্মীয়মান বাড়ির সংখ্যাও। তাই গ্রামীণ এলাকাতেও বাড়ছে ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। তাই এই বর্যাকালে ডেঙ্গু নিয়ে গ্রাম ও শহর সব জায়গাতেই থাকতে হবে সতর্ক। আগেভাগে ডেঙ্গুর উপসর্গ চিনে রাখতে পারলে আখেরে লাভ আমাদেরই।
পুরনো উপসর্গ
ডেঙ্গুর পুরনো উপসর্গ বলতে ছিল জ্বর, মাথাব্যথা আর সারা গায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। সারা গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা হতো বলে এই রোগের নামও ছিল ব্রেক বোন ফিভার। আগে ডেঙ্গু থেকে প্রাণহানির তেমন কোনও ঘটনার কথাও শোনা যেত না। তবে পুরনো ইতিহাস বলছে, ডেঙ্গু ভয়াল হয়ে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে। ইতিহাসের নানা ঘটনার দিকে তাকালেই নজরে আসে, ডেঙ্গু হলে হতে পারে ১) ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ২) ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার। এই সমস্যা দু'টির ক্ষেত্রে একটিতে প্লেটলেট কমে, রক্তপাত হয়। অন্যটিতে ব্লাড প্রেশার নেমে যায়। এই কারণে ডেঙ্গুর অর্গ্যান ডিসফাংশন দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও থাকে। অর্থাৎ কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ব্রেনেও পড়ে নেতিবাচক প্রভাব।
ডেঙ্গু স্ট্রেন
ডেঙ্গুর চারটি স্ট্রেন রয়েছে। ডেঙ্গু ১,২,৩ ,৪। তার মধ্যে ১,২,৩ স্ট্রেন বেশি ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত হল। নানা সময়ে এই চারটি স্ট্রেনই ঘুরে ফিরে সমস্যা তৈরি করে।
এক্সপ্যান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম
যত সময় যাচ্ছে ডেঙ্গুর লক্ষণগুলিরও ঘটছে পরিবর্তন। এখন ডেঙ্গুর যা লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে তাকে বলা হচ্ছে এক্সপ্যান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম— কেন এমন বলা হচ্ছে? কারণ ডেঙ্গুতে এখন আগের চাইতে অনেক বেশি সংখ্যক অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ ডেঙ্গু হলে রোগীর প্যাংক্রিয়াটাইটিস, এনসেফালোপ্যাথি, মায়োকার্ডাইটিস, হেপাটাইটিস, জন্ডিস, লিভার ফেলিওর, অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি, ইত্যাদি সমস্যাও দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ শরীরের একধিক অঙ্গও জড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু রোগে।
প্রশ্ন হল ডেঙ্গু মোকাবিলায় রোগী কী কী কাজ করতে পারেন?
রোগীর কর্তব্য
যে মরশুমে ডেঙ্গু হচ্ছে, সেই মরশুমে কোনও বাছবিচার না করে জ্বরের প্রথম দিনেই ডেঙ্গু এলাইজা মেথডে এনএস১ অ্যান্টিজেন টেস্ট করাতে হবে। করাতে হবে ম্যালেরিয়া পরীক্ষাও। কারণ বহু রোগীরই এখন ম্যালেরিয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু পজিটিভ হলে কোনওভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন না। ডেঙ্গুতে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া হলে বরং তা ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে। রোগীকে পান করতে হবে প্রচুর জল। একইসঙ্গে প্রয়োজন উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা। ডেঙ্গু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গহীন হতে পারে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মৃদু উপসর্গ থাকতেও পারে, তবে কোন ক্ষেত্রে পরিস্থিতি জটিল হবে তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। তাই সাবধানের মার নেই। খেয়াল রাখুন সতর্কতামূলক উপসর্গের প্রতি—
১)পেটে ব্যথা, ২) বমি বমি ভাব ৩) হলুদ প্রস্রাব ৪) ইউরিনের মাত্রা হ্রাস ৫) শোওয়া অবস্থা থেকে উঠতে গেলেই মাথা ঝিমঝিম করার মতো বোধ ৬) মাথা ঘুরছে ৭) গায়ে র্যাশ বেরচ্ছে ইত্যাদি।
উপরিউক্ত উপসর্গগুলি রোগীর শারীরিক অবস্থা যে জটিল হচ্ছে তার দিকে ইঙ্গিত করে। খুব জটিল অবস্থায় রোগীর পেটে তীব্র ব্যথা, একটানা বমি, মাড়ি থেকে রক্তপাত, ক্লান্তির মতো লক্ষণ দেখা যেতে পারে। এমন ক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এই ধরনের উপসর্গ না থাকলে বাড়িতেই ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রত্যেকদিন বাড়িতেই দু’বেলা প্লেটলেট এবং প্যাকড কর্পাসকুলার ভলিউম (পিসিভি) টেস্ট করে তার মাত্রা দেখা দরকার। পিসিভি হাই হওয়া রোগীর জটিল শারারিক পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে।
শেষ কথা
নির্মীয়মান বাড়ি থাকলে সেখানে জল জমছে কি না খেয়াল রাখুন।রাস্তায় যাতে জল জমে না তাকে তার দিকেও নজর রাখা দরকার। তবে তার চাইতেও বেশি দরকার নিজের বাড়ি ও বাড়ির আশপাশে টবে, পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোলায়, ভাঁড়ে যাতে জল না জমে তার দিকে ব্যবস্থা করা ও জল জমলে সত্বর জায়গাগুলি পরিষ্কার করা।
লিখেছেন সুপ্রিয় নায়েক