শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
অনেকদিন ধরেই উত্তমকুমারকে নিয়ে ছবি করার কথা ভাবছিলেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়। চিত্রনাট্যও রেডি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হবে ‘ঘরে বাইরে’। সন্দীপের চরিত্রে উত্তমকে ভেবেছিলেন সত্যজিৎ। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত নায়ক উত্তম সেই চরিত্রে অভিনয় করতে চাননি। বাংলা চলচ্চিত্রে রোম্যান্টিসিজমকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন উত্তমকুমার। কিন্তু সত্যিই কী উত্তমকুমার মানে শুধুই একজন রোম্যান্টিক নায়ক? কেরিয়ারের একটা সময়ে পৌঁছে উত্তমকুমারও উপলব্ধি করেছিলেন, নিজেকে শুধু রোম্যান্টিক নায়ক হিসেবে তুলে ধরলে তাঁর নিজের অভিনয় প্রতিভার উপরই অবিচার করা হবে। তাই একের পর এক নানাবিধ চরিত্রে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন তিনি। সেইজন্যই মৃত্যুর প্রায় ৪০ বছর পরেও তিনি বাঙালির এক ও একমাত্র মহানায়ক।
‘ঘরে বাইরে’তে উত্তমকুমারকে না পেলেও, স্রেফ তাঁকে ভেবেই একটি ছবির চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ‘নায়ক’। অভিনেতা অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই। তাঁকে ঘিরে জনমানসের উন্মাদনা। একজন সুপারস্টারের জীবন সবকিছুই তুলে ধরা হয়েছিল ছবিতে। ১৯৬৬। উত্তমকুমার তখন মধ্যগগনে। ইন্দিরা হলে ছবির প্রিমিয়ার হবে। সত্যজিৎ স্পষ্টই বলে দিলেন প্রিমিয়ারে হাজির হতে হবে উত্তমবাবুকে। উত্তমও সবিনয়ে মানিকদাকে জানালেন, এই ভরদুপুরে শোয়ে তাঁর হাজির হওয়াটা ঠিক হবে না। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে সত্যজিৎ জানিয়ে দিলেন, এটা সত্যজিৎ রায়ের ছবি। তাই তাঁকে হাজির হতেই হবে। এই খবর জানাজানি হতে দেরি হয়নি। সেদিন কেলেঙ্কারির একশেষ। রাস্তায় ভিড়। ‘গুরু’কে দেখতে হাজির অসংখ্য মানুষ। মারপিট, হাতাহাতি চলছে। হলমালিকও মানিকবাবুকে বললেন, উত্তমবাবুকে আনাটা কী ঠিক হবে। সত্যজিৎ নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। উত্তম এলেন। সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের মধ্যে আলোড়ন। আর গুরু, গুরু রব। উত্তমকুমার স্টেজে এসে বললেন, এটা কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ছবি। এখানে এসব দয়া করে করবেন না। ব্যস দর্শক চুপ। এমনই ছিল তাঁর জনমোহিনী ভাবমূর্তি। এক লহমায় দর্শককে নিজের কথা শোনাতে বাধ্য করতে পারতেন উত্তমকুমার। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার। বাঙালির একান্ত আপন গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সির ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা আদায় করে নিয়েছিলেন উত্তমকুমার। এই ছবিতে অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। তবে যুগ্মভাবে। তিনি পুরস্কার ভাগাভাগি করেন উত্তমকুমারের সঙ্গেই। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র জন্যও তাঁকে ওই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে নেগেটিভ রোল ছিল বলে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন উত্তমকুমার। কিন্তু সেই উত্তমকুমারেরই জীবনের অন্যতম সেরা অভিনয় ছিল ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বাঘ বন্দি খেলা’ ছবিতে। পীযূষ বসুর নির্দেশনার এই ছবিতে উত্তম অভিনয় করেছিলেন ভবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রে। লম্পট, দুর্নীতিগ্রস্ত, স্মাগলিংয়ের কারবারি ভবেশকে পুলিসের হাতে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল তাঁর ছেলেই। আত্মঘাতী হয়ে জীবন শেষ করে দিয়েছিলেন ভবেশ। ১৯৮১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রায় একই ধরনের ছবি ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’তে রাজশেখর রায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উত্তম।
উত্তমকুমার ছিলেন গ্রামের সরল সাদাসিধে ছেলে। শহরে এসেছেন। লড়াই করছেন। বড়লোকের মেয়ের প্রেমে পড়ছেন। নানা বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে মধুরেণ সমাপয়েত। দেশভাগের যন্ত্রণাকাতর বাঙালির কাছে হিট। এটাই ছিল রোম্যান্টিক উত্তমের ইউএসপি। কিন্তু মোটামুটি ছয়ের দশকের শেষার্ধ থেকেই নিজের ইমেজ পাল্টানোর চেষ্টা করছিলেন উত্তম। আবার ঠিক একই সময় বাংলার দর্শকের কাছে হাজির হয়েছিলেন, তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। উত্তমও নিজেকে ভেঙেচুরে তৈরি করছিলেন। নিজের রোম্যান্টিক ইমেজের বাইরে এসে অভিনেতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চাইছিলেন। বস্তুত, এই সময় তিনি এমন বহু ছবি করেছেন, যা শুধু তাঁর অভিনয়ের গুণেই উতরে গিয়েছে। অভিনেতা উত্তমকুমারের জীবনের একটি অসাধারণ ছবি ১৯৬৭ সালে তৈরি ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’। পর্তুগিজ অ্যান্টনি কবিয়ালের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উত্তম। সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ছবি ভালোবাসার গল্প হলেও, কাহিনী বিন্যাস ও অভিনয় দক্ষতার কারণে এই ছবিতে উত্তমকে স্রেফ রোমান্টিক হিরো বলা যাবে না।
১৯৭৫ সালে উত্তমকুমার আরও দু’টি অসাধারণ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। একটি পীযূষ বসুর ‘সন্ন্যাসী রাজা’। অন্যটি অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘অগ্নীশ্বর’। সন্ন্যাসী রাজায় ভাওয়ালের রাজার ফিরে আসার কাহিনী অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন উত্তমকুমার। অগ্নীশ্বরে একজন আদর্শবাদী চিকিৎসকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। ছবিতে একটি সরস সংলাপ ছিল। রোগীকে ডাক্তার দিয়েছেন তিনটি ডোজ। রোগী চাইছেন একটি। তখন ডাক্তার অগ্নীশ্বর বলছেন, যদি ঠাস ঠাস করে তিনটি চড় মারার দরকার হয়, তবে একটি চড়ে কাজ হবে কি?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছেন উত্তমকুমার। ‘ঝিন্দের বন্দি’ থেকে শুরু করে ‘অপরিচিত’, ‘স্ত্রী’, ‘দেবদাস’ সবেতেই অভিনয় দক্ষতার তুঙ্গে উঠেছিলেন বাংলার দুই ম্যাটিনি আইডল। এরমধ্যে ‘স্ত্রী’ ছবির কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। কারণ ওই ছবিতে উত্তমকুমার রোম্যান্টিক ইমেজ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। এখানেও তিনি ছিলেন মদ্যপ জমিদার (মাধব দত্ত)। কর্মচারী তরুণ ফোটোগ্রাফার (সীতাপতি)-এর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কের কথা জেনে গিয়েছিলেন। সেই টানাপোড়েন ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন উত্তম।
মহানায়কের ছয়ের দশকের একটি ছবির কথা না বললে চরিত্রাভিনেতা উত্তমকে পাওয়া যাবে না। সেটি হল, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’। যে সময় তিনি ওই ছবি করেছিলেন, তখন তিনি রোম্যান্টিক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। অথচ সেই সময় রাইচরণের মতো একটা কঠিন অথচ নন গ্ল্যামারাস রোলে তিনি ফাটিয়ে অভিনয় করেছিলেন। ১৯৬৩ সালের আরও একটি ছবি ‘শেষ অঙ্ক’। ওই ছবিতেও নিজের গ্ল্যামারাস ভাবমূর্তিকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন উত্তম। শুভ্রাংশুরূপী উত্তমের নেগেটিভ রোলে অভিনয় আজও দর্শক মনে রেখেছে। ১৯৫৯ সালের ছবি ‘বিচারক’-এও উত্তমকুমারকে দেখা গিয়েছে এমনই নন গ্ল্যামারাস রোলে। যিনি নিজেকে রায় দেওয়ার ব্যাপারে চরম নিরপেক্ষ মনে করতেন, সেই বিচারকই একটি বিশেষ কেসে রায় দিতে গিয়ে চরম দ্বিধায় পড়লেন। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবির আগে হিন্দিতে মহানায়ক একটি ছবি করেছিলেন। ‘প্লট নম্বর ৫’। উত্তমকুমারের অভিনয় জীবনের অন্যতম কঠিন এক চরিত্র। সেই ছবিতে হুইলচেয়ারে উত্তম। প্রতিবন্ধী মানুষ। হুইলচেয়ারে বসেই একের পর এক খুন করতে থাকে। ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অমল পালেকর। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন শ্রীরাম লাগু, প্রদীপকুমার প্রমুখ। ছবিটি অবশ্য মুক্তি পেয়েছিল মহানায়কের মৃত্যুর পর।
ছয়ের দশকের শেষার্ধ থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিনেও উত্তমকুমার রোম্যান্টিসিজমের বাইরে নিজেকে নিয়ে এসেছেন। ‘মৌচাক’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র মতো কমেডি ছবিতে তাঁর অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা দেখা গিয়েছে। উত্তমকুমার অভিনীত বেশ কয়েকটি ছবি পরে হিন্দিতে হয়েছে। এমনই একটি ছবি ‘নিশিপদ্ম’। পরে হিন্দিতে ‘অমর প্রেম’ ছবিতে ওই ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল রাজেশ খান্নাকে। সুপারস্টার রাজেশ অকপটে স্বীকার করেছিলেন, তিনি উত্তমকুমারের ধারেকাছে পৌঁছতে পারেননি। সব মিলিয়ে মৃত্যুর ৪০ বছর আজও বাঙালির স্বপ্নের নায়ক— উত্তমকুমার।