বদমেজাজ ও কঠিন ব্যবহারে ঘরে-বাইরে অশান্তি ও শত্রুতা। পেট ও বুকের সংক্রমণে দেহসুখের অভাব। কর্মে ... বিশদ
এই বিতর্কে ঢোকার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক জিএম খাবার মানে কী? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে যে কয়টি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়েছে, তার মধ্যে প্রথম তিনের মধ্যে অবশ্যই থাকবে ডিএনএ-এর কাঠামো আবিষ্কার। এই একটি আবিষ্কার জীবনবিজ্ঞানের দরজা খুলে দিয়েছে অপার বিস্ময়ের জন্য। এর হাত ধরেই দ্রুত এসেছে জিন টেকনোলজি এবং জিন এডিটিং। অর্থাৎ একটি কোষের নিউক্লিয়াসে জিন এখন পরিবর্তন করা সম্ভব। মনে করুন একটি প্রজাতির বেগুন ক্ষেতে ফলন শুরু হলেই পোকার আক্রমণে বেশিরভাগ শস্য নষ্ট হয়ে যায়। এখন যদি সেই বেগুনের মধ্যে এমন কিছু চরিত্র কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা যায়, যার ফলে সেই গাছে আর পোকা লাগবে না, তাহলে ফলন অনেকটাই বেড়ে যাবে। তাই নয় কি? এর সঙ্গে ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহারও অনেক কমে যাবে। এই কাজটিই বিজ্ঞানীরা করছেন জিন এডিটিং করে। বিটি বেগুনে এভাবেই অন্তর্নিহিত কীটনাশকের জিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই এক কাজ করা হয়েছিল হাওয়াই দ্বীপে পেঁপে ফলনের জন্য। নব্বইয়ের দশকে রিং স্পট ভাইরাস নামে একটি জীবাণু হাওয়াই দ্বীপের পেঁপে চাষের অর্থনীতি প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। এই সময়েই কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞানী রেনবো পেঁপে নামে একটি জিএম পেঁপে তৈরি করেন, যেটি ভাইরাস প্রতিরোধী। এখন হাওয়াই দ্বীপের ৯০ শতাংশ পেঁপে এই জি এম পেঁপে, এর ফলেই এই বাণিজ্য আবার লক্ষ্মীর মুখ দেখেছে।
কিন্তু এই অবধি পড়ে যদি আপনি ভাবেন যে জিএম শস্য আমাদের খাদ্য সমস্যার সমাধান করে দেবে, তবে তা হবে অতিসরলীকরণ। এই প্রযুক্তির বিরোধীরা কয়েকটি কথা বলেন, যা অবজ্ঞা করার মতো নয়। বিজ্ঞানীদের দাবি, অনন্তকাল ধরেই চাষীরা ভালো বীজ আলাদা করে চাষ করেন। একটি গাছের সঙ্গে অন্য গাছের সংকর ঘটিয়ে নতুন প্রজাতির জন্ম দেন। এভাবেই ফলন বাড়ে। নতুন উন্নত প্রজাতির শস্য তৈরি হয়। জিন এডিটিং এই ধারাবাহিকতার নতুন সোপান মাত্র। কিন্তু বিরোধীরা বলেন যে চাষিরা যেটা করেন, সেটা প্রাকৃতিক নিয়মের অনুসরণে। একটি লাল আম গাছের সঙ্গে কমলা আম গাছের কলম সংকর ঘটিয়ে নতুন গাছ সৃষ্টি। কিন্তু জিএম শস্য প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ। বেগুনের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার জিন ঢুকিয়ে দেওয়া প্রাকৃতিক নিয়ম নয়। এই যে অন্য প্রাণীর জিন খাদ্যশস্যের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হল, আমাদের পেটেই সেটা যাবে। এর শারীরিক প্রতিক্রিয়া কী হবে? সত্যি বলতে এই প্রশ্নের উত্তর সরাসরি দেওয়া মুশকিল। কিন্তু এটুকু বলা যায় যে পৃথিবীর অনেক দেশে, সে আমেরিকা হোক বা ব্রাজিল, এই জিএম ভুট্টা বা সয়াবিন বা আলু ব্যাপকহারে চাষ হচ্ছে, মানুষ খাচ্ছেও। আজ অবধি সেরকম চোখে পড়ার মতো কুপ্রভাব দেখা যায় নি। বিজ্ঞানীরা কিন্তু ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করেন না। তাঁরা অনেক গবেষণা করেই মানুষের শরীরের পক্ষে শুভ, এমন জিন এইসব খাদ্যে যোগ করেন। সুতরাং এত ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। আমাদের দেশে যারা জি এম খাদ্যের বিরোধিতা করেন, তারাই যখন আমেরিকায় বেড়াতে গিয়ে কর্ন সিরাপ খাচ্ছেন, সেটা কিন্তু জি এম কর্ন। তাতে তাদের শারীরিক ক্ষতি হয়েছে কি?
আরও একটি বিরোধিতার জায়গা হল জীববৈচিত্র্য। অনেকে বলেন যে এই সব জি এম খাদ্য আমাদের দেশের খাদ্যশস্যের বৈচিত্র্য নষ্ট করে দেবে। আস্তে আস্তে পুরনো সেইসব দেশি প্রজাতি লুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু জি এম খাদ্য যে সব সুবিধা দেবে, যেমন কীটের আক্রমণ থেকে অনাক্রম্যতা বা অধিক ফলন, দেশি বীজ সেই সুবিধা দিতে পারবে কি? নইলে এই বিপুল জনসংখ্যাকে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে কী? এর আগে যখন সবুজ বিপ্লবের সময়ে মেক্সিকো থেকে গমের বীজ এনে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো হয়েছিল, তখনও দেশি বীজের বৈচিত্র্য লুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু সেটা না করলে দেশের অনাহার মিটত কী করে?
সুতরাং এই বিতর্ক চলবেই। কিন্তু কোন কিছুর অন্ধ বিরোধিতা না করে বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কারকে ব্যবহার করাই বুদ্ধির কাজ।
সম্পাদনা: সুপ্রিয় নায়েক