উচ্চতর বিদ্যায় শুভ। যে কোনও কর্মে উপার্জন বাড়বে। ব্যবসার গতি ও আয় বাড়বে। ... বিশদ
১৬০৮ সালে দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি প্রথম ব্যবহার করেন হ্যান্স লিপারেশ। ১৬০৯ সালে দূরবর্তী নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের জন্য ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেন, যার সাহায্যে বৃহস্পতির উপগ্রহ এবং শনির বলয় পর্যবেক্ষণ করেন। ১৯৯০ সালে হাবল নামক একটি মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র উৎক্ষেপণ করে নাসা। যা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৫৯৬ কিলোমিটার উঁচুতে একটি কক্ষপথে থেকে আজও পৃথিবীকে পরিক্রমণ করে চলেছে। হাবল দূরবীক্ষণ যন্ত্র অতি বেগুনি থেকে অবলোহিত পর্যন্ত আলোর সমস্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্য দেখতে সক্ষম। এ পর্যন্ত হাবল দূরবীক্ষণ যন্ত্র থেকে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে মহাবিশ্বের বয়স, কোয়ার্কদের গঠন ও ডার্ক এনার্জি সম্বন্ধে অনেক তথ্য নিশ্চিত করে জানা গিয়েছে। সম্প্রসারণশীল এই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হারও জানা সম্ভব হয়েছে এই হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে।
হাবল টেলিস্কোপ যেখানে পৌঁছতে পারে না, সেই গহিন মহাশূন্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা (নাসা), ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ও কানাডার মহাকাশ সংস্থা সম্মিলিতভাবে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লুএসটি)। এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে (অর্থাৎ পৃথিবী থেকে চাঁদের যা দূরত্ব সেই দূরত্বের প্রায় ৩.৯ গুণ দূরত্ব) থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। এই এল-২ কক্ষপথে পৌঁছতে জেডব্লুএসটির সময় লেগেছিল এক মাস (এই দ্বিতীয় লাগ্রঁজীয় কক্ষপথে পৃথিবী ও সূর্যের লব্ধি মহাকর্ষীয় বল এবং মহাকাশযানের কেন্দ্রাতিক বল একে অপরকে নাকচ করে দেয়)। মহাকাশে স্থাপন করা সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে জটিল ইনফ্রারেড টেলিস্কোপের নাম হল জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। পাশাপশি এটিই পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহত্তম আন্তর্জাতিক মহাকাশ প্রচেষ্টা। মহাবিশ্বকে আরও বেশি স্পষ্ট করে দেখার জন্য তৈরি করা হয়েছে এই টেলিস্কোপটিকে।
এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে এই টেলিস্কোপটি তৈরি করতে। চলতি মাসের ১২ তারিখে টেলিস্কোপটি তার প্রথম ঝাঁ চকচকে সব ছবি পাঠাতে শুরু করে। সৃষ্টির আদিকালের এই সমস্ত ছবি দেখে বিশ্ববাসী বিস্মিত, মুগ্ধ ও স্তম্ভিত। পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে ১ হাজার ৩৫০ কোটি বছর আগের এই ছবি মহাশূন্যের সবচেয়ে স্পষ্ট এবং গভীরতম ইনফ্রারেড ছবি বলেই নাসার দাবি। হাবলের থেকে জেমস ওয়েবের তোলা ছবির মান অনেক অনেক ভালো। কারণ জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে আয়নাগুলো সোনার তৈরি, যার প্রতিফলন ক্ষমতা প্রায় ১০০ শতাংশ। আর অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি হাবল টেলিস্কোপের প্রতিফলন ক্ষমতা মাত্র ৮৫ শতাংশ।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণের উদ্দেশ্য হল মহাবিশ্বের সবচেয়ে দূরতম অংশের আলো পর্যবেক্ষণ করা, গ্রহগুলো কীভাবে তৈরি হল তা বোঝার চেষ্টা করা, গ্রহগুলোর আদিমতম চেহারা কী ছিল এবং তারও আগে মহাকাশের অবস্থা কী ছিল তা জানা। এই টেলিস্কোপটি অবলোহিত বিকিরণ পর্যালোচনা করে ছায়াপথের আগের অবস্থা এবং এখনকার অবস্থার পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করবে বলেই বিজ্ঞানীরা আশা করছেন। এছাড়াও এই মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল তারও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে বলেই আশা করা যাচ্ছে। অন্যান্য গ্রহের আবহাওয়া সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করা এবং অন্যান্য গ্রহে প্রাণের সন্ধান করবে এই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ।
অবলোহিত বিকিরণ রশ্মি হল সেই সকল তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণ, যাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমা ১ মাইক্রোমিটার থেকে ১ মিলিমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গদৈর্ঘ্য অপেক্ষা সামান্য বড়। খালি চোখে এদের দেখা যায় না, কিন্তু জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে এরা ধরা পড়ে। জেমস ওয়েব অবলোহিত বিকিরণ গ্রহণ করে, তাই এটাকে ঠান্ডা রাখা ভীষণ জরুরি। সামনে থেকে যাতে সূর্যের আলো না লাগে তাই এটিকে সূর্যের উল্টোদিকে ঘুরিয়ে রাখা হয়, এর পিছনে ছ’টি সৌর-ঢাল-স্তর থাকে।
আর হয়তো খুব বেশি দেরি নেই যখন পৃথিবীর জন্মের রহস্য, ছায়াপথের গোপন কথা, নক্ষত্রমণ্ডলের জন্ম ইতিহাস সবটাই সিনেমার মতো বাস্তবের পর্দায় ধরা পড়বে— এই রহস্য উদঘাটন করবে নাসার দূরবিন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। নাসার এই টেলিস্কোপ আসলে টাইম মেশিনে চেপে হাজার হাজার কোটি বছর আগে ফিরে যাওয়ারই এক যন্ত্র। আমরা আসলে কখনওই বর্তমানকে দেখি না— আমরা অতীতকে দেখি। আমরা সন্ধ্যাবেলায় যে চাঁদকে দেখি, সেটা আসলে ১.২ সেকেন্ড আগের চাঁদ (চাঁদ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০০ কিমি এবং আলোর গতিবেগ সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিমি), সূর্যাস্তের সময় আমরা যে সূর্যকে দেখি সেটা আসলে ৮.১৯ মিনিট আগের সূর্য (সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিমি)। অর্থাৎ যত বেশি দূরত্বের বস্তুকে আমরা দেখতে চাই, তত বেশি অতীতে আমরা ফিরে যাই।
.............................................
ছবি: সৌজন্যে নাসা