উচ্চতর বিদ্যায় শুভ। যে কোনও কর্মে উপার্জন বাড়বে। ব্যবসার গতি ও আয় বাড়বে। ... বিশদ
ইতিহাসের নিরিখে সত্যিই আমরা এক মহাসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আর কয়েকদিনের মধ্যেই পালিত হবে স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ। এখন থেকেই চারিদিকে তার উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আনন্দের মধ্যেও যেন লেগে রয়েছে কিছুটা মালিন্য। তার কারণ, এখন যারা দেশের সরকারে, যাদের নেতৃত্বে এই স্বাধীনতার অমৃতকাল পালিত হচ্ছে, দুর্ভাগ্যের বিষয় তাদের পূর্বসূরি হিন্দু মহাসভা, আরএসএস কোনওদিন স্বাধীনতার মহান লড়াইয়ের অংশীদার ছিল না। আজ যে মানুষটি ভারতীয়দের নয়নের মণি, সেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে একদিন কংগ্রেস, কমিউনিস্ট এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তি বিপাকে ফেলার চেষ্টা করেছিল। আজ অনেকেই নিজেদের বিপ্লবী বানিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের ভুয়ো গল্প ফেঁদে বসেছে। নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে কল্পকথা লেখা হচ্ছে। স্বাধীনতাকালে নিজেদের কলঙ্ক মুছে সঙ্ঘ পরিবারের অনুগতদের দিয়ে নতুন ইতিহাস লেখানো হচ্ছে! লেখা হচ্ছে স্বাধীনতা আন্দোলনে সঙ্ঘ পরিবারের ‘উজ্জ্বল’ ভূমিকার কথা। সম্প্রতি এনিয়ে গাদা গাদা বই বেরচ্ছে। সেখানে থাকছে শুধুই হিন্দুত্ববাদী শক্তির জয়জয়কার।
পিছন থেকে একদিন যাঁরা স্বাধীনতার আন্দোলনকে ভণ্ডুল করে ইংরেজ বাহাদুরদের অনুগ্রহ লাভ করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই আজ প্রথম সারিতে এসে বসেছেন। তাঁদের মূর্তিতে মালা দিয়ে ইতিহাসকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে সঙ্ঘ পরিবারের কেউ কেউ। অটলবিহারী বাজপেয়ি প্রথম ক্ষমতায় আসার পর ঠিক হল, স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দুত্ববাদী নেতাদের অবদানকে বড় করে তুলে ধরতে হবে। সব কলঙ্ক মুছতে তখন থেকেই শুরু হল ইতিহাস বুননের অন্য ধারা। এতদিন কংগ্রেস তার আন্দোলনকে তুলে ধরে দেখিয়েছে এদেশে স্বাধীনতা এনেছে তারাই। তার পাল্টা তরজা শুরু করেছিল আরএসএস। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সেই তরজা এখন অনেক এগিয়ে গিয়েছে। গত পাঁচ-ছয় বছরে মোদিজির অনুপ্রেরণায় এরকম প্রচুর ইতিহাসের বই লেখা হয়েছে, যেখানে সাভারকর, হেডগেওয়ার, হোলওয়ালকর, শ্যামাপ্রসাদ, নাথুরামরা আন্দোলনের পুরোভাগে ঠাঁই পেয়েছেন। এসবের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছেন সূর্য সেন, সত্যেন বোস, কানাই দত্ত, ভগৎ সিং, বসন্ত বিশ্বাস, অনন্তহরি মিত্ররা। এইসব বিরুদ্ধ শক্তিকে নেতাজি ভালো করেই চিনতেন। তিনি জানতেন, এই দেশে থাকলে তাঁর পক্ষে স্বাধীনতার লড়াই করা কঠিন। এমনকী অশুভ শক্তিরা তাঁকে বিপ্লবের পথ থেকে সরিয়েও দিতে পারে। তাই তিনি বিদেশ থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন চালাতে প্রয়াসী হন। তা সত্ত্বেও অপপ্রচার এবং ভুয়ো সংবাদ ছড়িয়ে তাঁর অন্তর্ধান রহস্যকে অন্যভাবে প্রতিষ্ঠা করার কুনাট্য জারি ছিল। ইংরেজদের সঙ্গে গোপনে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউই নেতাজিকে সহ্য করতে পারতেন না। কারণ নেতাজি জানতেন, কংগ্রেসের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইংরেজকে সহজে তাড়ানো যাবে না আর হিন্দুত্ববাদী শক্তি এবং মুসলিম লিগ ব্রিটিশদের হাতে তামাক খাচ্ছে। সাভারকরের বক্তৃতা প্রসঙ্গে ফরওয়ার্ড ব্লক কাগজে লেখা হল, সাম্প্রদায়িক বিভেদকে বড় করে তুলে ধরে হিন্দু মহাসভা ভারতের জাতীয়তাবাদী ধারণার অপূরণীয় ক্ষতি করে চলেছে।
তাই হিন্দুত্ববাদী নেতারা নেতাজিকে সহ্য করতে পারতেন না। সাভারকার বলেছিলেন, হিন্দুত্বের উত্থানের জন্য ব্রিটিশ শক্তিকে ব্যবহার করা দরকার। ব্রিটিশদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য হিন্দুদের দলে দলে ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগদান করা জরুরি। বিশেষ করে বাংলা এবং অসম থেকে।
কেন তিনি এমন কথা বললেন? কাদের বিরুদ্ধে লড়বে সেই ব্রিটিশ শক্তি? সবাই জানেন, নেতাজির আইএনএ’র বিরুদ্ধে। ভারত স্বাধীন করার যে প্রচেষ্টা লড়াই ও আত্মত্যাগ নেতাজি করছিলেন, তাকে সেদিন সাভারকররা দমিত করার চেষ্টা করেছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যাঁরা সশস্ত্র সংগ্রাম করতেন, সাভারকর তাঁদের ঘৃণা করতেন। তিনি বলেছিলেন, যে সশস্ত্র প্রতিরোধ ইংরেজদের বিব্রত করতে পারে, তেমন কোনও প্রতিরোধের সঙ্গে হিন্দু মহাসভা নিজেদের জড়াবে না। অথচ আজ সঙ্ঘ পরিবার সব ভুলিয়ে দিয়ে নেতাজি প্রেমে মেতে উঠতে চাইছে। এ যুগে তারাই এসেছে ভক্ত সাজি।
১৯০৯ সালের ১ জুলাই মদনলাল ধিংড়ার গুলিতে প্রাণ গেল ইংরেজ কার্জন উইলির। ধিংড়াকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন দামোদর সাভারকর। ধিংড়া ধরা পড়ার পর সাভারকরেরও হয়তো ভয় ছিল তদন্তে ধিংড়ার সঙ্গে তাঁর যোগ ফাঁস হয়ে যেতে পারে। সাভারকর অবশ্য ধরা পড়ে যান অন্য কেসে। সাভারকরের ভাই গণেশ সাভারকরকে আন্দামানে দ্বীপান্তরের সাজা দেওয়া হয়েছিল। তার বদলা নিতে ১৯০৯ সালের ২১ ডিসেম্বর খুন হন নাসিকের কালেক্টর জ্যাকসন সাহেব। তদন্তে দেখা যায়, সেই খুনে যে অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি লন্ডন থেকে পঠিয়েছিলেন সাভারকর। ধরা পড়ার ভয়ে সাভারকার প্যারিসে গিয়ে আত্মগোপন করলেন। দু’মাস পরে লন্ডনে ফিরে এসে ধরা পড়ে গেলেন। তাঁকে ভারতে ফিরিয়ে এনে বিচার হল। পাঠানো হল সেলুলার জেলে। সেখানে বিপ্লবীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার হতো। সেই অত্যাচার সহ্য করা সাভারকরের ধাতে ছিল না। ১৯১১ সালের ৪ জুলাই তাঁকে সেলুলারে পাঠানো হয় এবং ৩০ আগস্টের মধ্যে তিনি মার্সি পিটিশন দাখিল করেন। তা বাতিল হয়ে যায়। বারবার বাতিল হওয়া সত্ত্বেও তিনি আবেদন করেই যাচ্ছিলেন। বাংলার আর এক বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীকে সেই সময় সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। তাঁর লেখা থেকেই জানা যায়, দুই সাভারকর ভাই-ই ব্রিটিশদের অনুগত হয়ে থাকার চেষ্টা করতেন। বন্দিদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করার প্রতিবাদে যখন জেলে বিপ্লবীরা আন্দোলন করেন, তখনও দুই ভাই সেই আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখে নাকি ইংরেজদের খুশি করার চেষ্টা করেছিলেন। জেলে সাভারকরের ভূমিকা নিয়ে আমরা অনেক কথা ত্রৈলোক্যনাথের লেখা থেকে জানতে পারি। ‘জেলে ভালো আচরণের জন্য’ ছাড়া পেয়ে গেলেন সাভারকর ভাইরা। বিনায়ক সাভারকর ছাড়া পেলেন ১৯২৪-এর ৫ জানুয়ারি। এই পর্যন্ত একরকম ছিল। কিন্তু সাভারকরের বিপ্লবী মানসিকতা জেল থেকে বের হওয়ার পর একেবারে বদলে গেল। যেন পুরো মগজ ধোলাই হল তাঁর। বিপ্লবের ময়দান থেকে তিনি বিদায় নিলেন এবং তাঁর একমাত্র কাজ হল ভারতকে ব্রিটিশ শক্তির আশীর্বাদপুষ্ট করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের এককাট্টা করা। ডিভাইড অ্যান্ড রুলের নীতিতে ব্রিটিশরা এভাবেই সাভারকরকে ব্যবহার করেছিলেন। তাঁরই অন্যতম শিষ্য হয়ে উঠেছিলেন নাথুরাম গডসে।
পাশাপাশি দেখি, ১৯৪০ সালে মৃত্যুর আগে আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা কে বি হেডগেওয়ার বললেন, তিনি আজ স্বপ্ন দেখছেন এক হিন্দুরাষ্ট্রের। সেদিন তিনি কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলেননি।
তাঁরই শিষ্য এম এস গোলওয়ালকর বললেন, শোনো হিন্দু ভাইরা, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই
করে তোমরা তোমাদের এনার্জি নষ্ট কোরো না। ওটা জমিয়ে রাখতে হবে। কেননা আমাদের লড়াই করতে হবে অভ্যন্তরীণ শত্রু মুসলিম, খ্রিস্টান এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে।
আসলে ব্রিটিশদের দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতেই এবং তাদেরই অনুপ্রেরণায় জন্ম হয়েছিল হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের। গান্ধীজি যখন ’৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলেন, তখন সেই আন্দোলনকে কড়া হাতে দমন করার কথা জানিয়ে ইংরেজদের চিঠি লিখলেন শ্যামাপ্রসাদ সহ হিন্দুত্ববাদী নেতারা। যখন দেশে স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার হচ্ছে, ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গাইছেন বিপ্লবীরা, তখন হেডগেওয়ার, গোলওয়ালকররা দেশের হিন্দুদের বলছেন, খবরদার, ওসব আবেগে জড়িও না। আমাদের মূল লক্ষ্য হল ইংরেজদের সাহায্য ও অনুপ্রেরণায় হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠা।
স্বাধীনতার অমৃতকালে সেই সব বিষাক্ত মন্তব্যের কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। মনে রাখতে হবে, আজ বিজেপি যেভাবে নেতাজি ভজনায় নেমেছে, তার মধ্যে সত্যতা আদৌ কতটা আছে। বরং সত্যকে চাপা দেওয়ার সে এক করুণ প্রয়াস। নেতাজির বিশাল মূর্তি স্থাপন করলেও সেই পাপস্খালন সম্ভব নয়। ইতিহাস মুছে ফেলার এই নির্লজ্জতাকে স্বীকৃতি দেওয়া মানেই, ‘এ আমার এ তোমার পাপ।’ সুতরাং এ অমৃতপাত্র নিদারুণ বিষে ভরা, দূরে ফেলে দাও, দূরে ফেলে দাও ত্বরা।