উচ্চতর বিদ্যায় শুভ। যে কোনও কর্মে উপার্জন বাড়বে। ব্যবসার গতি ও আয় বাড়বে। ... বিশদ
বড়দাদু সবে দুপুরের ভাতঘুম সেরে ইজিচেয়ারে বসে সকালের খবরের কাগজের না পড়া খবরগুলো পড়তে বসেছেন। ঠিক তখনই নাতি-নাতনির দলের একেবারে কুইক মার্চ। শুভম সবার বড়। ক্লাস এইটে পড়ে। বাকিরা কেউ সিক্স, কেউ ফাইভ কিংবা ফোরে। রাহুল আর বরেণ্যা পড়ে ক্লাস সেভেনে।
‘তোমাকেও আমাদের সঙ্গে অভিনয় করতে হবে,’ সরাসরি হুকুম জারি করে শুভম।
‘আমাকে? অভিনয় করতে হবে? তোমাদের সঙ্গে?’ খবরের কাগজ রেখে তিন-তিনটে অবাক প্রশ্ন ছুড়ে দেন বড়দাদু।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অভিনয়। তুমি যেমন আমাদের ঠাকুরদা, তেমনি ঠাকুরদার ভূমিকাতেই অভিনয় করতে হবে,’ তর্জনী টানটান করে জানিয়ে দেয় সৃজা।
‘কিন্তু তোমরা বলেছিলে রাহুল ঠাকুরদা হবে,’ মনে করিয়ে দেন বড়দাদু।
‘আসল ঠাকুরদা থাকতে রাহুল কেন নকল...’
‘না না, আমি পারব না। আসল দাদু তো আরও দুটো আছে। তাদের বল।’ ঘন ঘন মাথা নাড়েন বড়দাদু, ‘আমাদের সময় বিশুকে ঠাকুরদা সাজানো হয়েছিল। সে আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট। সুতরাং রাহুল...’
‘তোমার মুখে শুধু গল্পই শুনেছি, তুমি নাকি খুব ভালো নাটক করতে? একবার করে দেখাও না। আমরা দেখি,’ অকাট্য যুক্তি খাঁড়া করে সৃজা।
‘এ তো মহামুশকিল’—চিন্তায় ডুবে যান বড়দাদু। মনে মনে ভাবেন, নিজের ছেলেবেলার গল্পগুলো বিচ্ছুদের কাছে না বললেই ভালো হতো।
এই সেদিন, সপ্তাহ খানেক আগে সৌরভ জানতে চেয়েছিল, তোমরা ছোটবেলায় গরমের ছুটি কেমন করে কাটাতে? উত্তরে বড়দাদু গড়গড়িয়ে বলে দিয়েছিলেন দৌলতিয়ার মাঠের কথা। বলেছিলেন প্রশান্তবাবু আর সেনগুপ্তবাবুর কথা। গরমের ছুটিতে পাড়ার ছেলেরা আর ভাইয়েরা মিলে অনুষ্ঠান করতেন। বিচিত্রানুষ্ঠান। থাকত নাচ, গান, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা আর নাটক। কোনও বছর ‘ডাকঘর’, কোনও বছর ‘মুকুট’, কোনও বছর মেজদাদুর নাট্যরূপ দেওয়া ‘পাগলা দাশু’। থাকত পুরস্কার—মেডেল। টিনের উপর সোনালি নিকেল করা সব মেডেল লাল ফিতেয় বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো বিজেতাদের গলায়। দর্শকরা চটাপট হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করতেন ছোটদের।
‘তুমি কখনও মেডেল পেয়েছ?’ দুম করে কালীপটকার মতো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিল সৌম্য। সেই প্রশ্নের কী উত্তর হয় দেখার জন্য বাতাবি লেবুর মতো চোখ গোল গোল করে বসেছিল সৃজা। ‘পায়নি আবার। সব মেডেল তো বড়দাই নিয়ে নিত। নিজেই বিচার করে নিজেকে জয়ী করে দিত।’ বড়দাদু কোনও জবাব দেওয়ার আগেই হইহই করে ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন মেজদাদু।
‘ছোটদের সামনে কী সব আবোল-তাবোল বলছিস?’ মেজভাইকে ধমকে দিয়েছিলেন বড়দাদু। কিন্তু বড়দার ধমককে পাত্তা না দিয়ে আসল ঘটনাগুলো বলে দিয়েছিলেন মেজদাদু। আসলে বড়দাদু ছিলেন সবার নেতা। যেমনি আবৃত্তি করতেন দরাজ গলায়, তেমনি নাটক করতেন টানটান যাত্রার ঢঙে। আসলে মেজদাদু, ছোটদাদুরা বড়দাদুর ধারেকাছেও পৌঁছতে পারতেন না, তাই বদনাম করতেন।
‘তোমাকেও অভিনয় করতে হবে। আবৃত্তি করতে হবে’—মেজদাদুকে পেয়ে কোমর জড়িয়ে ধরেছিল বরেণ্যা, ‘আমি মায়ের মুখে গল্প শুনেছি, তুমি অফিসে আবৃত্তি করে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলে।’
‘অ—না, বাপু না। আমি বরং প্রশান্ত কাকু আর সেনগুপ্ত কাকুর প্রক্সি দেব। দিলীপকে দিয়ে স্টেজ বানিয়ে দেব আর দীপককে বলব আলুর দম, লুচি আর লাড্ডু সাপ্লাই দিতে,’ কোনও মতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিলেন মেজদাদু।
‘আমি বলছি, মেজো আবৃত্তি করবে আর পুতু গান গাইবে,’ রায় শুনিয়ে দিয়েছিলেন বড়দাদু। পুতু মানে প্রতাপনারায়ণ। ছোটদাদু। এককালে খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। দুটো না তিনটে ক্যাসেটও বেরিয়েছিল। এখন অবশ্য গান-টান আর গান না। ছেড়ে দিয়েছেন অনেকদিন আগে। তবু যদি শুভমরা বলে রাজি করাতে পারে। সবার উপরে বড়দাদুর আদেশ তো আছেই।নিজেদের ছেটবেলাটা নাতি-নাতনিদের মধ্যে দিয়ে দেখার লোভ সামলাতেও পারেননি বড়দাদু। তাই উস্কে দিয়েছিলেন রায়বাড়ির সব ছোটদের। সঙ্গে বরেণ্যাকেও। এখন আর বসু পরিবারের মতো এত বড় জয়েন্ট ফ্যামিলি দশ-বিশটা এলাকায় একটাও দেখা যায় না। তাই বাড়ির সবাই একজোট হলে ‘ডাকঘর’-এর মতো দশটা নাটক মঞ্চস্থ করা যায়। তবে হ্যাঁ, বড়দাদু চান বড়রা থাকবেন নেপথ্যে। সামনে ছোটরা মানে শুভম-সৃজারা। ঠিক নিজের ছোটবেলার মতো।
দৌলতিয়ার মাঠে কেন, কোনও মাঠই এখন আর পাড়ায় নেই। সব বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। ছোটদের ছোটবেলার খেলার স্বপ্ন। তবে বসুবাড়ির ছাউনি দেওয়া বড় ছাদ আছে। সেখানে ছোট্ট একটা স্টেজ করার পরেও চেয়ার পেতে দিলে অনেকেই বসতে পারে। সুতরাং ছাদেই হবে বিচিত্রানুষ্ঠান। গরমের ছুটিতে এবং কবিপক্ষে।
পরিকল্পনা শুনে প্রথমে বিজন অর্থাৎ সৌম্যর বাবা, মানে মেজদাদুর ছেলে একটু আপত্তি করেছিলেন। বলেছিলেন, ওই অনুষ্ঠানের তালেই ছেলেপুলেরা গরমের ছুটি কাটিয়ে দেবে। বইয়ের ধারেকাছেও ঘেঁষবে না, আর স্কুল খুললেই পরীক্ষা। পরীক্ষায় সব গোল গোল মেডেলের মতো জিরো নিয়ে আসবে। বিজনের রায় ছোটরা, বড়রা, বাড়ির মেয়েরা সবাই মিলে নাকচ করেছিল। আর শুভমরা কথা দিয়েছিল পরীক্ষায় সেরা নম্বর রাখবেই রাখবে।
‘ছাড়লি কেন? মেজদাদু আর ছোটদাদুদের জাপটে ধরে রাখতে হবে। ওদের ছাড়া কিন্তু জয় পরাজয় কিছুই হবে না,’ ইজিচেয়ারে আরাম করে হেলান দেন বড়দাদু।
ঠিক তখনই হো হো করে ঘরে ঢোকেন পুতু—ছোটদাদু, মুখে উদাও স্বরের আবৃত্তি—‘মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে...’
‘পঁচাত্তর বছর বয়স হল, তবু সেই ছোটটিই রয়ে গেলি।’ বড়দাদুর মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসেন মেজদাদু।
‘রনি, তুই বীরপুরুষ’ কবিতাটা মুখস্থ করে ফেল। তারপর কীভাবে বলতে হবে আমি শিখিয়ে দেব,’ রনির কাঁধে স্নেহের হাত রাখেন ছোটদাদু।
‘আমি তো বাংলা ভালো পড়তে জানি না।’ মুখ কাঁচুমাচু রনির।
‘দেখলে বড়দা, এই হল এই প্রজন্মের গুণ। বাঙালির ছেলে বাংলা পড়তে, লিখতে জানে না। তোরা নাটক, আবৃত্তি করবি কেমন করে?’ মেজদার পাশে আর একটা চেয়ার টেনে বসে পড়েন ছোটদাদু। ছোটদাদুর এই ভূমিকা দেখে খুশি হন বড়দাদু। মনে মনে ভাবেন, যাক, পুতু তাহলে নিজেই রাজি হয়ে গেল।
‘বড়দাদু, মেজ দিদিমা আর আমার মা শিখিয়ে দেবে বলেছে,’ রনির বাংলা পড়তে না জানার খামতি মুখের ভাষা আর চোখের পলকে বুঝিয়ে দেয় সৌরভ।
‘তুমি জাজ হবে তো বড়দাদু?’ দুরুদুরু বুকে জানতে চায় শুভম। কারণ বড়দাদু থাকলে পুরস্কার তার নিশ্চিত।
‘বড়দা জাজ হলে তোরা কিন্তু পুরস্কারই পাবি না।’ হাসি হাসি মুখে সাবধান করে দেন মেজদাদু।
‘হতে পারি, তবে জাজ হলে আর ঠাকুরদার ভূমিকায় অভিনয় করা হবে না,’ জানিয়ে দেন বড়দাদু। চোখে-মুখে তাঁর মনখারাপের চিহ্ন। অনেক দিন পরে অভিনয় করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে?
‘তুমি চিন্তা কোরো না বড়দা। তুমি চুটিয়ে অভিনয় কর। ডাঙাপাড়ায় আমার যে বন্ধু আছে নরেন, ওকে বলব বিচারক হয়ে বিচার করে দিতে,’ সমস্যার সমাধান করে দেন ছোটদাদু।
‘ইয়া!’ ছোটদের মতো ডান হাতের মুঠি আকাশে ছুড়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান বড়দাদু। ফিরে যান স্কুল বেলার জীবনে।