উচ্চতর বিদ্যায় শুভ। যে কোনও কর্মে উপার্জন বাড়বে। ব্যবসার গতি ও আয় বাড়বে। ... বিশদ
১৭৯৮ থেকে ১৮০৫ সাল পর্যন্ত লর্ড ওয়েলেসলি ছিলেন ভারতের গভর্নর জেনারেল। সেই সময় তাঁর উদ্যোগেই বারাকপুরে গঙ্গার ধারে ছবির মতো সাজানো বাগানের ১ হাজার ৬ বিঘা জমিতে চিড়িয়াখানা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। বর্তমানে যার পরিচয় লাট বাগান বা মঙ্গল পাণ্ডে পার্ক হিসেবে। এই বাগানের পাশেই তাঁর থাকার জন্য তৈরি হয় প্রাসাদোপম বাড়ি। পরে এই বাড়িটির নামকরণ হয় বারাকপুর গভর্নমেন্ট হাউস। ১৮০২-’০৩ সালে শুরু হয় বাগানবাড়ি তৈরির কাজ। কিন্তু, খরচের বহর দেখে ওয়েলেসলিকে বড়লাট পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
কেন এই চিড়িয়াখানা গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন ওয়েলেসলি? জানা যায়, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি একটি ন্যাচারাল রিসার্চ সেন্টার (‘ন্যাশনাল হেরিটেজ অব ইন্ডিয়া’) গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। গার্ডেনরিচে যে পশু সংগ্রহশালা গড়েছিলেন (১৮০০-১৮০৪), সেটাই তিনি তুলে আনলেন বারাকপুরে। গঙ্গার মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে চিড়িয়াখানা। কোম্পানির কর্মচারীদের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জীবজন্তু সংগ্রহ শুরু হয়। খাঁচার গায়ে প্রত্যেক প্রজাতির প্রাণী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য লেখা থাকত ইংরেজি, উর্দু ও বাংলা ভাষায়। যাতে সবার বুঝতে সুবিধা হয়। বিশিষ্ট স্কটিশ চিকিৎসক তথা প্রাণীতত্ত্ববিদ ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটনের উপর পড়ে চিড়িয়াখানার পশু-পাখিগুলির রক্ষণাবেক্ষণের ভার। জীবজন্তুর ছবি আঁকার জন্য নিয়োগ করা হয় এক চিত্রকরকেও। জানা যায়, চার্লস ডি’ওইলি জল রং ব্যবহার করে এই চিড়িয়াখানার ছবি এঁকেছিলেন। শুধু তাই নয়, বিশিষ্ট ফরাসি উদ্ভিদতত্ত্ববিদ ভিক্টর জ্যাকমেঁ এই উদ্যান পরিদর্শন করেছিলেন। স্যার স্ট্যামফোর্ড রাফেল ১৮১০ সালে এখানে এসে প্রথম টাপির শিকার করেন। বারাকপুরের এই চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপনা দেখে লন্ডনের চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
ওয়েলেসলি দেশে ফিরে (১৮০৫) যাওয়ার পরের বছরই ছুটি নেন বুকানন। এরপর ১৮০৮ সাল পর্যন্ত এই চিড়িয়াখানার দায়িত্ব সামলান ডাঃ ফ্লেমিং এবং এশিয়াটিক সোসাইটির তৎকালীন সদস্য উইলিয়াম লয়েড গিরনিস। এরপরও আরও প্রায় ৬০ বছর এই চিড়িয়াখানার অস্তিত্ব ছিল। ১৮১০ সালে মারিয়া গ্রাহাম বারাকপুরে বেড়াতে এসেছিলেন। তাঁর লেখায় পেলিকান, ফ্লেমিংগো সহ একাধিক পশু-পাখির উল্লেখ রয়েছে। ১৮১২ সালে লর্ড মিন্টো তাঁর বিবাহবার্ষিকী পালন করেছিলেন এই চিড়িয়াখানায়। ১৮১৪-তে লেডি নুজেন্টের বর্ণনাতেও রয়েছে কালোচিতা, উটপাখির কথা। ১৮১৭-’১৮ সালে ফ্রান্সিস রডন হেস্টিংস এখানে নতুন পক্ষীশালা তৈরি করেন। এরপর ১৮২২ সালে নতুন খাঁচা তৈরি করে আরও জীবজন্তু এনে সাজিয়ে তোলেন এই চিড়িয়াখানাকে। তখন এর আয়তন বেড়ে হয় ৩০০ একর। লর্ড আমহার্স্ট বড়লাট হয়ে আসার পরও এই চিড়িয়াখানার রক্ষণাবেক্ষণে প্রথমদিকে কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর বিপুল খরচ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তখন বাধ্য হয়েই আফ্রিকার সিংহ এবং একাধিক বাঘ বিলিয়ে দিতে হয় দেশীয় রাজাদের মধ্যে। বড়লাট লর্ড বেন্টিঙ্কের এই চিড়িয়াখানা সম্বন্ধে কোনও উৎসাহ না থাকলেও লর্ড ক্যানিং চেষ্টা করেছিলেন এটির হাল ফেরানোর। কিন্তু, তাঁর আমলের পর থেকেই এই চিড়িয়াখানার হাল দ্রুত খারাপ হতে থাকে।
বিশ্বের বিভিন্ন শহরের চিড়িয়াখানা দেখে উৎসাহিত হয়ে কলকাতার ব্রিটিশ সম্প্রদায়ও একটি চিড়িয়াখানা স্থাপনের উদ্যোগী হন। ১৮৪১ সালের জুলাইয়ে ‘ক্যালকাটা জার্নাল অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’ পত্রিকায় কলকাতায় একটি চিড়িয়াখানা স্থাপনের দাবি তোলা হয়। শেষপর্যন্ত ১৮৭৩ সালে লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যর রিচার্ড টেম্পল কলকাতায় চিড়িয়াখানা স্থাপনের প্রস্তাব দেন। এশিয়াটিক সোসাইটি ও এগ্রি হর্টিকালচার সোসাইটিকে যৌথভাবে জমি দেওয়া হয় আলিপুর চিড়িয়াখানাটি গড়ে তোলার জন্য। ১৮৭৬ সালের ১ জানুয়ারি (মতান্তরে ২৭ ডিসেম্বর, ১৮৭৫) প্রিন্স অব ওয়েলস সপ্তম এডওয়ার্ড কলকাতার আলিপুর অঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে চিড়িয়াখানার উদ্বোধন করেন। ১৮৭৬ সালের ৬ মে চিড়িয়াখানাটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সেই সময় ভারতীয় রেল স্টেশনগুলির বৈদ্যুতিকরণের দায়িত্বে ছিলেন জার্মান ইলেকট্রিসিয়ান কার্ল লুইস সোয়েন্ডলার। তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যানের পশুপাখি এই চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়। ব্রিটিশ ও ভারতীয় অভিজাত ব্যক্তি, সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও উপহার গ্রহণ করা হয়। পরে ১৮৮৬ সালে বারাকপুরের চিড়িয়াখানার জীবজন্তুগুলিও এখানে আনা হয়। নবকলেবরে পথ চলা শুরু হয় আলিপুর চিড়িয়াখানার। ক্রমে বাড়তে থাকে এর আকর্ষণ, জনপ্রিয়তা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে বারাকপুরের চিড়িয়াখানা। তবে বারাকপুরের ‘চিড়িয়া মোড়’ এখনও সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে।