গৃহসুখ বৃদ্ধি ও সপরিবারে আনন্দ উপভোগ। অন্যের দোষের দায়বহন করতে হতে পারে। ... বিশদ
সেকালের কলকাতায় হুঁকো শৌখিন সুন্দরীর সাবলীল টান দেওয়া দেখে সে ছবি কথার পরিবর্তে রং-তুলির রেখায় ফুটিয়ে তোলার ইচ্ছে প্রকাশ করা হয়েছিল ১৭৮৪ সালে প্রকাশিত সোফিয়া গোল্ডবার্নের ‘হার্টলে হাউস’ উপন্যাসে। লেখিকা তার সঙ্গে জানাচ্ছেন যে, এদেশের অভিজাত মহিলা মহলে সুসজ্জিত হুঁকোয় টান দেওয়া ছিল খুব সাধারণ এক রীতি। সেই হুঁকোয় সাধারণ জলের পরিবর্তে তাতে ভরা হতো গোলাপ জল। চীনে মাটির ছিলিমের উপরে বসানো থাকত রুপোর ফিলিগ্রি কাজ করা ছিদ্রযুক্ত ঢাকনা। আলবোলা বা লম্বা সুসজ্জিত নল ধূমপানকারীর নাগালের মধ্যে এনে দিত মৌতাত।
নবাব বাদশাদের অন্দরমহলে মহিলাদের হুঁকো ব্যবহারের প্রচলন ছিল বহু দিন। তাদের থেকেই এদেশীয় মেমসাহেবরা এই নেশা রপ্ত করেন। এমন মনে করার সব থেকে বড় প্রমাণ কলকাতার ইতিহাসের বিখ্যাত ‘বেগম’ জনসন। পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লর্ড লিভারপুলের মাতামহী এই মহিলার সখ্য ছিল সিরাজ-উদ-দৌলার মা আমিনা বেগমের সঙ্গে। সেই সুবাদে নিজের পরিচয়ে ‘বেগম’ শব্দটির মতো দৈনন্দিন আচার ব্যবহারেও যুক্ত করেছিলেন নানা নবাবি আদব কায়দা। দেশি কায়দায় বিছানো ফরাসের ওপর তাকিয়া হেলান দিয়ে আলবোলায় টান দিতে দিতে তিনি গল্প করতেন নিজের রামধনু রঙে রাঙানো দীর্ঘ জীবন কাহিনির। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত সেকালের কলকাতা।
অষ্টাদশ শতকের কলকাতার খানাপিনা আসরে বা পার্টিতে কোনও মহিলা যদি সমবেত পুরুষদের মধ্যে কারও হুঁকোর স্বাদগ্রহণ করার প্রস্তাব দিতেন, সেটা সেই পুরুষের জন্য সর্বোচ্চ প্রশংসা হিসেবে বিবেচিত হতো। সামাজিক মেলামেশার সুশীল রীতি হিসাবে মহিলার হাতে আলবোলা তুলে দেওয়ার আগে একটি নতুন মুখপত্র বা নলের মুখ লাগিয়ে দিতেন সেই সৌভাগ্যবান ভদ্রলোক। সব সময় হুঁকোর অতিরিক্ত মুখপত্র পকেটে নিয়ে ভোজসভায় হাজির হতেন সেকালের ‘লেডি-কিলার’ সাহেবরা। সেগুলি আর অনেক সময় সোনা দিয়ে তৈরি হতো। দামি হীরে জহরত বসানো সোনার হুঁকো রীতিমতো বিক্রি হতো কলকাতায়। শহরের বিখ্যাত মণিকার পঞ্চাশ হাজার টাকা দামের হুঁকো বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিতেন দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায়। প্রিয় পুরুষের হুঁকোয় টান দিতে না চাইলেও মহিলা মহলে অনুরাগ প্রদর্শনের আরও একটি চালু রীতির সঙ্গে জুড়ে ছিল হুঁকো। মহিলারা নিজের স্বামী বা প্রিয় পুরুষের হুঁকো বসানোর সুন্দর ম্যাট নিজের হাতে বুনে দিতেন।
মেমসাহেবদের তামাকের আসক্তির আরও একটি ঘটনা বলে সাহেবদের কথায় যাব। ১৮২৯ সালে মিসেস ফেন্টন নামে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক কর্তার স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় পা রাখলেন। শহরে তাদের প্রথম ক’দিন থাকার ব্যবস্থা হয় পূর্বপরিচিত মিঃ ক্লিল্যান্ডের গার্ডেনরিচের বাড়িতে। প্রতিটি খানার শেষে বাড়ির বউ-ঝিদের সমবেত চুরুট প্রজ্বলন দেখে অতিথি ভদ্রমহিলা যে আশ্চর্য হওয়ার কথা লিখেছিলেন, সেটাই মনে হয় আজকের লব্জে ‘কালচারাল শক’।
সাহেবদের মধ্যে হুঁকোর জনপ্রিয়তা ছিল প্রায় সর্বব্যাপী। সামাজিক ভোজে দেখা যেত যে ডেজার্ট পরিবেশন করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় অতিথিদের ব্যক্তিগত হুঁকোবরদার হুঁকো নিয়ে প্রবেশ করত খাওয়ার জায়গায়। তারপরেই জায়গাটা ভরে যেত ধোঁয়া আর আলবোলায় টান দেওয়ার ‘গুড়ুক গুড়ুক’ শব্দে। এই শব্দের জন্যই সাহেবরা হুঁকোর নাম দিয়েছিলেন ‘huble-buble’। হুঁকো ছাড়া স্বয়ং বড়লাটের ভোজসভার আয়োজনও সম্পূর্ণ হতো না। ১৭৭৯ সালে সস্ত্রীক গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস কলকাতার অভিজাত নাগরিকদের একটি ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন। সেই পার্টির নিমন্ত্রণ পত্রে হুঁকোবরদার ছাড়া অন্য কোনও ভৃত্য না নিয়ে আসতে অনুরোধ করা হয়েছিল অভ্যাগতদের।
আঠারো শতকের ব্রিটিশ কেরানিকুলের সদস্যরা বার্ষিক দু’শো পাউন্ড মাইনে পেলেও হুঁকোবরদার সহ তাম্বাকু সেবনের সম্পূর্ণ ব্যবস্থা বজায় রাখতেন। তবে পাঠক যদি মনে করেন যে, তার জন্য সাহেবদের প্রচুর খরচ করতে হতো, তা কিন্তু নয়। সপ্তদশ শতকের পর্তুগিজ পর্যটক সেবেস্তিয়ান মেনেরিক দেখেছিলেন যে, ভারতের আরও নানা জায়গার সঙ্গে বাংলাতেও তামাক উৎপাদন হতো। সুতরাং তামাকের দাম খুব বেশি ছিল না। ১৭৫৯ সালে কলকাতার জমিদার হলওয়েল সাহেব গৃহসহায়কদের যে মজুরির তালিকা অনুমোদন করেছিলেন, সেখানে হুঁকোবরদারের মজুরি আলাদা করে নির্দিষ্ট করা না থাকলেও বোঝা যায় যে, তাদের মজুরিও খুব বেশি ছিল না। কারণ সর্বোচ্চ মাসিক মজুরি হিসাবে ৫ টাকা দেওয়া হতো বাড়ির মুখ্য খানসামাকে।
১৮১১ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত এক কাব্যসংগ্রহে হুঁকো নিয়ে পুরো একটি কবিতার দেখা মেলে। পেশার তাগিদে বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে থাকা নামহীন কবি তার প্রাণের শান্তি, মনের আরাম আর আত্মার আত্মীয় খুঁজে পেয়েছিলেন হুঁকোর মধ্যে। সাহেবদের কাছে হুঁকোর সঠিক মর্ম বুঝতে সেই কবিতার একটি স্তবক পড়ে দেখুন—
‘When thoughts of home come o’er my mind—
Of distant friends I’ve left behind,
In what can I then comfort find?—
My Hookah.’
উনিশ শতকের মাঝের দশকগুলি পর্যন্ত হুঁকো বিলাসী সাহেবদের খোঁজ পাওয়া যায় বিভিন্ন লেখায়। সংখ্যাটা অবশ্যই আগের শতক থেকে কমে এসেছিল। বাস্টিড সাহেব তার পুরনো কলকাতার স্মৃতিচারণে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত হুঁকোর ব্যবহারের কথা শুনিয়েছেন উচ্চকোটির শ্বেতাঙ্গ সমাজে। তবে উনিশ শতক থেকেই সর্বজনীন জায়গায় হুঁকোর ধোঁয়া নিয়ে টুকটাক বিরক্তি ছাপা হতে থাকে খবরের কাগজে। হুঁকোর ধোঁয়ায় প্রচণ্ড বিরক্ত এক পত্রলেখক ১৮২২ সালে ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ পত্রিকায় নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে দাবি করেছেন চিঠিটি প্রতি মাসে একবার করে ছাপার, যতদিন না সমাজ থেকে প্রথাটি একেবারে নির্বাসিত হয়!
উনিশ শতকের শেষ বা তারও খানিক আগে থেকে সাহেবদের মধ্যে হুঁকো টানার প্রচলন উঠে গেলেও এদেশীয় সমাজে এই নেশা টিকে ছিল একবিংশ শতকের শুরুর দিকেও। তবে আজকাল রথের মেলার ঘাড় নাড়া বুড়ো ছাড়া কারও হাতেই আর হুঁকো দেখা যায় না।