শত্রুরা পরাভূত হবে। কর্মে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের জন্য ব্যয়-বৃদ্ধির যোগ আছে। কোনও ... বিশদ
একদিন হঠাৎই তা ঘটে যেতে পারে। কী করে ঘটে যাবে তা আমি জানি না। সব কিছুতে কি মানুষের হাত থাকে? আমি নিজে যদি না ঘটিয়ে থাকি, আমার অজ্ঞাতেই তা ঘটার সময় ও পটভূমি তৈরি হতে থাকে। তার পিছনে অজ্ঞাতজনের যেমন হাত থাকে, হাত থাকে এই প্রকৃতিরও। মহাপ্রকৃতি আমাদের জননী। আমরা তার গর্ভ থেকেই এই পৃথিবীতে পা দিয়েছিলাম। ৪০ বছর আগের কথা। তখন আমি বঙ্গোপসাগরের উপকূলে দীঘায় থাকি। একা মানুষ। একটি ছোট, সস্তার আবাসিক হোটেলে ঘর নিয়ে থাকতাম। তখন মাসিক ভাড়া ৬৫ টাকা। ওই হোটেলেই লাঞ্চ এবং ডিনার। সারাদিন অফিস কাছারি করে বিকেলে ঘরে ফেরা। সেই সময় একদিন আচমকা এক গৌরবর্ণ সাহেব এসে ঘরে উঁকি মারল, ‘হ্যালো।’ গেরুয়া ধুতি, গেরুয়া পাঞ্জাবি, সোনালি চুল, নীল নয়ন। কী রূপ সেই হিপি সাহেবের। হিপি সাহেব ঘুরতে ঘুরতে, মথুরা-বৃন্দাবন করতে করতে বঙ্গোপসাগরের কূলে এসে ঠাঁই নিয়েছে। তখন বর্ষাকাল। এমনিতেই ভ্রমণকারীর চাপ নেই সেখানে। আমার পাশের ঘরটিতে সাহেব এসে আস্তানা গেড়েছে। তার সঙ্গীরাও আসবে। তারা গিয়েছে নদীয়ার মায়াপুরের দিকে। সেখান থেকে ফিরে এলেই সাহেব তাদের নিয়ে পুরীধাম যাবে। সাহেব কিন্তু ফরাসি। ফরাসি ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষা জানে না। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি। আমার ছিল একটি গ্রামোফোন। আর ছিল বাংলা গানের অনেক রেকর্ড। সেই সাহেব, ফ্রেদরিক, সন্ধ্যায় আমার ঘরে বসে গান শুনত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে মুগ্ধ ছিল। সেতার শুনত তন্ময় হয়ে। আসলে সে সুরেই মজেছিল। বাংলা এক বর্ণ বুঝত না। ভাঙা ইংরেজিতে তারিফ করত। এক গান দু’বার শুনত। সাহেব হিপি ফরাসি ভাষায় কবিতা লিখত। আমাকে সে শোনাত। আমি ফরাসি জানি না। কিন্তু মনে হতো তারিফ করা উচিত। আমি ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো, বালজাক, গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের কথা বলতে খুশিতে ঝলমল করে উঠত ফ্রেদরিকের মুখ। আসলে ভিনদেশে বসে এক তরুণের মুখে নিজের ভাষার লেখকের কথা শুনলে আনন্দ হবেই। ফ্রেদরিকের একটা কাজ ছিল ভোরবেলা সমুদ্রতীরে গিয়ে কিছু মেয়েপুরুষ জুটিয়ে খোল করতাল সহযোগে কীর্তন করা। একটা কীর্তনের দল ছিল ওখানে, তাদের সঙ্গেই ফ্রেদরিক মিশে গিয়েছিল। সে করতাল বাজিয়ে হরে রাম হরে কৃষ্ণ গেয়েই যেত। ফ্রেদরিক বেশ ছিল। একদিন এক মাছ ধরার ট্রলারে করে গভীর সমুদ্রের ভিতর থেকে ঘুরে এল। এক একদিন সে রাতে ফিরত না। জেলেদের ঝুপড়িতে নাকি তার রাত্রিবাস হয়েছে। সারারাত সে সমুদ্র দেখেছে। ফ্রেদরিক বলত, সমুদ্রই লর্ড কৃষ্ণ। এক সন্ধ্যায় ফ্রেদরিক একটি মস্ত বই নিয়ে এল তার ঘর থেকে। ফরাসি কবি বোদলেয়ারের সংকলন। অমন বই আমি আর দেখিনি। সোনার জলে আঁকা তার নাম। আয়তনে ২৫০০ পাতা হবে হয়তো। না, অত পাতা নয়, তার ভিতরে ছিল অসামান্য সব পেইন্টিং। সেগুলি বিশেষ আর্ট পেপারে ছাপা। আর বইয়ের কবিতা ও প্রবন্ধ ছাপার কাগজের ঘনত্ব ছিল অনেক। ফলে বইটির আয়তন বেড়ে গিয়েছিল। বইয়ে ছিল বোদলেয়ারের ফরাসি কবিতা, ইংরেজি অনুবাদ, পাশে বিখ্যাত চিত্রকরদের আঁকা ছবি। বোদলেয়ারের উপর পৃথিবীর সব দেশের লেখক, সমালোচকের লেখা। আমি সম্ভ্রমের সঙ্গে বইটিতে হাত রাখলাম। পাতা উল্টে উল্টে দেখলাম জগদ্বিখ্যাত পেইন্টারদের আঁকা ছবি। ফ্রেদরিক আমাকে বলল, সে জেলেদের ঝুপড়িতে গিয়ে থাকবে, তার বইটি আমি রাখব কি না। ঝুপড়িতে ওই বই নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বর্ষাকাল। বই নষ্ট হয়ে যাবে। ওই বইয়ের কোনও দাম হয় না। হোটেলের ঘর ছাড়ছে ফ্রেদরিক, কারণ সে সারাদিন সমুদ্র দেখতে চায় সমুদ্রের ধারে থেকে। আমাদের হোটেল থেকে সমুদ্র দূরে, গর্জনও শোনা যায় না। সে জ্যোৎস্না রাতে জেগে থাকতে চায় সমুদ্রতীরে। সমুদ্রই লর্ড কৃষ্ণ। সে কৃষ্ণের কাছাকাছি থাকতে চায়। আমি মুগ্ধ হয়ে সেই রূপবান কৃষ্ণপ্রেমী আমার বয়সি যুবককে দেখছিলাম। কতদূর ফরাসি দেশ। ইংলিশ চ্যানেল, শেন নদীর তীরে পারি শহর, আইফেল টাওয়ার। ফরাসি আর ইংরেজদের ভিতর খুব দ্বন্দ্ব, ফরাসিরা ইংরেজি বলতেই চায় না শুনেছি। ফ্রেদরিক তাই ইংরেজি তেমন জানত না। তবে কাজ চালাতে পারত। আমার কাছে বইটি রেখে ফ্রেদরিক সেই হোটেল ছেড়ে চলে গেল জেলেদের অস্থায়ী ঝুপড়িতে। ইলিশের সিজন। তারা সন্ধেয় ইলিশের নৌকো ভাসায়, পরদিন সকালে ফিরে আসে মাছ নিয়ে। তবে সবদিন সমুদ্রে যাওয়া হয় না। যেদিন দুর্যোগ আসে। নিম্নচাপ। ঝড় আসে। সমুদ্র ছেড়ে তারা চলে আসে। আমি এক বিকেলে ফ্রেদরিকের দেখা পেলাম। দূর দিগন্ত থেকে মেঘ উঠে আসছিল, সমুদ্র কালো হয়ে গিয়েছে মেঘের রঙে। ফ্রেদরিক বলল, সমুদ্র দেখে তার আশ মেটে না, গডেস মাদার কালী। মা কালীর রূপ দেখছিল ফ্রেদরিক সেই সমুদ্রের ভিতর। আষাঢ় গেল, শ্রাবণ গেল, ভাদ্র এল। ভাদ্রের শেষে এল ভয়াবহ ঝড়। তখন ঝড় আসার এত নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলতে পারত না আবহাওয়া অফিস। মেঘ ছিল। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। তারপর উঠল হাওয়া। দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত বাতাসের তাণ্ডব চলল, বৃষ্টি চলতে লাগল সারারাত। পরদিন সকালে সব পরিষ্কার। আমার ভিতরে উদ্বেগ ছিল, ঘুম হয়নি রাতে। ভোর হতে ছুটলাম আমি ফ্রেদরিকের খোঁজে। সব তছনছ হয়ে গিয়েছে। ঝুপড়ি উড়ে গিয়েছে। সাহেব কোথায়? সাহেব? বেঙা নামের আধবুড়ো জেলে বলল, সবাই পালিয়ে গেলাম বাবু, সাহেব বলল, যাবে না। সাহেব সমুদ্রের রূপ দেখতে রয়ে গিয়েছিল। বলল সমুদ্দুর নাচে, মা কালী, কেষ্ট ঠাকুর সব নাচে। হায় হায়, সাহেব কোথায় গেল?
ফ্রেদরিক উধাও হয়ে গিয়েছিল। আর দেখা যায়নি তাকে। মহাপ্রকৃতি তাকে নিয়ে গিয়েছিল হয়তো। আমার কাছে সেই বইটি এখনও রয়ে গিয়েছে। ভাবি, একদিন, নিশ্চয় হঠাৎ ফ্রেদরিকের চিঠি আসবে, ফ্রেদরিকের ই-মেল আসবে, ‘অমর, আমার সেই বইটি আমি তোমাকেই দিলাম।’ না এলে কী করে ভাবি ওই বই আমার? পরের ধন কতদিন আগলে রাখা যায়?