শত্রুরা পরাভূত হবে। কর্মে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের জন্য ব্যয়-বৃদ্ধির যোগ আছে। কোনও ... বিশদ
১
ছেলেবেলা থেকেই নিলডাউনে অভ্যস্ত। ওই যে আমাদের স্কুল, এই বাড়ির ছাদ থেকেই দেখা যায়। প্রায় একশো বছরের প্রাচীন। ক্লাসরুমের বাইরে একটা রক ছিল, সেইখানেই প্রথম পিরিয়ড থেকে শেষ পিরিয়ড পর্যন্ত হাঁটু গেড়ে, কান ধরে বসে থাকতুম। হেডস্যার বলেছিলেন, ‘এই ছেলেটা নিলডাউনে রেকর্ড করেছে।’ তাই বলি লকডাউন আমার কী করবে!
তবে এই লকডাউনের সময় আবার আমার স্মৃতিতে ওই স্কুলটি এতদিন পরে ফিরে এল। অলিতে, গলিতে স্মৃতি জমে আছে। এখন প্রাচীন হয়েছে। সামনের মাঠের শিশু গাছ দু’টি ঝড়ে উপড়ে গিয়েছে। বেশিরভাগ ঘরই ভাঙাচোরা। সেকালের অনেক বড় বড় শিক্ষকরা এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়েছেন। ভীষণ মনে পড়ে ভবানীবাবুর কথা। আমরা ‘ভ’ টা বাদ দিয়ে বলতুম বানী স্যার। তাঁর লম্বা ঝোলা পাঞ্জাবির ডান পকেটে থাকত প্রচুর বাতাসা। আমাদের শাসন করার আগে দু’টি বাতাসা মুখে ফেলে এক ঢোঁক জল খেয়ে বেতটি তুলে নিতেন। ভালো করে দেখে নিয়ে, মোটা দিকটি মুঠোয় ধরতেন আর সরু দিকটি আমাদের ওপর অকৃপণ বর্ষণের জন্য মুক্ত থাকত। আমাদের সহপাঠী ছিল অনাথ। সে পারত না এমন কোনও কাজ ছিল না! সুন্দর গোলগাল চেহারা। বড় বড় উজ্জ্বল দুটি চোখ। সে একদিন কীভাবে যেন স্কুলের একবারে তিনতলার ছাদে উঠে গেল। ব্রিটিশ আমলের বাড়ি। সেখানে একটা গম্বুজ ছিল। কোনও এক সময় একটি ঘড়িও লাগানো ছিল। ওই গম্বুজে ছিল বাদুড়ের বাসা। ছাদটা তালা বন্ধই থাকত। অনাথ গাছ বেয়ে ছাদে উঠেছে। সঙ্গে নিয়েছিল একগাদা পাথরের কুচি। এই অনাথকে বানী স্যার পিটে পিটে কিছুতেই বাগে আনতে পারেননি। তার কাণ্ডকারখানা নিয়ে একটা বই লেখা যায়।
বানী স্যার একদিন তাঁর ঘরে ভিক্টোরিয়ান চেয়ারে হেলান দিয়ে একটু নিদ্রাসুখ উপভোগ করছেন। মৃদুমন্দ নাসিকাগর্জন। অনাথ হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের তলায় ঢুকে স্যারের একপাটি জুতো নিয়ে উধাও হল। নিদ্রাভঙ্গের পর তিনি পা গলাতে গিয়ে দেখলেন— ডান পাটিটা আছে, বাঁ পাটিটা নেই। এক পায়ে জুতো পরে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরের করিডরে দাঁড়িয়ে একটা হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘হোয়্যার ইজ মাই আদার পাটি?’
নিতাই স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, আপনার পায়ের মাপ আর আমার পায়ের মাপ একই।
বানী স্যার উগ্র গলায় বললেন, তাতে কী?
অনেক সময়ে কুকুরে জুতো নিয়ে যায়। আপনি আমার জুতো পরতে পারেন।
বানী স্যার গম্ভীর গলায় বললেন, পায়ের মাপ এক হলেও পদ মর্যাদায় আলাদা। গুরুর পা, শিষ্যের পা, প্রভুর পা, ভৃত্যের পা— পায়ে পায়ে অনেক তফাত। স্কুলের ভেতর দোতলায় কুকুর কী করে আসবে?
নিতাই স্যার আমতা আমতা করে বললেন, আমাদের দরোয়ান রামাধরের একটা কুকুর আছে।
রামাধর কো বোলাও।
বানী স্যার জিজ্ঞেস করলেন, রামাধর তোমার কুকুর কোথায়?
সে কাঁচুমাঁচু মুখে বললে, সে নেই স্যার। তিনদিন তার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না!
বানী স্যার বললেন, তোমার কুকুর আমার জুতো নিয়ে গিয়েছে।
অনাথ এইসময় একপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে খুব উত্তেজিত হয়ে বললে, ওই তো, ওই তো স্যার আপনার জুতো গাছের ডালে ঝুলছে।
পণ্ডিতমশাই একটু মন্তব্য জুড়লেন, ‘সুফল, কুফল, নিমফল, বটফল, কর্মফল— এত রকমের ফলের কথা শুনেছি, জুতোফল এই প্রথম দেখছি। ওটি কাঁচা না পাকা!’
বানী স্যার বললেন, পণ্ডিতমশাই, এটা রসিকতার সময় নয়। আমি বিপন্ন এবং অপদস্থ।
অনাথ বিনীতভাবে বললে, ‘স্যার জুতোটা পেড়ে আনি?’
এই অনাথ, সে হঠাৎ স্কুল ছেড়ে চলে গেল। তিন-চার দিন পরে খবর পেলাম সে গঙ্গার ওপারে যে আশ্রম আছে সেখানে রয়েছে। সন্ন্যাসী হবে।
আমি দেখা করতে গেলাম। অনাথ বেরিয়ে এল। তার চোখমুখ আরও উজ্জ্বল।
আমি বললুম, কী রে! তুই লেখাপড়া ছেড়ে দিলি!
অনাথ বললে, আমি একটু অন্য ধরনের লেখাপড়া করব রে। ওই অ-এ অজগর আসছে তেড়ে/আ-এ আমটি খাব পেড়ে— এই পাঠটি আমার জন্য নয়। অজগর আমাকে তেড়ে আসবে না। আর আম পাড়ব অন্যের জন্যে, নিজের জন্য নয়।
ফিরে এলাম। স্কুলের স্যাররা বলতে লাগলেন, ও ছেলে সাঙ্ঘাতিক ছেলে! সৈন্যবাহিনীতে গেলে মেজর জেনারেল হতো। রাজ্যশাসনে গেলে সম্রাট হতো। বানী স্যার কিছুই বললেন না।
বয়স হয়েছে। বানী স্যার অবসর নিলেন। স্কুলের মাঠে সংবর্ধনা সভার আয়োজন হয়েছে। হঠাৎ অনাথ এসে হাজির। মুণ্ডিত মস্তক, গেরুয়াধারী। স্যারের সামনে হাতজোড় করে নত হয়ে বললে, আপনাদের অনেক জ্বালিয়েছি স্যার। প্রণাম করার উপায় নেই আমি সাধু। শুধু এই কথাটি বলি, আপনাদের শাসনে আছে প্রেম। তারই কিছুটা আমাকে দিন। সাতদিনের মধ্যেই আমি উত্তরভারতে চলে যাব। সেখানে দুর্ভিক্ষ হয়েছে। আশীর্বাদ করুন স্যার, যেন হাসতে নয়, আমি কাঁদতে শিখি।
বানী স্যার উঠে দাঁড়ালেন। অনাথকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। দু’চোখে জল। অনাথ তার ঝোলা থেকে একটা ঝকঝকে থালা বের করে টেবিলের ওপর রাখল। তার উপর ঢেলে দিল এক ঠোঙা বাতাসা। তার মাথায় রাখল একটা ফুল। স্বামীজির ভঙ্গিতে বুকে দু’হাত রেখে দাঁড়িয়ে বললে, স্যারের পাঞ্জাবির পকেট থেকে অনেক বাতাসা বের করে খেয়েছি। সেই স্নেহ দিয়ে তাঁর চরণ দু’টি পূজা করি। শিক্ষা আর শিক্ষক এই হল আমাদের মেরুদণ্ড।
এইবার বানী স্যারের বক্তব্য। তিনি বললেন, যে বেত্রদণ্ড দিয়ে প্রতিদিন আমি অনাথকে প্রহার করেছি, সেই দণ্ডটি প্রতীক হিসেবে আমি তার হাতে তুলে দিতে চাই। বেত্রদণ্ডটি যেন তার হাতে ন্যায় দণ্ড হয়ে ওঠে। এইসব ছাত্ররা আমার প্রাণ। আমি নিলডাউন হয়ে প্রার্থনা করি, তোমরা এই জগৎকে এগিয়ে নিয়ে যাও। ভালোর দিকে, আলোর দিকে।
অনেক পরে প্রবীণ সন্ন্যাসী অনাথের সঙ্গে দেখা হল। সে তখন খুব নামকরা সন্ন্যাসী। বেত্রদণ্ডটি দেখিয়ে বলল, এই দেখ, এইটাই আমার শিক্ষা, এইটাই আমর ধর্ম, এইটাই আমার চলার শক্তি।