শত্রুরা পরাভূত হবে। কর্মে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের জন্য ব্যয়-বৃদ্ধির যোগ আছে। কোনও ... বিশদ
পর্ব- ২৭
চলচ্চিত্র জগতে অনেকেই অভিনয় করতে আসেন রূপের জোরে। কেউ আসেন টাকার জোরে। কেউ আবার আসেন প্রথাগত ডিগ্রি নিয়ে। এর কোনও কিছু না থেকেও ১৯৩২ থেকে ১৯৬১— তিন দশক ধরে আমৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রকে একের পর এক রত্ন উপহার দিয়ে গিয়েছেন তুলসী চক্রবর্তী। আটপৌরে ধুতি, গলায় পৈতে। জীবনে এক ফোঁটাও মেকআপ করে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াননি।
কখনও তিনি ‘পথের পাঁচালি’র প্রসন্ন পণ্ডিত। কখনও ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর মেস-মালিক রজনীবাবু। আবার কখনও ‘একটি রাত’ ছবির সন্দেহপ্রবণ সরাইখানার মালিক গোঁসাইজি। অনবদ্য অভিনয়ে ম্লান হয়ে যায় আশপাশের তারকা, মহাতারকারা। দেখিয়ে গিয়েছেন নিজের চেষ্টা আর কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে কিংবদন্তি হওয়া যায়। অভিনয় দিয়ে দর্শকদের মনে গভীর রেখাপাত করা যায়।
তবে সেক্ষেত্রে বলতেই হয় অভিনয়ের প্রাথমিক পাঠটা তুলসীর জবরদস্ত হয়েছিল। স্টার থিয়েটারে অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের তালিম দেওয়ার ঘটনা নিজেই বলে গিয়েছেন তুলসী। অপরেশবাবুকে ‘স্যার’ সম্বোধন করতেন তিনি। বলতেন, ‘স্যার বেশি জোর দিতেন বাচনিক অভিনয়ের উপর। কোন চরিত্র কী ধরনের স্বরক্ষেপণ করবে সেটা ধরে ধরে শেখাতেন।’
এই অভিনয় শিক্ষা নিয়েই একটা মজার ঘটনা। তখন স্টার থিয়েটারে কয়েক বছর কাটিয়ে ফেলেছেন তুলসী চক্রবর্তী। একদিন রিহার্সাল চলছে। অপরেশবাবু একটা সাধারণ সংলাপ তুলসীকে একটু চেঁচিয়ে বলার নির্দেশ দেন। এই সময় একটা কাণ্ড করে বসেন তিনি। ঘরভর্তি লোকের সামনে প্রশ্ন করে বসেন, ‘স্যার, এটা কি অত জোরে বলার দরকার আছে?’
অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের মুখের উপর কারও কথা বলার উপায় ছিল না। প্রশ্নটা শুনে তিনি খানিক তাকিয়ে রইলেন। তারপর তুলসীকে বললেন, ‘তোকে আজ আর রিহার্সাল দিতে হবে না। বাড়ি যাওয়ার আগে দেখা করে যাস আমার সঙ্গে।’
স্যারের কথা শুনে তুলসী তো প্রমাদ গুনলেন। ধরেই নিলেন, তাঁর আজই ছুটি হয়ে গেল। অভিনয় শেখা ঘুচে গেল। রিহার্সাল শেষ হয়ে যাওয়ার পর সবাই যখন চলে গেল তখন অপরেশবাবু তুলসীকে ডেকে পাঠালেন। তুলসী যেতেই অপরেশ মুখুজ্যে হলের পিছনের সারির দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওইখানে বসে যে লোকটা থিয়েটার দেখে সে হল পাবলিক। ওরা থিয়েটারের লক্ষ্মী। টিকিট কেটে ওরা আসে। ওদের ভালো লাগা-মন্দ লাগার উপর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভাগ্য নির্ভর করে। অভিনয় ভালো লাগলে ওরা বাইরে গিয়ে মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করে। থিয়েটারের মালিকদের কাছেও ওদের মতামতই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তা তোমার ডায়লগ যদি পিছনের সারির ওই লোকটির কানে না পৌঁছয়, তাহলে কী হবে জানো?
স্যারের এই প্রশ্নে তুলসী চুপ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
অপরেশবাবু তখন বললেন, ‘তোমার প্রশ্নটা খুবই সঙ্গত এবং সঠিক। আমরা তো ব্যবহারিক জীবনে অত চেঁচিয়ে কথা বলি না। কিন্তু থিয়েটারে এটা করতেই হয়। ওই পিছনের সারি থেকে একবার যদি লাউডার প্লিজ আওয়াজ ভেসে আসে তাহলে তার পরদিনই থিয়েটার মালিক বলবে, তোমার গলায় জোর নেই। তুমি এসো বাপু।’
তাই থিয়েটারে একটু চেঁচিয়ে সংলাপ বলতেই হবে। নাহলে অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। তাই যে কোনও অভিনেতাকে তার অভিনয়ের অংশকে দুটো ভাগে ভাগ করতে হয়। একটা অংশ নিজের জন্য। আর অন্য অংশ রাখতে হয় দর্শকের জন্য। অপরেশবাবু বুঝিয়ে বললেন, ‘দুটো ভাগের একটা ডায়লগ পোর্শন আর অন্যটা হল সাইলেন্ট পোর্শন। ডায়লগ পোর্শনে একেবারে নাভিস্থল থেকে আওয়াজ বের করে এনে সংলাপ বলবে। আর সাইলেন্ট পোর্শনে তুমি একেবারে ন্যাচারাল বিহেভ করবে। সেখানে বাড়াবাড়ি করলে বা পাকামি করলে দর্শক সহ্য করবেন না।’
অপরেশবাবুর এই উপদেশ সারাজীবন মনে রেখেছেন তুলসী চক্রবর্তী। সিনেমায় অ্যাক্টিং করার সময় এই ‘ন্যাচারাল বিহেভ করার উপদেশ’ তাঁর দারুণ কাজে এসেছে। যদিও ‘অভিনয়’ যে তিনি করতে পারেন সেটা কখনও স্বীকার করতেন না। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘অভিনয় আমি তেমন বুঝি না। স্ক্রিপ্টের খাতায় যা লেখা থাকে, স্টেজে দাঁড়িয়ে সেটাই গড়গড় করে আওড়ে যাই। প্রম্পটিংয়ের ধার ধারি না। কো-অ্যাক্টররা এদিক-ওদিক সংলাপ বলে বিপদে ফেললে তখন আত্মরক্ষার জন্য দু-একটা বাড়তি কথা আমাকেও বলতে হয়। নইলে নিজের ক্যারেক্টার নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার কথা মাথায় আসে না। বেশিরভাগ যা রোল করেছি সেগুলোকে ক্যারেক্টার বললে তো ক্যারেক্টারেরই অপমান করা হয় গো।’
এমনই আমুদে মানুষ ছিলেন তিনি। সার্কাসে ছিলেন বলেই বোধহয় ভালো জাগলারি করতে পারতেন। স্টারে একসঙ্গে কাজের সুবাদে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল তুলসী চক্রবর্তীর। ভানু-পুত্র গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘বাবা বলতেন, অঙ্গভঙ্গি না করেও যে হাসানো যায় তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ চ্যাপলিন। আর আমাদের দেশে তুলসী লাহিড়ী ও তুলসী চক্রবর্তী। এতবড় অভিনেতা অথচ কত কম পয়সা পেয়েছেন। বাবার সঙ্গে আমি ছোটবেলায় স্টার থিয়েটারে যেতাম। তখন স্টারের সেকেন্ড গেটের বাইরে এক জায়গায় বসে তুলসী জেঠু আমাকে চারটে বল নিয়ে জাগলারির খেলা দেখাতেন। কত মানুষ ভিড় করে দেখত।’
তুলসী চক্রবর্তীর জীবনের একটি ঘটনা শোনালেন গৌতম। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কাঞ্চনমূল্য’ নামে একটি ছবি প্রযোজনা করেছিলেন। ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন গৌতম। ছবিতে একটি তরজা গানের দৃশ্যে ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে শ্যুটিং চলছিল। তুলসী চক্রবর্তীর কোনও কারণে কোমর ‘স্টিফ’ হয়ে গিয়েছিল। গৌতম বললেন, ‘বাবা বলছিলেন, কোমরটা একটু বাঁকাও না তুলসীদা। উনি কিছুতেই পারছিলেন না। লজ্জায় ঘেমে গিয়েছিলেন। তারপর শ্যুটিং শেষ হতেই হন হন করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। বাবা ছুটতে ছুটতে গিয়ে ধরলেন। বলেন, ‘তুলসীদা কোথায় যাচ্ছ?’ তুলসী জেঠু বলেন, ‘শ্যুটিং শেষ, তাই চলে যাচ্ছি।’
ভানু তখন ১০০ টাকার নোট পকেট থেকে বের করে তাঁর হাতে দেন। উনি তখন ভানুকে বলেন, ‘আমার কাছে চেঞ্জ নেই ভাই।’ ভানু প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘চেঞ্জ লাগবে না। তুমি ১০০ টাকাই রাখো।’ তখন তুলসী বলে ওঠেন, ‘না, আমাকে ৭৫ টাকাই দে। রেট বাড়িয়ে দিয়েছি জানতে পারলে কেউ আমাকে ডাকবে না। আমার অভিনয় ভালো লেগেছে তো?’ ভানু তখন প্রণাম করে বলেন, ‘খুব ভালো হয়েছে। তুমি টাকাটা রাখো, কেউ জানবে না।’
আনন্দে চোখ চিকচিক করে ওঠে তুলসীর। আশীর্বাদ করে বলেন, ‘সত্যি বলছিস তো! তোর ছবি হিট করবে রে ভানু।’
‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবির তরজা গানের দৃশ্যে তুলসী চক্রবর্তী
ছবি সৌজন্যে: গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
অলঙ্করণ: সুপম সাউ