শত্রুরা পরাভূত হবে। কর্মে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের জন্য ব্যয়-বৃদ্ধির যোগ আছে। কোনও ... বিশদ
জহর রায়ের বই সংগ্রহের মজার কৌশলের কথা শোনালেন তাঁর এক সময়ের সহকর্মী ধীমান চক্রবর্তী। একদিন তিনি অমিয় নিবাসে গিয়েছেন, সেই সময় জহর ঘরে ছিলেন না। ধীমান তখন আলমারি থেকে বিভিন্ন বই বের করে নেড়েচেড়ে দেখছিলেন। এমন সময় ঘরে প্রবেশ করেন জহর। ঢুকেই তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বইগুলো ভালো লেগেছে? বাড়ি নিয়ে যাবি?’ ধীমান বললেন, ‘হ্যাঁ, দু’-তিনটে বেশ ইন্টারেস্টিং।’ জহর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘একদম নয়। গ্লাস গ্লাস চা এনে দিচ্ছি। বিস্কুটও যত ইচ্ছে খাও। যতক্ষণ খুশি থাক। কিন্তু বই নিয়ে যাওয়া নেই। বই কেউ নিয়ে গেলে আর ফেরত দেয় না।’ ধীমান বলেন, ‘দাদা, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, এমনটা হবে না।’ শুনে জহর হাসতে হাসতে বলেন, ‘তুই কী গ্যারান্টি দিবি রে! এখানে যত বই দেখছিস তার অনেকগুলো আমার এই উপায়েই সংগ্রহ করা।’
এমনই মজার মানুষ ছিলেন জহর। নিজের ছেলেমেয়েদের যাবতীয় দায়িত্ব স্ত্রী কমলাদেবীর উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতেন। কালীমায়ের বড় ভক্ত ছিলেন। ছোট মেয়ে কল্যাণীকে ‘মা’ বলে ডাকতেন। মাঝে মাঝে এসে বলতেন, ‘তুমি আমাকে কোলে নেবে তো মা?’ উত্তরে কল্যাণী তখন বলতেন, ‘আমি কী করে কোলে নেব তোমাকে, আমি তো অনেক ছোট!’ তখন অবাক জহর প্রশ্ন করতেন, ‘তুমি যেন কোন ক্লাসে পড়?’
পাটনাতে নিজের বাড়ি বা মধুপুরে বোনেদের বাড়ি খুব একটা না গেলেও নিজের শ্বশুরবাড়ি যেতেন নিয়মিত। সেখানে তাঁর কদর ছিল খুব। জহরের বাবা সতু রায়ের গান-বাজনার চর্চা ছিল। ছোট বোন হাসি ভট্টাচার্য ও ভগ্নীপতি প্রণব ভট্টাচার্য পাটনার রেডিও স্টেশনে গান গাইতেন। তাঁদের মেয়ে সুমিতা চক্রবর্তী জগজিৎ সিং-চিত্রা সিংয়ের কাছে গান শিখেছেন। জহরের এই পারিবারিক ঐতিহ্যের জন্যও কমলাদেবীর বাড়িতে তাঁর খাতির ছিল। আর জামাইটিও শ্বশুরবাড়ির সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন। এই সাঙ্গীতিক পরিবেশের গুণটা জহরের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। ‘সাহেব বিবি তোমরা বাবু, আমরা গোলাম’ আর ‘রাবণ রাজা পেয়েছে কেমন কেমন সাজা’ নামে দুটো গান লিখেছিলেন জহর। সেগুলো সুর দিয়েছিলেন তাঁর সুরকার বন্ধু বলরাম দাস। গেয়েছিলেন কার্তিক কুমার ও বসন্ত কুমার। রেকর্ডিংও হয়েছিল। যদিও রেকর্ডটা আর পাওয়া যায় না।
কল্যাণীদেবীর আক্ষেপ, ‘সেই কাজেরও দাম পেলেন না বাবা। উনি যে ভালো গান লিখতে পারতেন, সেটা কতজন জানে বলুন তো!’
নাম-যশের পিছনে কখনওই ছুটে যাননি বাংলা সিনেমার এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। নতুন বছরের শুরুতে বেশ কয়েকজন দরিদ্র ছেলেমেয়েদের বুকলিস্ট ধরে বইখাতা, জামা-কাপড় কিনে দিতেন তিনি। বাংলার বন্যাত্রাণে কমলাদেবী ১১ ভরি সোনা দিয়েছিলেন। এই ব্যাপারগুলো কমলাদেবী পছন্দ করতেন। স্বামীর হয়ে টেকনিশিয়ানদের বাড়ি গিয়ে টাকাপয়সা, জামাকাপড় দিতেন।
জহর ভালো উর্দু যেমন বলতেন, তেমনই ভালো ইংরেজিও বলতেন। প্রাইভেট টিউটর রেখে উর্দু শিখতেন। ‘মর্জিনা-আবদল্লা’ ছবিতে জহরের উর্দু উচ্চারণ তার প্রমাণ। নতুন জিনিস শেখার আগ্রহটা যে ছিল অফুরান। লাল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করে রাখতেন বই। জামাকাপড়, সুগন্ধী আর চটির খুব শখ ছিল। কত জোড়া যে জুতো ছিল! রিহার্সালে গেলে প্যান্ট-শার্ট পরতেন না, সবসময় পাজামা-পাঞ্জাবি। ধুতিও খুব প্রিয় ছিল। আর সাদা রুমাল। ধর্মতলার এক টেলার্সের কাছ থেকে জামা-কাপড় তৈরি করাতেন। মৃত্যুর পর হঠাৎ একদিন তাঁর তৈরি করতে দিয়ে যাওয়া জামা-কাপড় নিয়ে এসে হাজির হয়েছিলেন ওই দোকানের এক কর্মচারী। যার পেমেন্ট আগেই করে গিয়েছিলেন জহর।
জীবনে একটা বড় ভুল করেছিলেন এই অভিনেতা। একটি সিনেমা প্রযোজনার কাজে হাত দিয়েছিলেন। পোড়খাওয়া অভিনেতা হলেও প্রযোজনার গলি-ঘুঁজি তাঁর জানা ছিল না। বন্ধুরা তাঁকে ঠকিয়েছিল। তিল তিল করে জমানো কষ্টার্জিত টাকা সব শেষ হয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। ছবিটির কাজ মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যায়। উল্টে ঘাড়ে চেপে যায় ৭৫ হাজার টাকার দেনা। ছ’য়ের দশকে ৭৫ হাজার টাকার মূল্য নিশ্চয়ই কারও অজানা নয়।
সেই দেনা শোধ করতে গিয়েই ফাংশনের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন জহর। একেক দিন ২-৩ টি করে শো। সে ফাংশন হোক বা থিয়েটার কল শো হোক বা যাত্রা। বেড়েছিল মদ্যপানের মাত্রাও। যেটাকে জহরের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে অনেকেই মনে করেন। জহরের দোসর ভানু কিন্তু বলতেন, ‘ও ওভার ওয়ার্কে মারা গিয়েছে।’
ভানুপুত্র গৌতম বন্দ্যোপাধায় বলছিলেন, ‘বাবা বলতেন, জহর মহালয়ার দিন একটা আলোয়ান লইয়া বাইরইত। আর দোলের দিন সেই আলোয়ানটা তেল চিটচিটা কইর্যা বাড়ি ফিরা ফ্যালাইয়া দিত।’
শরীর দ্রুত ভাঙছিল। একটা সময় স্বাস্থ্যের প্রতি দারুণ নজর ছিল জহরের। ভানুর স্মৃতি বলছে, ‘বাতাসার সঙ্গে পেঁপের রস দিয়ে খেত, ছাগলের দুধ খেত।’ কিন্তু পরে লিভার আর পেরে উঠছিল না। ফিরে ফিরে আসছিল জন্ডিস। অনিয়ম করতেন। ইনসুলিন নিয়ে অনেক সময় না খেয়ে চলে যেতেন।
১৯৭৪ সালে শ্যুটিং হয় ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কোর...’। ওই সময়ই মহানায়কের সঙ্গে ‘ব্রজবুলি’। তখন চেহারা প্রায় কঙ্কাল। সিনেমার কেউ আর কাজ দিতে চায় না, এড়িয়ে যায়। রংমহলই সম্বল। ওই মঞ্চেই রিহার্সাল করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাঁর এক বন্ধুর সহায়তায় স্ত্রী কমলাদেবী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করেন। কমলাদেবী অনেকবার থাকতে চেয়েছিলেন অসুস্থ স্বামীর পাশে, কিন্তু ডাক্তাররা অনুমতি দেননি। সেই অভিমানে আর কোনওদিন মেডিক্যাল কলেজে পা রাখেননি তিনি।
ভর্তি করার পরের দিনই সকালে সেই বন্ধু এসে (জহর ‘মিত্র’ বলে ডাকতেন আর ছেলেমেয়েরা ডাকতেন ‘মিতে’) খবর দেন, জহর আর নেই। ১৯৭৭ সালের ১ আগস্ট। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছিলেন, ‘জহরের কি দেশের কাছে এইটুকুই পাওনা ছিল সৌমিত্র? অন্য দেশ হলে স্যার উপাধি পেত।’ খবর পেয়ে জহরকে শেষ দেখা দেখতে এসেছিলেন সুচিত্রা সেন। বেথুন কলেজের সামনে দাঁড়ায় শোক মিছিল। গাড়ি থেকে নেমে লরিতে ওঠেন সুচিত্রা। অস্ফুটে বলেছিলেন, ‘তুমি চলে গেলে চার্লি!’ তারপর নিচু হয়ে মৃতের কপালে এঁকে দিয়েছিলেন চুম্বন। তখন জহরের মৃতদেহের পাশে ক্লাস এইটের সব্যসাচী— তাঁর পুত্র।
জহর-কন্যা কল্যাণীর আক্ষেপ, ‘এই ভানু-জহর কোনওদিনই তাঁদের প্রাপ্য সম্মান পেলেন না। কেউই তাঁদের জন্য কিছু করেনি। এ নিশ্চিত বাঙালির লজ্জা!’
অলঙ্করণ: বিশ্বনাথ ঘোষ