শত্রুরা পরাভূত হবে। কর্মে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের জন্য ব্যয়-বৃদ্ধির যোগ আছে। কোনও ... বিশদ
‘কতদিন বলেছি, অমন পলকা রেলিংয়ের উপর আশি কেজি ওজন চাপিয়ে দিও না। পড়লে বুড়ো হাড় আর জোড়া লাগবে না তখন বুঝবে ঠ্যালা!’
নীপার খুশি মুহূর্তে উবে গেল। ওজন নিয়ে সব সময় খোটা আর কত সহ্য হয়? আসলে বিবেকদের গুষ্টিতে তো সকলের ঝ্যাটার কাঠির মতো গড়ন! মাগো- সামনে পিছনে তফাৎ বোঝে কার সাধ্যি! বড় অহঙ্কার তাই বাবুর! লোকে বলে কি না, ‘বাব্বা! বোঝাই তো যায় না বিবেকবাবুর সত্তর বছর বয়স হল!’
বসন্তের আবেশকে খান খান করে খেঁকিয়ে ওঠেন নীপা, ‘তা এমন পলকা রেলিং বানানোর সময় মনে ছিল না বউ তোমার সারা জীবন হেমা মালিনীটি থাকবে না?’
নীপার মেজাজের ঝাঁঝকে অবেলায় বাড়ানো যুক্তিযুক্ত হবে না বোধে বিবেক তার বক্তব্যে রাশ টানেন। আসল কথাটাই তালে গোলে নীপাকে বলা হল না। পই পই করে বারণ করা সত্ত্বেও নীপা এই লাঠিটা দিয়েই ফুল পাড়বে। এটি বিবেকের শৌখিন বাবার খুব পছন্দের লাঠি ছিল। হাতির দাঁতের কারুকার্য করা হাতলওয়ালা চকচকে মসৃণ কাঠের এমন লাঠি আজকাল পাওয়া দুষ্কর। বিবেক চান না নীপা এটা দিয়ে বারান্দা থেকে পাশের বাড়ির করবীফুল বা সজনেগাছ থেকে সজনে চুরি করুক। কিন্তু নীপা নাছোড়।
কথাটা নীপা ঠোনা মেরে বলল বটে তবে একেবারে মিথ্যে তো বলেনি! বিয়ের সময় নীপা তো প্রায় হেমা মালিনীই ছিল। কী করে যে পঞ্চাশ কেজি হয়ে গেল আশি কেজি সে এক বিস্ময়। তখন সাত চড়ে রা কাড়ত না আর এখন একটা কথার উত্তরে সাতটা কথা ট্যাঁক ট্যাঁক করে শোনায়। বয়স কত কিছু নেয়- রূপ যৌবন কর্মক্ষমতা! আর দেয়ও বুঝি কম না! নীপাকে তো দেখছেন, বুদ্ধি-শুদ্ধি পেকে ঝুনো বয়সের সঙ্গে সঙ্গে। বরকে তো আর তোয়াক্কাই করে না। কটর কটর কথা! মুখে মুখে তর্ক! সবজান্তা অ্যাটিচিউট!
নীপাকে দেখে বিবেকের বদ্ধ ধারণা, বয়স হলে মহিলাদের লজ্জা-ভয়ও বেশ কমে যায়। পাশের বাড়ির সজনেগুলো নির্লজ্জের মতো হাতিয়ে ডাঁটাচচ্চড়ি চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে! কত বদলে গেল বউটা। নীপা বিবেককে পিছু হটতে দেখে আর যুদ্ধে বৃথা শক্তিক্ষয় না করে করবীফুলগুলো প্লাস্টিকের প্যাকেটে সামলে সুমলে নিয়ে ভিতরে চলে যান। বুড়োর সামনে যতক্ষণ থাকবেন টিকটিক করে জ্ঞান শুনতে হবে। নেহাত বিবেকের লাঠির দিকে নজর থাকায় খেয়াল করেননি- নাহলে ঠিক বলতেন, ‘আবার প্লাস্টিকের প্যাকেট ব্যবহার করছো? জানো না প্লাস্টিক ব্যানড!’ বিবেক রিটায়ার করেছেন দশ বছর। কাজ-কম্মো না থাকলে ছেলেরা যে কি খতরনাক হয়ে ওঠে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন নীপা। ঘরে বসে বসে হাড় ভাজা ভাজা করে ছেড়ে দিচ্ছেন নীপার। সারা জীবন সংসারের হ্যাপা নীপার ঘাড়ে। চাকরি করেও বেশ ভালোভাবেই ঘর তিনিই সামলেছেন। তাদের আমলে স্বামী-স্ত্রীর বাড়ির কাজকর্ম ভাগ করে নেওয়ার মতো আধুনিকতার চল ছিল না। কিন্তু সুবিধা ছিল একটাই, বাবুটি তখন ঘরোয়া ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। কিন্তু অবসর নেওয়ার পর সেই মানুষটা আমূল বদলে গেল? সংসারের খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে ফুট-ফুট করে নাক গলিয়ে দিচ্ছেন। পদে পদে নীপার খুঁত ধরছেন। কোনও স্বাধীনতাই আর রইল না নীপার? গুরুঠাকুরের মতো ওঁর কাছে নতুন করে সংসারের পাঠ নিতে হবে যেন।
গজ গজ করতে করতে নীপা ফুলগুলো ঠাকুরঘরে রেখে চমকে ওঠেন। কে কাঁদে রে?
রান্নাঘরে কে কাঁদছে ইনিয়ে বিনিয়ে? ঈশ, কী অলুক্ষুণে কাণ্ড! নাঃ, আজকের দিনটা সুবিধের যাবে না। সক্কালবেলায় পতিদেবের বাক্যবাণ আর এখন দেখো কিচেনে পিন পিন করে সুর তুলে কাঁদছে আলুনি। আলুনি তাদের সর্ব-কর্ম পটিয়সী কাজের মেয়ে, আজ বাইশ বছর তাদের একতলার প্রশস্ত গ্যারেজঘরে থাকে। গাড়ি এবং নারীর এই শান্তিপূর্ণ দীর্ঘ সহাবস্থান পাড়া-প্রতিবেশীদের যথেষ্ট ঈর্ষা উদ্রেককারী কারণ শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, স্ট্রাইক-মিছিল কোনও কিছুই নীপার কাজের লোকের উপস্থিতি আটকায় না। আলুনির জন্য চাকরি করেও নির্ঝঞ্ঝাটে সংসার-তরণীটি বাইতে পারলেন নীপা। তবে নীপা মোটেই পাষাণ-হৃদয় নন, তিনি আলুনি না চাইতেই তাকে মাঝে মধ্যে অফ-ডে দিয়ে থাকেন।
আলুনির আসল নাম কেউ মনে রাখেনি। দুঃস্থ বিধবা বেঘর মেয়েটি অতীতে ছোট একটি বিড়ালছানার মতো শিশু কোলে নিয়ে এ বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে বেঁচে গিয়েছিল। প্রথম দিকে সব রান্নায় নুন দিতে ভুলে যেত বলে বিবেক ওর নাম দিয়েছিল আলুনি। আলুনির ছেলে হাবুল নীপার ছেলে গোগোলের সঙ্গে তাল দিয়ে বড় হল। গোগোল হাবুলকে ছোট ভাইয়ের মতোই দেখেছে চিরকাল। নীপা আবার লেখাপড়ার ব্যাপারে বেজায় কড়া ছিলেন... গোগোলের সঙ্গে হাবুলকে সমান তালে স্কুল তারপর কলেজে পড়া চালাতে হয়েছে। নীপা অফিস করেও দুই ছেলের দিকে শ্যেনদৃষ্টি রাখতেন। ফাঁকিবাজির কোনও জায়গাই ছিল না সেখানে।
আলুনি মাটিতে বসে জলখাবারের জন্য আনাজ কাটছে আর গুন গুন করে সুর তুলে কাঁদছে। যতই বিবেক নীপাকে জবরদস্ত খান্ডারনি ভাবুক চোখের জল নীপা মোটে সহ্য করতে পারে না। আলুনির এই সাত সকালে কান্নার কারণ একটা মনে মনে ঠাহর করে তিনি গলা তুললেন।
‘দেখ আলুনি, ছেলে তোর সারাটা জীবন খোকাটি হয়ে তোর কোলে থাকবে যদি ভেবে থাকিস তবে ভুল ভেবেছিস! পাঁচটা বছর হাবুল তাহলে খেটেখুটে পড়ালেখা করল কেন?’
শোবার ঘরে তখন বিবেক লুকিয়ে চুপিচুপি নিউ ইয়র্কে গোগোলকে ফোন লাগিয়ে সবে নীপার নামে নালিশ শুরু করেছিলেন, ‘আমি আর পারছি না! তোমার মা গুন্ডার মতো এই বাড়ির ফুল ওই বাড়ির ফল পাড়ছেন আর পাড়ছেন তোমার দাদুর অ্যান্টিক লাঠিটা দিয়ে...’
গোগোল বিবেককে থামিয়ে বলে, ‘বাবা, তোমরা দুজন একদম বাচ্চাদের মতো বিহেভ করছ! আসলে কাজকর্ম নেই, বোরড হয়ে যাচ্ছ, দু’জন দু’জনের পিছনে লাগছ! এমন তো ছিলে না তোমরা! এবার একবার নিউ ইয়র্ক ঘুরে যাও।’
‘আচ্ছা, পরে কথা হবে’- দ্রুত ফোন কেটে দেন বিবেক।
বাজখাঁই গলায় আবার কে জানে কী বলছেন শ্রীমতী? সর্বনাশ! ছেলেকে নালিশ করা শুনে ফেললেন কি? টেনশনে বিবেক দ্রুত ভিতরে চলে আসেন।
‘আবার কী হল? চ্যাঁচাচ্ছো কেন?’
‘চ্যাঁচাচ্ছি কী সাধে? ছেলেটা এত পাশ করল, ফিজিওথেরাপিস্ট মানে বুঝিস গাড়োল? কত টাকা মাইনের চাকরি পেল ছেলেটা, আর উনি ঠ্যাং ছড়িয়ে কাঁদতে বসলেন’- শেষের কথাগুলো অবশ্যই ক্রন্দনরতা আলুনির উদ্দেশ্যে বলা হল।
‘আহা! হাবুলটা কাল গুরগাঁও চলে যাবে!’ আলুনিকে সামান্য সাহায্যের হাত বাড়ালেন বিবেক। মনে মনে ভাবলেন সবাই তো আর তোমার মতো গ্র্যানাইট দিয়ে তৈরি নয়? গোগোল বিদেশে চলে গেল, মহিলা একটুও টস্কালেন না! কী? না, ছেলের মনখারাপ করবে- ছেলের অমঙ্গল হবে! তবে বিবেকের চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নয়! বাথরুম থেকে মহিলাকে ফোলা ফোলা লাল চোখে বেরুতে দেখেছেন তো বিবেক।
‘আলুনি তো আর তোমার মতো শিক্ষিত অফিসার মা নয়? ওদের একটু গলা ছেড়ে কাঁদাকাটা করা অভ্যাস!’
‘যত আদিখ্যেতা! সবাই জানত হাবুল অন্য শহরে চাকরির অ্যাপ্লাই করেছে।’
‘আহা, জানা আর মানার মধ্যে অনেক ফারাক বুঝলে! আফটার অল মায়ের মন!’
কথাটা নীপাকে সূক্ষ্ম ভাবে চিমটি কাটার একটা চেষ্টা কিনা বুঝতে নীপা চোখ গোল করে বিবেকের আপাত নিরীহ অভিব্যক্তি যাচাই করে নেন। কম মিচকে নাকি স্বামীটি তার!
নীপার মনযোগ ঘোরাতে বিবেক হাবুলের ছাত্রজীবনের প্রশংসায় সরব হন। ‘হাবুলটা ক্লাসে কোনওদিন ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয়নি, কী পরিষ্কার মাথা ছিল বলো তো? ওকে সময়মত গোগোলের স্কুলে ঢোকানোর সিদ্ধান্তটা একেবারে সঠিক ছিল কিন্তু-’
হ্যাঁ! সিদ্ধান্তটা তারা যৌথ উদ্যোগেই নিয়েছিলেন, কারণ হাবুলের স্কুলের ফি, টিউশন বাবদ অনেকটা খরচ বাড়ার ফলে সংসারের ব্যয় সঙ্কোচের প্রশ্ন জড়িত ছিল। তবু তারা সেদিন হাবুলের লেখাপড়ায় এত উৎসাহ আর মেধার কদর না করে পারেননি।
‘হাবুলের মা বলে কোথায় তোর গর্ব হওয়া উচিত’- গজ গজ করতে থাকে নীপা।
চোখের জল মুছতে মুছতে আলুনি বলে, ‘গর্ব তো হয় মাসিমা, বাপ মরে গেল তখন ও ছয়মাসের পুঁটুলি, সেই ছেলে ডাক্তার হল? পেলেনে চেপে চাকরি করতে যাবে? মাগো, ভাবতেই তো গায়ে কাঁটা দেয়-’
‘তবে?’
‘আমার ননদের ছেলে গদাই? হাবুলের চেয়ে এক বছরের ছোট। কী কষ্ট দিচ্ছে গো মাকে! পেরেম করে এক মেয়েকে ননদের অমতে বিয়ে করে ঘরে এনেছে-’
‘সে কি রে? কবে?’
‘এই তো গত সপ্তাহে। তোমাকে বলা হয়নি। বউ এসেই শউর-শাউড়িকে দূর দূর করছে।’
‘আহা রে! ছেলে কিছু বলছে না?’
‘ছেলের মদতেই তো করছে গো, বস্তির জীবন তো এমনই। বড় কষ্ট! তাই তো ভাবি আমার কত সৌভাগ্যি! ছেলেটা মানুষের মতো মানুষ হল, কত ভালোবাসে আমায়-’
কর্তা-গিন্নি মুখ চাওয়া চাওয়ি করেন। কেসটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আলুনি এখনও আঁচল দিয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছছে। ও কি ছেলে বাইরে যাবার দুঃখে কাঁদছে? আবার কথাবার্তার ধরনটি মেইন লাইন ছেড়ে কর্ড লাইনে যাচ্ছে? মনে হচ্ছে হয়তো ও সুখে কাঁদছে! মানুষ অতিরিক্ত সুখেও তো কাঁদে? আশাতীত আনন্দে? কাঁদে না? গোগোলকে জন্মের পর নার্সিংহোমে প্রথম দেখে এই নরমসরম কর্তাটির চোখে জল এসেছিল- আড়চোখে নীপা দেখেছিল তো!
কড়াই-এ চাপানো সব্জির গন্ধ জানান দিতেই আলুনি ছ্যাঁকছোঁক করে আওয়াজ তুলে খুন্তি চালিয়ে রান্না সামাল দিতে নেমে পড়ল বটে কিন্তু এখনও কান্নাকে সামাল দিতে পেরে উঠছে না। এ ধরণের ক্রাইসিস আগে কখনও ফেস করেননি কর্তা-গিন্নি। আলুনি স্বভাবেও আলুনি, কোনওদিন তাকে এমন আবেগমথিত হতে দেখা যায়নি। চুপচাপ নিজের কাজ করে যায়।
আপাতত নিজেদের আভ্যন্তরীণ কলহ ভুলে বিবেক-নীপা সোফায় মুখোমুখি বসেন।
‘যতই হোক, ছেলে কখনও দূরে যায়নি, দুশ্চিন্তা হতেই পারে,’ চিন্তিত ভাবে বলেন বিবেক।
‘গোগোল যাবার সময় আমাদেরও তো- কষ্ট তো হয়ই। আর একবার বাইরে যাওয়া মানে আর কি কলকাতায় ফিরবে?’
আজকের সকাল একটু অন্যরকম হয়ে ওঠে। একটু স্মৃতিমেদুর...একটু আবেগঘন। নিত্যদিনের টান টান রেষারেষি ঝগড়াঝাঁটি থিতিয়ে পড়েছে... টুপটাপ মুহূর্তগুলি খসে যায়।
আলুনি সকালের জলখাবার এনে কর্তা-গিন্নির সামনে টেবিলে নামিয়ে রাখে।
আড়চোখে নীপা দেখে আশ্বস্ত হন- যাক বাবা! বাঁচা গেছে। আপাতত মনে হচ্ছে যে কান্না থেমেছে।
‘এই তো, আর কাঁদবি না! কষ্ট হলেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্নাকাটি জানিস তো পছন্দ না আমার,’ স্বভাবসিদ্ধ চালে ফিরে আসার চেষ্টায় বলেন নীপা।
‘কষ্টে কাঁদছি না তো মাসিমা!’
লে হালুয়া! ‘তবে? আনন্দে কাঁদছিস?’
‘না গো, কাঁদছি তোমাদের কথা ভেবে!’
‘আমাদের কথা?’ আকাশ থেকে পড়েন দম্পতি।
‘তোমরা তো ভগবান আমাদের কাছে। হাবুল বলে, পাড়ার মানুষরা বলে- তোমাদের মতো মানুষ হয় না। তাই আমাদের কপালের কথা ভাবছি আর চোখের জলে ভাসছি-’
স্বামী-স্ত্রী তড়িতাহত হন কি? বিস্ফারিত চোখে দু’জন দু’জনকে মাপেন।
বয়স কি তাদের চোখে ঠুলি পড়িয়ে দিয়েছে? এখন আর পরস্পরকে পরিষ্কার দেখতে পান না?
আলুনির চোখ দিয়ে নতুন করে যেন নিজেদের দেখতে চেষ্টা করেন তারা।