শত্রুরা পরাভূত হবে। কর্মে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের জন্য ব্যয়-বৃদ্ধির যোগ আছে। কোনও ... বিশদ
বিপরীতে স্বাধীন ভারত দীর্ঘদিন এশিয়ার উত্থানে (এশিয়ানিজম) বিশ্বাসী ছিল। বিশেষ করে জওহরলাল নেহরুর আমলে। বামপন্থায় শ্রদ্ধাশীল নেহরু মূল ভরসা রেখেছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ার উপর। চীনকেও পাশে পেতে চেয়েছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। এই ব্যাপারে তাঁর মূল মন্ত্রণাদাতা ছিলেন আমেরিকা-বিরোধী এবং কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী কংগ্রেসি রাজনীতিক-কূটনীতিক ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেনন। সহকর্মী সর্দার প্যাটেল এবং সেনাপ্রধান জেনারেল কে এস থিমায়া নেহরুকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, বিশ শতকের জিওপলিটিক্সে ভারতের জন্য এটা একেবারেই ভুল পথ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে শোধরাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তাঁরা। ১৯৬২-তে চীন বিশ্বাসঘাতকতা করার পরই নেহরুর জোড়া মোহভঙ্গ হয়: চীন ও মেনন সম্পর্কে। তবু, নেহরু কোনও দিন আমেরিকার দিকে ঝোঁকেননি। তার একটা বড় কারণ, নেহরু আমেরিকার কাছে যতটা গুরুত্ব প্রত্যাশা করতেন আমেরিকা তা তাঁকে দেয়নি। নেহরু ভারতকে বিশ্বের দরবারে অন্যতম বৃহৎ এক শক্তি হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যগ্র ছিলেন। তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন বুঝিয়ে দিত যে, ভারত সম্পর্কে নেহরুর মূল্যায়ন অতিরঞ্জিত। তিনি ভারতকে ওভার এস্টিমেট করে ফেলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যাহাই পাকিস্তান, তাহাই ইন্ডিয়া। আয়তন বা জনসংখ্যার তফাতটাকে ধর্তব্যের মধ্যে নেয়নি। বাজার অর্থনীতির তত্ত্ব আজকের মতো সেদিনও গুরুত্বপূর্ণ থাকলে কী হতো, সে অবশ্য বলা মুশকিল।
মোদ্দা কথা, ভূরাজনৈতিক অবস্থানের বিচারে পাকিস্তানকে তারা ভারতের চেয়ে এগিয়েই রেখেছিল। সেই পাকিস্তানকে আমেরিকাসহ পশ্চিম আর বিশেষ পাত্তা দেয় না। বরং সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর হিসেবে পাকিস্তানকে শায়েস্তা করার নানা ফরমান জারি করেছে তারা সাম্প্রতিক অতীতে। কাশ্মীর সম্পর্কে মোদি সরকারের নয়া অবস্থানকেও পশ্চিমের বেশিরভাগ দেশ সমর্থন করেছে। যারা প্রত্যক্ষভাবে পারেনি, তারা পরোক্ষে সমর্থন দিয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ১৩৫ কোটি মানুষের দেশ ভারতের স্থায়ী সদস্যপদের দাবিকে পশ্চিম এখন সমর্থন করছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমি শক্তির সঙ্গে ইমরান খান প্রশাসনের দূরত্ব ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন এবং মোদি সরকারের এতটা কাছাকাছি আসার রহস্য আপাতত একটাই—চীন। ওয়াশিংটন এবং নয়াদিল্লি উভয়েরই চোখে চীন এক সন্দেহভাজন। ভয়ানক গোলমেলে দেশ। কোভিড-১৯ ইস্যুতে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ এশিয়া, আফ্রিকার অনেক দেশ চীনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। কিছু দেশ চীনের কাছে ক্ষতিপূরণের দাবিতেও সরব হয়েছে। ট্রাম্পের অভিযোগ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা 'হু' চীনের কথায় চলছে। এই ব্যাপারে কিছুদিন আগে বিষোদ্গারসহ ট্রাম্প সাহেব ঘোষণা করে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতি বছর দেয়, এবার থেকে তা আর দেবে না। হু-র বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমেরিকা কটাক্ষ করার আগেই বহু দেশ ঝুঝে গিয়েছে, এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি আপাতত এক নিধিরাম সর্দার। বিশেষত কোভিড পরিস্থিতিতে হু বিশ্বকে গাইড করার নামে অনেকাংশে বিভ্রান্ত করেছে। হু-র এই অবনমনের পিছনে চীনের দায় কতটা তা নিয়ে গবেষণা নিশ্চয় হবে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, চীন যাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে তারই হাড়ির হাল হচ্ছে।
চীন এবার ভীষণভাবে ভর করেছে পাকিস্তানের উপর। পাকিস্তানকে সরাসরি লালফৌজের সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে ইমরান সরকার। জিনপিং খোয়াব দেখছেন, নড়বড়ে দেশটির মাটি-জল-আকাশ ব্যবহার করেই ভারতের বিরুদ্ধে অস্ত্র শানাবেন। সেনা বাহিনী এবং কুখ্যাত আইএসআইয়ের কথায় নেচে আধমরা দেশটাকে ইমরান সাহেব নতুন কোনও সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেবেন না তো? দেশ গেলে তাঁর অবশ্য কিছু যায় আসে না। পূর্বসূরি পারভেজ মোশারফ বা নওয়াজ শরিফের মতো বিদেশে পালিয়ে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে পারবেন। কিন্তু দেশটা গৃহযুদ্ধে আরও রক্তাক্ত হবে না তো? পাকিস্তানের নাগরিক সমাজকে এখনই ভাবতে হবে এই দিকটা।
একই ভয় হয় নেপালকে নিয়েও। নেপালের কমিউনিস্ট সরকার চীনের হাতে তামাক খেতে শিখেছে। একটু-আধটু না হয় ঠিক আছে। উপর্যুপরি দমক লাগলে ওলি সরকার সামলাতে পারবে কি? না—সেটা এখনই হলফ করে বলে দেওয়া যায়। রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথটা নেপালের মোটেই মসৃণ ছিল না। দেশবাসী বহু রক্ত দিয়েছেন। চীনের কথায় আর কয়েক কদম হাঁটার পরিণাম নেপালের পক্ষে সুখকর নাও হতে পারে। ইতিমধ্যেই নেপালের শাসক গোষ্ঠী অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সুন্দর দেশ নেপালের ভূমিতে জিনপিংয়ের ছায়া যত দীর্ঘ হবে এই অস্থিরতা তত বাড়বে বলেই আশঙ্কা।
চীনের অন্যতম বৃহৎ বাজারের নাম ভারত। পণ্য রপ্তানি থেকে শিল্পে লগ্নি—দু'দিক থেকেই। বিশ্রী রকমের এই সীমান্ত বিরোধের পরিণামে চীনের সেই বাজার যে নষ্ট হতে চলেছে তা বিলক্ষণ বুঝেছে চীন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত ইংরেজি দৈনিক ‘গ্লোবাল টাইমস’-এর নিত্যনতুন বিষোদ্গার আর শূন্যগর্ভ আস্ফালনেই এটা বেশি ধরা পড়ছে। সাম্রাজ্যবাদী চীন এই বাণিজ্য ঘাটতি পুষিয়ে নিতে ভারতের সবক’টা প্রতিবেশী দেশকে টার্গেট করেছে। বিশেষভাবে টার্গেট করেছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের কিছু মানুষ এখনও মনে করে, একাত্তরে দেশটা স্বাধীন হয়নি। আসলে পাকিস্তান দু’টুকরো হয়েছিল। যাকে ‘ইসলামি উম্মাহ’ (জাতিগত একতা)-র উপর ‘হিন্দু ইন্ডিয়া’র চরম আঘাত বলে মনে করে। তারা এখনও নিজেদের ‘পাকিস্তানি’ ভেবে গর্ব বোধ করে। এই লোকগুলোকে বাগে রাখা হাসিনা সরকারের কাছে আজও এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই বিপথগামী শক্তির কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশকে আর একটা উপনিবেশ করার চক্রান্তে লিপ্ত চীন। সেক্ষেত্রেও দোসর পাকিস্তান।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে ১৯৬৫-র সেপ্টেম্বরের কথা। হার্ড লাইনার পলিটিশিয়ানদের চক্করে পড়ে কাশ্মীর দখলের খোয়াব দেখেছিল পাকিস্তান। তুরন্ত মুখতোড় জবাব দিয়েছিল ভারত। ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের ভিতরে প্রবেশ করে। জুলফিকার আলি ভুট্টো তখন বিদেশমন্ত্রী। অগ্নিশর্মা ভুট্টো সাহেব রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জ্বালাময়ী ভাষণে ভারতের বিরুদ্ধে ‘হাজার বছরের যুদ্ধ’ (fight for a thousand years) ঘোষণা করে দিলেন! যদিও ১৯৬৫ ও ১৯৭১-সহ সবক'টি যুদ্ধেই পাকিস্তান গোহারা হয়েছে ভারতের কাছে। তারপরেও ভুট্টোর উত্তরসূরি জিয়া-উল-হক তাল মিলিয়ে হুঙ্কার ছেড়েছিলেন ‘ভারতকে দগ্ধে দগ্ধে মারো’ (bleed India through a thousand cuts)। তস্করদের ছায়াযুদ্ধে ভারতের অনেক ক্ষতি নিশ্চয় হয়েছে। কিন্তু ভুট্টো এবং জিয়া-উল-হকের কী নির্মম পরিণতি হয়েছিল, ইমরান সাহেব ইতিহাসের পাতা উল্টে একবার দেখে নেবেন না এই সুযোগে? বাংলাদেশের সুশীল সমাজকেও আশা করি এটা ভাবাচ্ছে।