শত্রুরা পরাভূত হবে। কর্মে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের জন্য ব্যয়-বৃদ্ধির যোগ আছে। কোনও ... বিশদ
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তীর নানা মজার ঘটনা রয়েছে। তার একটি এরকম— একদিন স্টার থিয়েটারে ‘পরিণীতা’র শো করতে যাচ্ছিলেন ভানু। যাওয়ার পথে হঠাৎ দেখেন, রাস্তায় একদল চ্যাংড়া ছেলে তুলসী চক্রবর্তীকে ঘিরে ধরেছে। ধুতির কোঁচা ধরে, জামা ধরে টানছে। মাঝে মাঝে মাথায় চাঁটিও মারছে। এসব দেখে ভানু তো রেগে কাঁই। গাড়ির দরজা খুলে নেমে সোজা এক-একজনকে দিলেন রাম ধোলাই। কিল, ঘুসি, লাথি— সবাই হাওয়া নিমেষে। সে তো হল, কিন্তু যাঁর জন্য এতকিছু সেই তুলসী ভানুকে বললেন,‘আহা! অত রাগিস কেন, একটু মজা করে যদি ওরা আনন্দ পায়, পাক না। খামোকা মারলি!’
এই হচ্ছেন তুলসী চক্রবর্তী। ভানু ওঁর কাছে পুরনো দিনের গল্প শুনতে চাইতেন। তুলসী ঘণ্টার পর ঘণ্টা কুসুমকুমারী, তারাসুন্দরী, দানিবাবুদের গল্প শোনাতেন। বাবার কাছ থেকে শোনা তুলসী চক্রবর্তীর প্রথম দিনের নাটকের একটি মজার ঘটনা স্মৃতি হাতড়ে শোনালেন ভানু-পুত্র গৌতম। তুলসী জেঠু যে নাটকে তবলা বাজাতেন, সেই নাটকের এক ছোট চরিত্রের অভিনেতা একদিন অনুপস্থিত। এক লাইনের একটা সংলাপ। তো তুলসী জেঠুকেই নামিয়ে দেওয়া হল। ওঁর সংলাপ ছিল, সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিকে হাতে চিঠি দিয়ে বলবেন, ‘জাঁহাপনা পত্র।’ প্রথম স্টেজে নেমে অত লোক দেখে জেঠু গেলেন ঘাবড়ে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ‘হাজাপনা পোঁ’। বলেই বুঝলেন বড় ভুল করে ফেলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার কোনওরকমে ডায়লগ বলে ভেতরে চলে এলেন। স্টেজের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অভিনেত্রী কুসুমকুমারী। উনি তুলসী জেঠুর কান ধরে বলেছিলেন, ‘ছোকরা দুটো কথাও ঠিকভাবে কইতে পারো না, অ্যাক্টিং করতে এয়েচো!’ কীভাবে সংলাপ বলতে হয়, অথচ কীভাবে অভিনয় করতে হয় পরবর্তীকালে সকলকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন তুলসী চক্রবর্তী।
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির কথা মনে করুন। সেই ছবিতে প্রধান আকর্ষণ ছিলেন কিন্তু তুলসী চক্রবর্তীই। উত্তমকুমার সেখানে কার্যত ব্রাত্য। টাইটেল কার্ডে বড় করে নাম ছিল তুলসী আর মলিনা দেবীর। তাঁদের থেকে একটু ছোট হরফে সুচিত্রা সেন। নিজের কেরিয়ারের শুরুর দিকের যে গল্প বলতে গিয়ে উত্তমকুমার লিখেছেন, ‘ছবির বিজ্ঞাপনে প্রথম যে কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল প্যারাডাইস চিত্রগৃহে বাংলা ছবি। দ্বিতীয় আকর্ষণ ছিল তুলসী চক্রবর্তী অভিনীত একটি ছবি। নায়ক হিসেবে আমার কোনও হদিসই রইল না বিজ্ঞাপনের কোথাও। আমি নগণ্য, আমি সামান্য।’
উত্তম-সুচিত্রার উপস্থিতিতেও সেই ছবির প্রাণ ভোমরা ছিল তুলসী-মলিনা জুটিই। উত্তম-সুচিত্রা দু’জনেই পরে স্বীকার করেছেন, ‘সাড়ে চুয়াত্তর ছবির আসল নায়ক-নায়িকা তুলসী-মলিনা।’ ছবির সমালোচনাতে সেই সময়কার একটি পত্রিকা লিখেছিল, ‘তুলসী চক্রবর্তী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, মলিনাদেবী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সুচিত্রা সেন যেটুকু সুযোগ পেয়েছেন তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন।’
কিন্তু ‘রামপ্রীতি’ উত্তমকুমারকে তৎকালীন সমালোচনায় গ্রাহ্যই করা হয়নি। যদিও সেই ছবি দিয়েই উত্তম-সুচিত্রা জুটির জয়যাত্রা শুরু। ছবিতে তুলসী এক মেস মালিকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, সেকথা সকলেই জানেন। প্রতি রবিবার শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বউ-বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। সেখানে তুলসী চক্রবর্তীর মুখে লা-জবাব সংলাপ। হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে মলিনাদেবীকে বলছেন, ‘বউ মানে কী? বউ মানে গাছতলা। মানুষ তেতেপুড়ে এসে গাছতলায় বসে। তা তুমি হচ্ছ আমার খেজুর গাছ। কাঁটা আছে, ছায়া নেই।’ মলিনাদেবীর প্রত্যুত্তর, ‘তা বেশ তো। ছায়া আছে এমন গাছতলায় গিয়ে বসলেই তো পারো।’
বাংলা ছবির দর্শক নিশ্চয়ই আর একটি দৃশ্যের কথাও চিরকাল স্মরণে রাখবেন। মলিনাদেবীর উপর রাগ করে কলকাতায় গিয়েছেন তুলসী। প্রতিবারের মতো গ্রামের বাড়িতে সপ্তাহান্তে আসেননি। এদিকে মলিনাদেবীর মন উচাটন। তাহলে কি তাঁর স্বামীটি হাতছাড়া হয়ে গেল? স্বামীকে ধরে রাখতে তিনি প্রতিবেশিনীর পরামর্শমতো মুখে রুজ-পাউডার-লিপস্টিক মেখে লুচি-মিষ্টি-মন্ডা সাজিয়ে স্বামীকে সোহাগ করছেন তুলসী গ্রামের বাড়িতে আসামাত্র। এই দৃশ্যের শুরুতে তুলসী ঘরে ঢোকার সময় লণ্ঠন স্ত্রীর মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে আগে ভালো করে দেখলেন। কী অসাধারণ শরীরী ভাষায় বিনয়, পুলক আর লজ্জার সহাবস্থান অনিন্দ্যসুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুললেন।
উত্তম-সুচিত্রা জুটির সাফল্যেও অনেকাংশে অবদান আছে তুলসীর। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছাড়াও ‘একটি জীবন’ বা ‘চাওয়া পাওয়া’র মতো অজস্র ছবিতে ছোট চরিত্রেও কী অভিনয়টাই না করেছেন তিনি! নায়ক-নায়িকার জায়গায় উত্তম-সুচিত্রা-সাবিত্রী বা সুপ্রিয়া যেই থাকুন না কেন, তুলসী পর্দায় এসেছেন আর দর্শকের মনোযোগ পাননি এমনটা হয়নি।
আপনার প্রিয় অভিনেতা কে, এই প্রশ্নের উত্তরে সুচিত্রা সেন একটুও না ভেবে বলতেন, ‘তুলসী চক্রবর্তী।’ উত্তমকুমার অভিনীত প্রায় তিন ডজন সিনেমায় তুলসী চক্রবর্তী অভিনয় করেছেন। উত্তম বলতেন, ‘তুলসীদা যেভাবে অভিনয় করেন, আমি তা কোনওদিনই পারব না। ওঁর মতো জীবন্ত হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবে না। তুলসী চক্রবর্তীকে প্রণাম জানানোর একটাই পথ আছে আমার কাছে। যখনই কাজ পাই, পরিচালক-প্রযোজককে বলে ওঁকে ডেকে নিই। তুলসীদা থাকলে সিনটা দারুণভাবে উতরে যায়। ওঁর ঋণ তো শোধ করতে পারব না, যেটুকু পারি সাহায্য করি।’
তুলসী ছিলেন নিঃসন্তান। তাই অভিনেতাদেরই পুত্রজ্ঞানে স্নেহ করতেন। উত্তমকুমার, তরুণকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমারদের ছেলে বলেই সম্বোধন করতেন। নিজস্ব ভঙ্গিতে খুনসুটিও চলত। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতার ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার পেয়ে তুলসী চক্রবর্তীকে প্রণাম করেছিলেন ভানু। তখন মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে ভানুকে সস্নেহে তুলসী বলে ওঠেন, ‘ব্যাটা বাঙাল, সেদিন এসে আমাদের হারিয়ে দিলি।’
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: বিশ্বনাথ ঘোষ