শত্রুরা পরাভূত হবে। কর্মে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের জন্য ব্যয়-বৃদ্ধির যোগ আছে। কোনও ... বিশদ
পর্ব ২৪
টাকা ধার দেওয়া আর বিদ্যাসাগরের জীবন— সম্ভবত একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। শুধুমাত্র এই বিষয়টি নিয়েই বাঙালি কৃতজ্ঞচিত্তে বিদ্যাসাগর বিষয়ে একটি মহাগ্রন্থ রচনা করে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারে। আমরা সেই চেষ্টা এখানে করছি না। তবে, বিদ্যাসাগর মশায় এ বিষয়ে যেসব তথ্যাদি আমাদের দিয়ে গিয়েছেন, তা যে কতখানি রোমহর্ষক তা বলে বোঝানো যাবে না বলে তাঁর দেওয়া বিবরণ থেকেই আমরা কিছু নিবেদন করে গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজা করার চেষ্টা করছি।
বিদ্যাসাগর মশায়ের কাছে টাকা চেয়ে টাকা পাননি- এমন ঘটনা বোধ করি খুঁজে-পেতে পাওয়া অসম্ভব। এজন্যে তিনি অন্যের কাছে ধার করে হলেও ঋণ প্রার্থীকে টাকা দিতেন। এর বড় প্রমাণ স্বয়ং মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাহলে বিদ্যাসাগর ঋণগ্রস্ত হবেন না কেন? যখন গ্রামে থাকতেন সন্ধের পর চাদরের খুঁটে টাকা বেঁধে পড়শিদের বাড়িতে বাড়িতে যেতেন। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে টাকা দিয়ে আসতেন। গোপন রাখতেন কারণ অন্যে জানতে পারলে তাঁদের সম্মানহানি হতে পারে!
ধার করে ধার দেওয়ার ইতিহাসের বিস্ময়কর পরিমাণের কথা বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্র নিজে লিখে গিয়েছেন। তাতে জানতে পেরেছি বীরসিংহায় তাঁদের পড়শি ছিলেন জমিদার বৈদ্যনাথ চৌধুরী। কোনও প্রয়োজনে তিনি রামমোহন পুত্র রমাপ্রসাদ রায় মশায়ের কাছে সম্পত্তি বন্দক রেখে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ করেন। তাঁর ছেলেও অন্য দফায় আরও পঁচিশ হাজার টাকা ধার করেন। কিন্তু দু’জনেরই মৃত্যু হলে পুত্র শিবনারায়ণের বিধবা পত্নী বিদ্যাসাগরের কাছে এসে কেঁদে পড়েন। তাঁর কান্না দেখে বিদ্যাসাগরের চোখে জল এল। তিনি তখন নিজেই বেলগাছিয়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের আত্মীয় কালিদাস ঘোষের কাছে গিয়ে পড়লেন আর তাঁর কাছে ধার করলেন পঁচিশ হাজার। কিন্তু শেষপর্যন্ত বিধবার সম্পত্তি থাকল না। তা বিক্রি করে ধার করে আনা টাকা শোধ হল বটে, কিন্তু বিধবা মহিলার পেটের ভাতের সংস্থান রইল না। বাধ্য হয়ে বিদ্যাসাগর মশায় তাঁকে মাসে মাসে তিরিশ টাকা করে সাহায্য করতে লাগলেন। ধার করে টাকা আনার ব্যাপার হয়তো কেউ কেউ করতে পারেন, কিন্তু উল্টে তাঁদের সংসার চালানোর মাসিক খরচও দেওয়ার উদাহরণ বোধ করি নেই। বিধবা বিবাহ দিতে গিয়ে প্রথম দফায় ৮২ হাজার টাকা ঋণ স্বীকার করা একটা নেশার ঝোঁক হতে পারে, কিন্তু কত অজানা মানুষকে কতভাবে যে সাহায্য করেছিলেন তার পরিমাণ হিসেব করা শিবের বাবারও অসাধ্য।
এবার বিদ্যাসাগর মশায়ের নিজের দেওয়া একটা হিসেব পেশ করা যাক। ১৮৬৯ সাল নাগাদ হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় তিনি যে চিঠি দিয়েছিলেন তাতে জানতে পারা গিয়েছে, তখন তাঁর দেনা ২০-২২ হাজার টাকা। আসলে তাঁর দেনা হয়েছিল পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি। আসলে সেখানে আগের দেনার কথা খুলে লেখেননি। কী করে এই দেনা শোধ করবেন? স্থির করলেন তিনি খুচরো সব দেনা শোধ করবেন একমাত্র একটা জায়গাতেই মোটা টাকা ঋণ করে। তার জন্যে তিনি মুর্শিদাবাদের মহারানি স্বর্ণময়ীর দরবারে ঋণের জন্য চিঠি লিখলেন। মহারানি এর আগেও মাঝে মাঝে তাঁকে টাকা ধার দিয়েছেন, তিনি তা শোধও দিয়েছেন। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ নভেম্বর তারিখে তিনি মহারানির সরকারে একটি চিঠি দিলেন। মানুষটার নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্রাক্তন অধ্যক্ষ সংস্কৃত কলেজ এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্মদাত— তিনি কতখানি দীনজনোচিত বিনয়ে চিঠি লিখছেন, একটু খানি উদ্ধার করে দিই—
‘শুভাশিষসন্তু,
সাদরসম্ভাষণ- আপনি অবগত আছেন বিধবা-বিবাহ কার্যোপলক্ষে আমি বিলক্ষণ ঋণগ্রস্ত হইয়াছি ঐ ঋণ ক্রমে পরিশোধ করিতেছি। দুই ব্যক্তির নিকট কিছু অধিক ঋণ আছে তাঁহারা ক্রমে লইতে সম্মত নহেন এককালে টাকা পাইবার জন্য ব্যস্ত করিতেছেন এককালে তাঁহাদের ঋণ পরিশোধ করি তাহার সুযোগ নাই। কিন্তু তাহা না করিলেও কোন ক্রমে চলিতেছে না। উপায়ান্তর না দেখিয়া অবশেষে শ্রীমতী রাণী মহোদয়ার নিকট প্রার্থনা করিতেছি। তিনি দয়া করিয়া আমাকে সাত হাজার পাঁচশত টাকা ধার দেন। একখানি হ্যান্ড নোট লিখিয়া দিব এবং তিন বৎসরে পরিশোধ করিব। এই ঋণ নিয়মিত সময়ে পরিশোধ করিতে পারিব সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নাই; সন্দেহ থাকিলে কখনও আমি এরূপে ধার চাহিতাম না। আপনকার সাহায্য ব্যতিরেকে আমার এই প্রার্থনা সফল হইবার সম্ভাবনা নাই। আপনি অসন্দিগ্নচিত্তে সহায়তা করিবেন। এই সহায়তা করিয়া আপনাকে কখনও অপ্রস্তুত হইতে হইবেক না; আমি এত অসহায় ও অপদার্থ লোক নহি যে পরিশোধ করিবার সম্ভাবনা নাই, তথাপি ঋণ করিতেছি অথচ পরিশোধ বিষয়ে অযত্ন করিব কিংবা নিশ্চিন্ত থাকিব আপনি এক মুহূর্তের জন্যও এরূপ আশঙ্কা করিবেন না। রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ যতদিন জীবিত ও সহজ অবস্থায় ছিলেন, তাঁহার নিকট মধ্যে মধ্যে এইরূপ ধার পাইতাম এবং ক্রমে ক্রমে পরিশোধ করিতাম।... আপনি না থাকিলে শ্রীমতী রাণী মহোদয়ার নিকটেও ধার চাহিতে পারিতাম না। এক্ষণে যাহাতে আমার প্রার্থনা সফল হয় দয়া করিয়া তাহা করিতে হইবেক। না করিলে আমি অপমানিত ও অপদস্থ হইব এই বিবেচনায় যাহা উচিত তাহা করিবেন।...শ্রীমতী আমার যথেষ্ট উপকার করিয়াছেন।’
চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন পূর্ব পরিচিত রানি স্বর্ণময়ীর সরকার মশায়কে। সরাসরি মহারানিকে নয়। কতখানি নিচু হয়ে সরকার মশায়কে প্রায় হাতে পায়ে ধরেছেন যাতে তাঁর সুপারিশে মহারানি প্রার্থিত টাকা ঋণ হিসেবে দেন। দয়ার সাগর বারবার তাঁর ‘দয়া’ প্রার্থনা করছেন। কেউ বিদ্যাসগরের মতো মানুষকে ‘অপমান ও অপদস্থ’ করতে পারে ভেবে দুঃখ লাগে। আবার এই ভেবেও স্বস্তি লাগছে যে, প্রবল আত্মাভিমানে তিনি টাকা শোধ দিতে পারবেনই, যথাকালে পরিশোধ করার মতো তাঁর সামর্থ্য আছে— এই ঘোষণায় আত্মত্রাতা বিদ্যাসাগর মশায়কে প্রণাম নিবেদন করার অধিকার চাইছি।
বিনা প্রশ্নে মহারানি ঋণ দিয়েছিলেন এবং ঋণগ্রহীতা তা যথাকালে শোধ দিয়েছিলেন। এঁড়ে বাছুর তো!
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল