শত্রুরা পরাভূত হবে। কর্মে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের জন্য ব্যয়-বৃদ্ধির যোগ আছে। কোনও ... বিশদ
পর্ব ২৭
১৮২০ সাল থেকে আমরা ক্রমশ ১৮৯১ সালের দিকে এগিয়ে এলাম। ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মের আগের থেকেই আমাদের আলোচ্য রচনার সূত্রপাত ঘটেছিল। ফলে বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষে দাঁড়িয়ে তাঁর জীবন কেন্দ্রিক প্রায় শতবর্ষের বাঙালির জীবনকে আমরা রেখায়িত মাত্র করতে পেরেছি। তাঁর বিস্তারকে পরিধিভুক্ত করতে পারিনি স্থানাভাবে।
এবারে যে উৎসাহ নিয়ে একটি এঁড়ে বাছুরের জন্য তার বেড়ে ওঠা, তাঁর সমাজকে বাড়িয়ে তোলার ছবিটি সাধারণের জন্য আঁকতে শুরু করেছিলাম, এখন প্রবল বেদনার সঙ্গে তাঁর বিদায়লগ্নটির স্তিমিতালোক চিত্রটিকেও আমাদের আঁকতে হবেই। পাঠক বেদনাবিদ্ধ হবেন। জন্মের দ্বিশতবর্ষে এই চিত্র না আঁকলেই ভালো হতো। কিন্তু একজন মানুষের চলে যাওয়ায় তাঁর কীর্তিকে স্মরণের অবকাশ— সে কথা ভেবেই সেই অনিবার্য পরিণামের কথাও আমাদের বলতে হবে।
গিয়েছিলেন সুক্ষণে উত্তরপাড়ার একটি বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শনে। ফিরছিলেন সম্ভবত একটা অশুভ লগ্নে। নইলে যে ঘোড়ার গাড়িতে ফিরছিলেন সেটা একটা মোড় ঘুরতে গিয়ে ঘোড়া সুদ্ধ যে উল্টে যাবে এবং বিদ্যাসাগর মশায় ছিটকে পড়ে গিয়ে পেটে প্রচণ্ড আঘাতই বা পাবেন কেন?
অন্ত্রে তাঁর এত জোর আঘাত লাগে যে যন্ত্রণায় তিনি চেতনা হারিয়ে ফেলেন। সেই ব্যথা আর ক্ষত তাঁর ইহজীবনে আর সারল না। প্রায়ই তাঁর ফলভোগে তাঁকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়তে হতো। সেদিনের কথা বলতে গিয়ে বিদ্যাসাগর মশায় পরে বলেছিলেন, ‘যখন আমার চেতনা হইল, আমার বোধ হয় যেন আমার মাতৃদেবী আসিয়া আমাকে ক্রোড়ে লইয়া বসিয়া আছেন, আর স্নেহ ভরে পুত্রের সেবা করিতেছেন। স্বশরীরে সেই একেবারে স্বর্গভোগ করিয়াছিলাম।’ সেদিন অকুস্থলে উপস্থিত মিস মেরিকার্পেন্টার কীভাবে বিদ্যাসাগর মশায়কে সেবা করেছিলেন— কোনও এক পর্বে পাঠকবর্গ তা পড়ে এসেছেন। সেই কমজোরী লিভার নিয়ে বাকি জীবনটা তাঁকে কাটাতে হয়েছে। ধীরাজ এই ঘটনাকে নিয়ে একটা চমৎকার গান লিখেছিলেন। তার তিনটে পঙ্ক্তি আমরা তুলে দিই:
‘উত্তরপাড়া স্কুলে যেতে বড়ই রগড় হল পথে,
নাড়াচাড়া দিলে ঘোড়া মোড়ের মাথাতে,
গাড়ি উল্টে পল্লেন সাগর, অনেক পুণ্যে গেছেন বেঁচে।’
কলকাতায় ফিরে বন্ধু ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারকে দেখালেন। তিনি বললেন, লিভার অ্যাবসেস, এ ফোঁড়া সারবার নয়। কার্পেন্টার প্রায়ই চিঠি লিখে খবর নেন, ‘আপনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন জেনে খুব দুঃখ পেলাম। যদি সুস্থ বোধ করেন তবে মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে বাড়িতে যে সভা ডেকেছি- আসবেন।’
একবার ‘অসুস্থতার মধ্যেই কর্মাটাঁড়ে আসিয়াছি’ বলে কন্যাকে চিঠি দিলেন। শরীরের এই ভাবগতিক দেখে উইলের কাজটা সেরে রাখলেন। এরই মধ্যে আরও একবার কর্মাটাঁড়ে থাকার সময় পিঠে একটা সাংঘাতিক কার্বঙ্কল হল। কলকাতার ডাক্তার চন্দ্রমোহন ঘোষ ‘সেই কার্বঙ্কল পটলচেরা করিয়া তাহার পুঁজরক্ত বাহির করিয়া’ দিলে সেটি সেরে ওঠে। একটা মারাত্মক বিপদ থেকে রক্ষা পেলেন। এ সময়ে এক ফকিরের গান শুনে তিনি আকুল—
‘আমি অগাধ জলে ডুব দিতে চাই
সে নাম ভুলব না হে প্রাণ গেলে।’
কার্বঙ্কলের ব্যথায় কিছুদিন লিভারের কষ্ট ভুলে ছিলেন। আবার সেটা চাগাড় দিয়ে উঠতেই বায়ু পরিবর্তনের জন্য বর্ধমানে গেলেন। সেখানে ম্যালেরিয়া মাথা চাড়া দিয়েছে দেখে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের শেষাশেষি চন্দননগরে গেলেন। কিন্তু এখানে শরীরের কোনও উন্নতি ঘটছে না দেখে সেই কলকাতাতেই ফিরে আসতে হল বাদুড়বাগানে নিজের বাড়িতে। হেকিমি চিকিৎসা শুরু হল। আফিম খাওয়ার নেশা পর্যন্ত ছাড়তে চাইলেন। প্রথমটা ভালো হলেও রক্তাতিসার বেড়ে যেতেই লাগল। ডাঃ হীরালাল ঘোয ও ডাঃ অমূল্যচরণ ঘোষ দেখলেন। তেমন কোনও উন্নতি নেই। তাঁরা পরামর্শ করলেন ডাঃ রার্চ এবং ডাঃ ম্যাকলেন সাহেবের সঙ্গে। তাঁরাও বিশেষ পথ বাতলাতে পারলেন না। শেষ অবধি ডাঃ শালাজারকে ডাকা হল। তিনি জানালেন, লিভারে ক্ষত তো আছেই, তার ওপর জন্ডিস হয়েছে। সেরে ওঠার সম্ভাবনা নেই। ছুটে এলেন ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। একটু উন্নতি যদি বা হল, প্রবল হিক্কার ধাক্কায় প্রাণ যায় যায় অবস্থা। দেশনায়ক সুরেন বাঁড়ুজ্যে মশায় একদিন দেখা করতে এলেন। স্বভাবজাত রহস্য প্রিয় বিদ্যাসাগর তাঁকে দেখে বললেন, ‘তোমার চুল এত তাড়াতাড়ি পেকে গেল।’
১৩ শ্রাবণ ১২৯৮। সন্ধে নামতেই প্রবল জ্বরে তিনি সংজ্ঞাহীন। এদিন রাত দুটো আঠারো মিনিটের পর পৃথিবী তাঁর বরপুত্রকে আর কোলে ধরে রাখতে পারল না। গভীর রাতের বুক চিরে হাহাকার আর আর্তনাদে ভারতবর্ষ দরিদ্র হল। সবার আর্তনাদে একটিই প্রার্থনা- ‘যাও দেব সুরপুরে করগে বিশ্রাম।’
‘বামাবোধিনী’ পত্রিকার তরফে এক প্রত্যক্ষদর্শিনী দাহকার্য স্বচক্ষে দেখে লিখলেন, ‘দেখিলাম সেই অগতির গতি, অসহায়ের সহায়, অনাথের বন্ধু আমাদের বিদ্যাসাগর মহাশয় এ জনমের মত আমাদিগকে ফাঁকি দিয়াছেন... কে বলিল আজ আমাদের বিদ্যাসাগর মহাশয় এ জগতে নাই। ... আজি মৃত্যু তাহাকে স্পর্শ করিয়া অমর হইয়াছে। আমাদের বিদ্যাসাগর মহাশয় মৃত্যুঞ্জয় হইয়া আমাদের নিকটে বিরাজ করিতেছেন।’
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল