শত্রুরা পরাভূত হবে। কর্মে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের জন্য ব্যয়-বৃদ্ধির যোগ আছে। কোনও ... বিশদ
একদিন রাতে ঠাকুরদাস একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নটি ছিল এই রকম— খুব শিগগির তোমার বসতভূমি শ্মশানে পরিণত হবে। ঘুম ভেঙে গেল, আর ঘুম এল না। সকাল হতেই গণক গঙ্গানারায়ণ ভট্টাচার্যকে ডেকে পাঠালেন এবং স্বপ্ন কী ইঙ্গিত করছে তার ব্যাখ্যা করতে বললেন। ভট্টাচার্য মশায় স্বপ্নের সরল অর্থ বুঝয়ে দিলেন, এবার তোমাকে গ্রামে বসবাসের মায়া ত্যাগ করতে হবে। আরও একটু বেশি কথা তোমাকে জানিয়ে দিই— তোমার বড় ছেলে ঈশ্বরচন্দ্রের কোষ্ঠীতে এখন ঘোর শনির দশা দেখতে পাচ্ছি। তার তিন রকমের বিচ্ছেদ যোগ দেখতে পাচ্ছি— আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে বিচ্ছেদ, বন্ধু বিচ্ছেদ আর ভ্রাতৃ বিচ্ছেদ। এর ফলও হবে তিনটি— একদিনের জন্যও এরপর আর সুখী হবে না, দেশত্যাগী হতে হবে আর দেশ ছেড়ে নতুন নতুন জায়গায় বসবাসের ইচ্ছা হবে। বাঁড়ুজ্যে মশায় এসব কথা পাঁচকান করবেন না, তাতে ঈশ্বরের আরও লোকসান হবে।
কোষ্ঠী আর স্বপ্নের ফল কী হবে তা তো ভবিষ্যতের কথা। কিন্তু ঠাকুরদাস খুব বিচলিত হয়ে পড়লেন। ঈশ্বর গ্রামে নেই। পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ মৃত্যুশয্যায়, তাঁকে দেখার জন্য তাঁর বসতবাটী মুর্শিদাবাদের কান্দিতে গিয়েছেন। মনে মনে ঠিক করলেন, এখনই কাশী রওনা হওয়া উচিত। শেষটা ওখানেই কাটুক। শম্ভুচন্দ্রকে মনের বাসনার কথা খুলে বলায় তিনি দাদাকে বাবার মানসিক অবস্থা সবিস্তারে লিখে জানালেন। এমনিতেই প্রিয় বন্ধু প্রতাপচন্দ্র মৃত্যুশয্যায়, তার উপর বাবার কাশী যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঈশ্বরচন্দ্রকে খুবই বিচলিত করে তুলল। তিনি শম্ভুচন্দ্রকে একটি চিঠি লিখলেন এই মর্মে— তিনি বিদেশে একা থাকবেন তা মোটেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। বিদেশে সবকিছু জোগাড় করে নিজের খাবার নিজেই ব্যবস্থা করবেন, তাতে তাঁর কষ্ঠের শেষ থাকবে না। এতবড় পরিবার যার তিনি সেসব ছেড়ে বিদেশে একা একা কাশীতে থাকবেন— তা আমি কোন রকমেই সইতে পারব না। যদি তিনি তাঁর সেবা ও পরিচর্যার জন্য কাউকে অন্তত সঙ্গে নিয়ে যান, তাতে আমি রাজি হতে পারি। আমার জন্য তো তিনি অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছেন— এখন না হয় আর কিছুকাল কষ্ট সহ্য করুন, আমি খুব তাড়াতাড়ি এখান থেকে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টায় আছি। সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করব। তা না করে হঠাৎ চলে গেলে আমি মর্মান্তিক দুঃখ পাব।
অসুস্থ বন্ধুকে ছেড়ে ঈশ্বরচন্দ্র একটুও দেরি না করে বর্ধমান এলেন এবং সেখান থেকে পাল্কি করে জাহানাবাদে (এখনকার আরামবাগ) পৌঁছলেন। বেহারারা আর ষোলো মাইল পথ যেতে রাজি হল না। অগত্যা বিদ্যাসাগর হেঁটেই বীরসিংহায় পৌঁছলেন। বাবার পায়ে ধরে অনেক অনুনয়-বিনয়, কান্নাকাটি করলেও ঠাকুরদাস সিদ্ধান্ত বদল করলেন না।
এরপর ঈশ্বরচন্দ্র বাবাকে মিনতি করে বললেন, ‘আপনি গেলে আমাদের মন খুব ব্যাকুল হয়ে থাকবে। আপনি যদি একটা ব্যাপারে আমাদের সম্মতি দেন খুব ভালো হয়। আপনাকে আর দিন পনেরোর মতো কলকাতায় থাকতে হবে। চিত্রকর হডসনকে দিয়ে আপনার একটা ছবি আঁকিয়ে নেব।’ এবার ঠাকুরদাস রাজি হলেন। যথাসময়ে প্রতিকৃতি আঁকানো হল। ঠাকুরদাসের ওই একটি মাত্রই আঁকা ছবি।
মাতা ভগবতী দেবীরও একটি ছবি সাহেব চিত্রকরকে দিয়ে আঁকানো হয়েছিল। এর জন্য প্রায় তিনশো টাকা খরচ হয়। ভগবতীদেবী কিছুতেই সাহেবের সামনে বসে ছবি আঁকাতে রাজি ছিলেন না। ঈশ্বরচন্দ্র খুব পীড়াপীড়ি করাতে ভগবতীদেবী শেষপর্যন্ত নিমরাজি হয়ে বললেন, ‘তোরই নিন্দে হবে, লোকে বলবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মাকে নিয়ে সাহেববাড়িতে এসেছিল ছবি তোলাতে।’ বিদ্যাসাগর মশায়েরও প্রতিকৃতি আঁকেন সাহেব। ছবিটি উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ পাঠাগারে সুরক্ষিত আছে।
বাংলার ১২৭৩ সনের পৌষ মাস থেকে ঈশ্বরচন্দ্র খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। অথচ এই সময়েই ভেবেছিলেন একবার কাশী গিয়ে বাবাকে দেখে আসবেন। বাধ্য হয়ে শম্ভুচন্দ্রকে কাশীতে পাঠালেন। বাবা নেই। ভাইদের হাঁড়ি আলাদা হল। সবই বড় দাদা হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্রকে করে দিতে হল, এমনকী টাকার ব্যবস্থাও। এভাবেই বছর তিনেক কেটে গেল। ভগবতীদেবী স্বামীর জন্য একটু চঞ্চল। বাধ্য হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে কয়েকজন তীর্থযাত্রীর সঙ্গে কাশীতে পাঠিয়ে দিলেন। স্বামীকে বললেন, ‘দেখো, আমি অনেকদিন বাঁচব, আমার লম্বা পরমায়ু। বীরসিংহায় ফিরে যাই—সেখানে আমি না গেলে গরিব-অনাথ বিধবাদের কষ্ট হবে। তবে কথা দিচ্ছি, মরার আগে তোমার কাছে আবার আসব।’ ভগবতীদেবী দেশে ফিরে এলেন।
এর কিছুদিনের মধ্যে বিদ্যাসাগর ছেলে নারায়ণচন্দ্রের ইচ্ছায় তাঁর সঙ্গে বিধবা ভবসুন্দরীর বিয়ে দিলেন। এতে লোকের মুখ বন্ধ হল। এই বিয়েতে তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরা হাজির থাকবেন না জেনেও তিনি এই প্রস্তাবেই উদ্যোগী হন।
বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই ঠাকুরদাসের অসুস্থাতার খবর এল। শুনে ঈশ্বরচন্দ্র দীনবন্ধু ও শম্ভুচন্দ্রকে চিঠি লিখে মাকে নিয়ে কাশী যেতে বললেন। তিনি নিজেও তাড়াতাড়ি কাশী রওনা হলেন। বিদ্যাসাগরের একনিষ্ট সেবা ও যত্নে ঠাকুরদাস পক্ষকালের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠলেন।
আর এই সময় একদিন কাশীর ব্রাহ্মণেরা, বিশেষত বিশ্বনাথ মন্দিরের সেবাইতরা ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে নানারকম কথাবার্তায় লিপ্ত হলেন। বললেন, আপনার বাবা এখানে অনেকদিন থেকে আমাদের অনেক কাজ করেছেন। খেতে পেয়েছি, টাকাকড়িও নেহাত কম পাইনি। তাঁর মতো ধার্মিক মানুষ দেখিনি আমরা। আপনি অনেকদিন এসেছেন, খুব বড় মানুষ আপনি। আমাদের আপনিও দানপত্র করুন। ঈশ্বরচন্দ্র ঠোঁটকাটা। তিনি বললেন, ‘আপনাদের মতো লোককে দান ধ্যান করলে কলকাতায় ফিরে আমি মুখ দেখাতে পারব না। আপনাদের বিশ্বেশ্বর বলে মান্য করার চেয়ে লজ্জার কিছু নেই।’
শুনে ব্রাহ্মণপুঙ্গবেরা তো রেগে কাঁই, ‘আপনি কি তবে কাশীর বিশ্বেশ্বর মানেন না? তবে কী মানেন?’
‘আমার বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণা এই পিতৃদেব ও জননীদেবীর মধ্যে বিরাজমান।’
এই ঘটনার পর মাস দুয়েক যেতে না যেতেই ভগবতীদেবী কলেরায় আক্রান্ত হয়ে দিন মারা যান। বিদ্যাসাগর একেবারে ভেঙে পড়লেন। দেশে ফিরে এলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর দু’বছরের মধ্যে ঠাকুরদাস আবার প্রবলভাবে পীড়িত হয়ে পড়েন। খবর পেয়েই বিদ্যাসাগর কাশী চলে আসেন। এবারেও তাঁর শুশ্রূষা ও সেবায় তিনি ভালো হয়ে ওঠেন। কাশীতে থাকার সময় বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক-পণ্ডিতদের বিদ্যাসাগর যে কতরকমের সহায়তা করতেন তার হিসেব করে ওঠা দুষ্কর। যখনই সকাল-সন্ধেতে বেড়াতে বের হতেন, সঙ্গে কুড়ি-বাইশ টাকার খুচরো সঙ্গে নিতেন দানের জন্য। এর মধ্যে ঠাকুরদাসের প্রয়াণ ঘটে। তারিখটা ১২৮৩ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ।
এর মধ্যে বিদ্যাসাগর স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য কানপুরে গঙ্গাতীরে একটি বাড়ি ভাড়া করে কয়েকমাস থেকে সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ করে সেখান থেকে লখনউ শহরে আসেন। রাজকুমার সর্বাধিকারীর কাছে দিন কতক কাটিয়ে তিনি প্রয়াগে আসেন। সেখান থেকে কাশীতেও কিছুদিন থাকেন। এরপর তাঁর কলকাতা ফেরা এবং বাদুড়বাগানের বাড়িতে বসবাস।
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল