শত্রুরা পরাভূত হবে। কর্মে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের জন্য ব্যয়-বৃদ্ধির যোগ আছে। কোনও ... বিশদ
সেই অর্থে কখনওই তাঁকে সুপুরুষ বলা যাবে না। সম্বল বলতে ছিল একটা নোয়াপাতি ভুঁড়ি, সাদামাঠা পিঠ ও অপূর্ব উজ্জ্বল একজোড়া চোখ। যে চোখ জুড়ে ‘পরশপাথর’ ছবির পোস্টার করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এইটুকু নিয়েই তুলসী চক্রবর্তী দাপিয়ে বেড়িয়েছেন অভিনয়ের আঙিনায়। উদোম গায়েই মাতিয়ে দিয়েছেন নানা রঙের চরিত্রে। নায়ক-নায়িকা থাকলেও শুধু অভিনয়ের জোরেই ছবিতে আলাদা করে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতেন তিনি।
মাটিতে পা দিয়ে চলেছেন চিরকাল। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে যাতায়াত করতেন। স্টারডমের ছটা কোনওদিন গায়ে লাগতে দেননি। তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় সম্বন্ধে বলতে গিয়ে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক জায়গায় বলেছেন, ‘কেউ যদি দেখাতে পারেন কোনও ছবিতে খারাপ অভিনয় করেছেন তুলসী চক্রবর্তী, তাহলে আমি লাখ টাকা বাজি হেরে যাব। নাটক এবং চলচ্চিত্র দু’ক্ষেত্রেই কী সাবলীল, স্বাভাবিক অভিনয়! কখন কেমন অভিনয় করতে হবে, সে মাপটাও যে কখন বদলে ফেলতেন, কেউ ধরতেই পারত না। কোনও প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই খুব উঁচু দরের সহজাত অভিনয় ক্ষমতার মালিক ছিলেন তিনি।’
নিজের মধ্যে যে কী পরিমাণ অভিনয়ের ক্ষমতা ছিল, তা কিছুতেই বুঝতে চাইতেন না তুলসী। তাঁর অভিনয়টাকে কখনওই অভিনয় বলে মনে হতো না। এতটাই ‘প্রপারলি বিহেভ’ করতেন তিনি। জিজ্ঞাসা করতে বলতেন, ‘ওরে, আমি হলাম গিয়ে হেঁশেলবাড়ির হলুদ। ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সবেতেই আছি। হাসতে বললে হাসব, কাঁদতে বললে কাঁদব, নাচতে বললে নাচব, দু’কলি গান গেয়ে দিতে বললে তাও পারব। হলুদ যেমন সব ব্যঞ্জনেই লাগে তেমনই আর কী! কিন্তু হলুদের কি নিজস্ব কোনও স্বাদ আছে? তাই আমার এই অভিনয়কে আমি অভিনয় বলি না গো! হ্যাঁ, অভিনেতা ছিলেন বটে আমার গুরু অপরেশ মুখুজ্যে। উনি আমাদের মতো সব গাধাকে পিটিয়ে ঘোড়া বানিয়েছেন। অভিনেতা বললে উনি-ই। অমন আর হবে না!’
বহু রঙ্গমঞ্চের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা-পরিচালক তথা নাট্যকার অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় যে তুলসী চক্রবর্তীকে অভিনেতা তৈরির পিছনে অবদান রেখেছিনে, এ কথা সত্য। কিন্তু অভিনেতা হওয়ার কথা প্রথম জীবনে ভাবার অবকাশ ছিল না তুলসীর। ছোটবেলাটা খুব এলোমেলোভাবে কেটেছে তাঁর। বাবা আশুতোষ চক্রবর্তী চাকরি করতেন রেলে। কৃষ্ণনগরের গোয়ারি নামে এক ছোট্ট গ্রামে ১৮৯৯ সালের ৩ মার্চ তুলসী চক্রবর্তীর জন্ম হয়। মা নিস্তারিণী দেবী ছিলেন সাধারণ গৃহবধূ। তাই ছোটবেলায় এ গ্রাম-সে গ্রাম ছুটে বেড়িয়েছেন তুলসী। চাকরির প্রয়োজনে তাঁর বাবাকে নানা জায়গায় ঘুরতে হতো। ফলে বালক তুলসীকে জোড়াসাঁকোয় জ্যাঠামশাই প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছেই থাকতে হতো অনেক সময়। অল্প বয়সে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় পড়াশোনাটাও বেশি দূর চালাতে পারেননি তুলসী। সামান্য যা কিছু শিখেছিলেন, তাও মাঝ পথে বন্ধ করে দিতে হয়। শুরু হয় যাযাবর জীবন।
অপরেশ মুখুজ্যের আগে তুলসী চক্রবর্তীর মাথায় অভিনয়ের পোকাটা নাড়িয়েছিলেন তাঁর জ্যাঠামশাই প্রসাদবাবু। পুরোপুরি অভিনয়ে মনোনিবেশ করার আগে উপার্জনের জন্য নানা কাজ করতে হয়েছে এই অভিনেতাকে। লোকের জন্য মদের চাট তৈরি করা থেকে শুরু করে সার্কাসে জন্তু-জানোয়ার স্নান করানো কী না করেছেন! কিন্তু সে সব পরে।
বাবা মারা যাওয়ার পর জ্যাঠামশাইয়ের আশ্রয়েই পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন তুলসী। প্রসাদবাবুর একটা অর্কেস্ট্রা গ্রুপ ছিল। আর ছিল তাঁর অ্যামেচার ক্লাবে গান-বাজনা-যাত্রা-থিয়েটার। প্রসাদবাবু দিনরাত ওসব নিয়েই পড়ে থাকতেন। কলকাতা শহরে বড়লোকদের বাড়ির পুজোআচ্চায় তাঁর দল গান গাইতে যেত। নাটক করতেন। কলকাতার বাইরেও দলের জন্য বায়না আসত। আর এখান থেকেই প্রাথমিক অভিনয়ের ইচ্ছাটা তাঁর মনে জাগল।
প্রসাদ চক্রবর্তীর অ্যামেচার ক্লাবে অভিনয়ের সুযোগ না পেলেও গান গাওয়ার সুযোগ পেতেন তুলসী। গানের গলাটা মন্দ ছিল না তাঁর। কীর্তন, কবিয়াল, শ্যামাসঙ্গীত— সব ধরনের গান গাইতে পারতেন। মাঝে মাঝে তরজার আসরেও মূল গায়কের সঙ্গী হয়ে নেমে পড়তেন। গান গাওয়ার পাশাপাশি নাচও রপ্ত করে ফেললেন। অভিনয়ের প্রাথমিক পাঠ হয়ে গেল সেখান থেকেই। গিরিশ পার্কের কাছে এক ব্যায়ামাগারে শরীরচর্চাও করতেন নিয়মিত।
কিন্তু সেসব বেশিদিন চলল না। প্রসাদবাবু দারুণ হারমোনিয়াম বাজাতেন। সেই সুবাদে তিনি স্টার থিয়েটারে অর্কেস্ট্রা গ্রুপে চাকরি নিলেন। ক্লাব গেল বন্ধ হয়ে। এদিকে লেখাপড়া বিশেষ জানেন না বলে তুলসী ভালো কোনও কাজ জোটাতে পারলেন না। আবার বসে বসে জ্যাঠামশাইয়ের অন্ন ধ্বংস করতেও মনে বাঁধত।
নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অভিপ্রায়ে চিৎপুরে এক চাটের দোকানে চাকরি নিলেন তুলসী। সন্ধেবেলা দোকানে মাতালরা ভিড় করত। মদের সঙ্গে পাঁঠার ভুঁড়ির চচ্চড়ি, কষা মাংস চাট হিসাবে তারা খেত। মাতালদের এঁটো প্লেট ধুয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন পরবর্তীকালে বাংলা ছবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা হয়ে ওঠা তুলসী চক্রবর্তী।
সেই দোকানে হঠাৎই একদিন এসে হাজির হন প্রসাদবাবু। ভাইপোর কাজের ধরন দেখে তো তিনি রেগে এক্কেবারে অগ্নিশর্মা। একটাও কথা না বলে ভাইপোর চুল ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে গেলেন। রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, ‘ব্যাটা, সাবলম্বী হতে চাইছ? তা আর কোনও কাজ জুটল না! বামুনের ছেলে হয়ে মাতালদের এঁটো পরিষ্কার করতে লেগেছ!’ এই বলে তুলসীর মাথায় বসালেন এক রামগাঁট্টা।
এই রামগাঁট্টাই কিছুটা সম্বিত ফেরাল তুলসীর। বাকি খোঁচাটা দিল জাত্যভিমান। তুলসী নিজেই বলে গিয়েছেন, ‘ওই যে জ্যাঠা বললেন, বামুনের ছেলে। তাতেই অনেকটা কাজ হল। আমার আবার বামনাই ব্যাপারটা চিরদিনই একটু বেশি বেশি কিনা।’
অঙ্কন: সুব্রত মাজী
অলঙ্করণ: বিশ্বনাথ ঘোষ