কর্মপ্রার্থীদের কর্মলাভ কিছু বিলম্ব হবে। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য লাভ ঘটবে। বিবাহযোগ আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে ... বিশদ
ইছামতী নদীতে সাঁতার কাটতে তিনি বড়ই ভালোবাসতেন। বলতেন, ইছামতী আমাকে উজাড় করে অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু সেই ইছামতীর কাছ থেকেই তিনি পেলেন প্রবল আঘাত। ওই নদীর কোলে চিরতরে হারিয়ে গেলেন তাঁর ছোট বোন, তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা বন্ধন জাহ্নবী, যাঁকে তিনি আদর করে জাফরি নামে ডাকতেন।
তিনি তখন কলকাতার মেসে থাকেন। ভগ্নীপতি পঞ্চানন চট্টোপাধ্যায়ের অকাল মৃত্যুর পর বোন জাহ্নবীর জীবনটা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কৃপায় হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। বোনের এই নিদারুণ যাতনা বিভূতিভূষণ সহ্য করতে পারতেন না। তিনি বোনকে বললেন, আর কত লাঞ্ছনা তুই মুখ বুঝে সহ্য করবি। তুই চল আমার সঙ্গে। পিতৃসম বড়দাদার অনুরোধে পুত্র ও কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে জাহ্নবীদেবী চলে এলেন বড়ভাইয়ের আশ্রয়ে। বিভূতিভূষণ বনগাঁ ডাকবাংলোর পাশে বারো টাকা দিয়ে দু’কামরার একটা ঘর ভাড়া নিলেন। জমে উঠল ভাই-বোনের সংসার।
কিন্তু সুখ দীর্ঘস্থায়ী নয়। পঞ্চাননবাবু মারা যাওয়ার আগে জাহ্নবীদেবী এক কন্যা সন্তানের মাতা হন। কিন্তু পিতার অকাল মৃত্যুর দায় বহন করতে হয়েছিল সদ্যোজাত সেই কন্যা সন্তানকে। তাকে চট পেতে শুইয়ে রাখা হতো বাড়ির বাইরের নারকেল গাছের তলায়। স্বভাব কবি বিভূতিভূষণকে নাড়িয়ে দিয়েছিল এই দৃশ্য। তিনি তাঁর দিনলিপির পাতায় নিজের অশ্রুজল দিয়ে লিখলেন সেই কাহিনী, ‘ও আপন মনে হাসত— কিন্তু সবাই বলত আহা কি হাসি, আর হাসতে হবে না, কে তোমার হাসি দেখচে? ওর অপরাধ ও জন্মাবার পর ওর বাবা মারা গেল। সত্যি ওর হাসি কেউ চাইতো না। ওর বাবা তো মারা গেল, ওর মার সংকটাপন্ন অসুখ হল— ওকে কেউ দেখত না। ওর খুড়িমা বললে, টাকা পাই তো ওকে মাইয়ের দুধ দিই। ওকে নারকেল তলায় চট পেতে শুইয়ে রাখত উঠানে— আমার কষ্ট হতো— কিন্তু আমি কি করব? আমি তো আর স্তন্যদুগ্ধ দিতে পারিনে। আনওয়ানটেড স্মাইল। কিন্তু সে হাসি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে গত মঙ্গলবার থেকে— খয়রামারির মাঠে ওর বালিশটা পড়ে আছে সেদিন দেখেছি। এছাড়া আর কোন চিহ্ন কোথাও রেখে যায়নি ও। পুওর লিটল মাইট। কিন্তু আমি বলি এ হাসি শাশ্বত।’
ইছামতীর কোলে জাফরি চিরআশ্রয় নিলেও এরপর বনগাঁ বিভূতিভূষণকে দিল দুহাত ভরে। সার্কেল ইনস্পেকটর হয়ে এই শহরে এলেন ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। আর এই মানুষটির পরিবারের ভালোবাসাব বন্ধনে এবার আবদ্ধ হবেন স্বয়ং বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়।
‘পথের পাঁচালী’ ততদিনে লিখে ফেলেছেন বিভূতিভূষণ। আর সেই লেখা পাঠকের মনে তুলেছে প্রবল আলোড়ন এবং সেই লেখা পড়ে আপ্লুত হয়েছিলেন তন্ত্রসাধক ষোড়শীকান্তের মেজ কন্যা কল্যাণীদেবী। আদর করে তাঁর পিতা তাঁকে রমা নামে ডাকতেন। অপু-দুর্গা-সর্বজয়া-ইন্দির ঠাকুরণ-হরিহরের স্রষ্টা তাঁদের বাড়ির এত কাছে থাকেন শুনে তিনি প্রায় লাফিয়ে উঠলেন।
খবরটা তাঁকে দিয়েছিলেন তাঁর পিসিমা নির্মলা দেবী। তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, ইস, মা-টা চলে গেল ইছামতীর বুকে। কী খারাপ খবর। এখন ওই ছোট ছোট দুটো শিশুকে ওই চালচুলোহীন মানুষটা একলা কী করে সামলাবেন!
কল্যাণী দেবী পিসির কথা শুনে ভেবেছিলেন মানুষটি বোধহয় সংসার বৈরাগী সন্ন্যাসী গোছের কোনও লোক। তিনি পিসির কাছে জানতে চাইলেন, লোকটা কি সন্ন্যাসী?
পিসি বললেন, সন্ন্যাসী হতে যাবেন কেন! বহুদিন আগে তাঁর স্ত্রী গত হয়েছেন। জীবনের অন্যতম বন্ধন ছোটবোনটিও চলে গেল! বউ নেই তো, তাই তাঁর সংসারও নেই!
কল্যাণী দেবী বললেন, তুমি তাঁকে চেনো?
পিসি বললেন, আমি কেন, তুইও চিনিস। কত গল্প, নভেল তিনি লিখেছেন। এই তো কদিন আগেই তুই তাঁর লেখা পথের পাঁচালী পড়ছিলিস।
কল্যাণী দেবী বললেন, তাই, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়! তুমি আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবে!
পিসি বললেন, নিয়ে যাব, তবে মানুষটাকে একটু সামলাতে দে। শোকটা একটু কমুক। তারপর নিয়ে যাব তোকে। কল্যাণী দেবীও তখন অল্পবিস্তর সাহিত্য চর্চা করেন। তিনি পিসিকে চেপে ধরলেন তাঁর স্বপ্নের লেখক বিভূতিভূষণকে সামনাসামনি দর্শন করার জন্য।
সেইসময় ঈশ্বরের অবিরাম কষাঘাতে জর্জরিত বিভূতিভূষণ। অসহায়, অনাথ দুই ভাগ্নে ও ভাগ্নীকে বুকে চেপে দিন কাটছে তাঁর প্রাণপ্রিয় বনগাঁ শহরে।
আর ঠিক সেই ক্ষণে তাঁর জীবনে এলেন ষোড়শীকান্তের মেজ কন্যা কল্যাণী চট্টোপাধ্যায়। সেদিন ছিল পাঁচই অগ্রহায়ণ। বিভূতিভূষণের বাড়ির দরজার কড়া নাড়লেন নির্মলা দেবী, সঙ্গে ষোলো বছরের ভাইঝি কল্যাণী।
দরজা খুলে দিল সদ্য মাতৃহারা সেই ছোট্ট মেয়েটি।
নির্মলা দেবী জানতে চাইলেন, বিভূতিভূষণবাবু বাড়িতে আছেন?
শোকে আচ্ছন্ন সেই মেয়েটি বলল, বড়মামা বাড়িতে আছেন, আমি ডেকে দিচ্ছি।
কিছুক্ষণের মধ্যে বিভূতিভূষণ ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
নীরবতা ভঙ্গ করলেন নির্মলা দেবী। তিনি বললেন, আজ এইসময় আমাদের এখানে আসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। আমি আপনার মনের অবস্থার কথা জানি। কিন্তু আসতে বাধ্য হলাম আমার এই ভাইঝির জন্য। ও আপনার লেখার ভীষণ ভক্ত।
বিভূতিভূষণ খুব মৃদু স্বরে বললেন, ভালোই করেছেন আজ এসে। বনগাঁর পাট আমার চিরতরে চুকল বোধহয়! এদের দুজনকে পাঠিয়ে দেব ঘাটশিলায় আমার ভাইয়ের কাছে। তারপর আবার ভেসে পড়ব এই পৃথিবীর বুকে।
নির্মলা দেবী বললেন, সে কী! কেন? এই শহরকে আপনি কত ভালোবাসেন।
কিশলয় ঠাকুর তাঁর ‘কালের কবি’ গ্রন্থে লিখছেন, বিভূতিভূষণ বললেন, ঠিকই বলেছেন আপনি। এই বনগাঁ, বারাকপুরকে আমি যে কত ভালবাসি, সে কথা কেউ জানে না। কেউ নেই আমার বারাকপুরে। তবু ছিল জাহ্নবী, তখন চালকিতে, তার পরে এখানে। একমাত্র অবশিষ্ট বোন আমার, তাকেও হারালাম ওই ইছামতীতে।’
সময়ও বোধহয় তখন স্তব্ধ হয়ে শুনছেন বিভূতিভূষণের সেই আর্তনাদ। সেইসময় মামার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সদ্য মাতৃহারা দুই বালক-বালিকা।
এর বেশকিছু বছর বাদে ঘটল সেই অলৌকিক ঘটনাটি। কল্যাণী দেবীর সঙ্গে এবার বিবাহ হবে বিভূতিভূষণের। আবার নতুন করে সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ হবেন তিনি। তবে তিনি পুনরায় বিবাহে রাজি ছিলেন না। তুলেছিলেন বয়সের অজুহাত। কল্যাণী দেবী ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন হবু স্বামীর সেই ঠুনকো অজুহাত। তিনি সেদিন প্রণাম করেছিলেন তাঁর জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে। আর বিভূতিভূষণ! বাড়ি ফিরেই বসেছিলেন প্ল্যানচেটে। এসেছিলেন তাঁর মা মৃণালিনী দেবী। বিবাহের অনুমতি চেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে। মা সানন্দে অনুমতি দিলেন।
মায়ের অনুমতি পেয়ে আবার মাথায় টোপর পরলেন বিভূতিভূষণ। আর সেই মাসটাও ছিল অগ্রহায়ণ, তারিখটি ছিল সতেরো। কল্যাণী দেবীর সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয়েছিল এমনই এক অগ্রহায়ণ মাসে। (ক্রমশ)
ছবি: মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে
অলংকরণ: চন্দন পাল