কর্মপ্রার্থীদের কর্মলাভ কিছু বিলম্ব হবে। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য লাভ ঘটবে। বিবাহযোগ আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে ... বিশদ
এখানকার বিখ্যাত জয়গ্রীব মাধবের মন্দিরকে নিয়েই হাজোর প্রসিদ্ধি। প্রকৃতির এক সুরম্য স্থানে এই পুণ্যতীর্থ হাজো।
কামরূপে কামাখ্যা দর্শনে এলে এক যাত্রাতেই যাতে জয়গ্রীব মাধবের দর্শন পান যাত্রীরা সে কারণেই দেবী মহিমা প্রকাশের মধ্যে মাধব শরণং।
গুয়াহাটি রেল স্টেশনের কাছ থেকে ব্রহ্মপুত্রের কোল ঘেঁষে মিনিটে মিনিটে যাচ্ছে হাজোর বাস। সেই বাসেই আমি চলেছি মাধবের পুণ্যভূমি দর্শনে। ব্রহ্মপুত্রের উত্তর সেতু পার হয়ে আমিনগাঁওয়ের মাটি ছুঁয়ে বাস বাহনে একসময় হাজোতে এলাম।
স্থানীয় দুর্গামন্দিরের পাশে মস্ত একটি তালাওয়ের ধারে নামলাম বাস থেকে। দু’-একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম হাজোর মূল আকর্ষণই হল মণিকূট পর্বতের ওপর জয়গ্রীব মাধবের মন্দির। দুর্গা মন্দিরের পাশ দিয়ে তালাওয়ের ধারে ছোট্ট একটি পাহাড়ের ওপর খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই মাধবের মন্দির।
আমি কিছুক্ষণ তালাওয়ের ধারে দাঁড়িয়ে মৎস্যক্রীড়া দেখে মণিকূটের পাদদেশে এলাম। এই পর্বতটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে একশত বাহু পরিমিত। এখান থেকেই ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে মন্দিরের প্রধান প্রবেশপথের দিকে। আমি মাধবের জন্য তুলসীপাতার মালা, ফুল ও এলাচি দানা নিয়ে দর্শনে গেলাম। প্রবাদ, এই মণিকূট পর্বতে এক এক ধাপ উঠলে লক্ষ লক্ষ পাপ টুটে যায়।
যোগিনীতন্ত্রে হাজো বিষ্ণুপুষ্কর নামে উল্লেখিত। হাজো আগে মণিকূট নামেই অভিহিত ছিল। মণিকূট পর্বতে মাধব মন্দির নির্মিত হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীতে। একাদশ শতাব্দীর পর অহোম, কোঁচ ও পালবংশের রাজাদের শাসনাধীনে ছিল হাজো। হাজো নামের মধ্যেও অনেকের ধারণা অসমিয়ার ‘হা’ শব্দের অর্থ মাটি। আর ‘গজো’ শব্দের ‘জো’ হচ্ছে পবিত্র ভূমি। এরই সরলীকরণে হাজো। যেহেতু হাজো মুসলমানদেরও এক পবিত্র তীর্থস্থান এবং এখানকার মহিমা মক্কার পোয়া অংশের অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশের মতো পবিত্র তাই একে পোয়া মক্কাও বলে।
যাইহোক, আমি পূজার ডালি হাতে নিয়ে খাড়াই বেয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছলাম। মুগ্ধ হলাম মন্দিরের প্রাকৃতিক অবস্থান দেখে। হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মের এমন মিলনভূমি আর কোথাও কিন্তু আমি দেখিনি।
লোকমুখে শুনলাম এই পর্বতের গভীর জঙ্গলে অতীতে উর্ব নামে এক ঋষি তপস্যা করতেন। সেই সময় জয়গ্রীব নামে এক দানব খুব অত্যাচার করত ঋষির ওপর। ঋষি তাই বিষ্ণুর শরণ নিলে বিষ্ণু এসে যুদ্ধ করেন জয়গ্রীবের সঙ্গে। সেই যুদ্ধে জয়গ্রীব নিহত হলে বিষ্ণু জয়গ্রীব মাধব নাম নিয়ে শিলারূপ ধারণ করে এখানে বিরাজ করতে থাকেন।
আরও একটি কাহিনী প্রচলিত আছে এখানে। সেটি হল শ্রীবিষ্ণু অনন্তশয়নে থাকা অবস্থায় ব্রহ্মা এবং তাঁর নাভিকমলে বসে সৃষ্টি চিন্তা করার সময় মধু ও কৈটভ নামে দুই দানব তাঁর বেদ চারখানি চুরি করে নিয়ে পালায়। ব্রহ্মার ধ্যান ভঙ্গ হলে তিনি সে কথা বিষ্ণুকে জানান। বিষ্ণু তখন ধ্যানযোগে সব জেনে জয়গ্রীব দানবের রূপ ধরে এই পর্বত থেকে বেদ চারখানি উদ্ধার করেন। বিষ্ণু জয়গ্রীব রূপ ধারণ করেছিলেন বলেই এখানকার বিগ্রহের নাম হয় জয়গ্রীব জনার্দন বা জয়গ্রীব মাধব।
মাধব মন্দিরের কাছেই আছে ধনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীর মন্দির।
প্রথমেই আমি মাধব মন্দিরে পুজো দিলাম। বিগ্রহ দর্শনে এমনই অভিভূত হলাম যে তা বলবার সাধ্য আমার নেই। পূজারী ব্রাহ্মণ অনেক মন্ত্রধ্বনিতে পূজা করিয়ে ভাবাবেশে আপ্লুত করলেন আমাকে। আমার নিয়ে যাওয়া তুলসী মালা বিগ্রহের গলায় পরিয়ে অন্যের মালা বিগ্রহের গলা থেকে নিয়ে প্রসাদ হিসেবে আমাকে দিলেন। তারপর যা বললেন, তা দারুণ চমকপ্রদ। উনি বললেন, ‘আপনি শ্রীক্ষেত্রে গেছেন কখনও জগন্নাথ দর্শনে?’ বললাম, ‘বহুবার।’
‘এখানে এই যে জয়গ্রীব মাধবকে দেখলেন এই মূর্তি সেই একই উপাদানে গড়া।’
জানতে চাইলাম, ‘কীরকম!’
উনি বললেন, ‘পুরীর জগন্নাথ দেবের মূর্তি নির্মাণ সম্বন্ধে যে কাহিনী প্রচলিত আছে এই কাহিনী তার সম্পূর্ণ বিপরীত। শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথের মূর্তি যে উপাদানে সৃষ্টি হয়েছিল জয়গ্রীব মাধবের মূর্তিও সেই একই উপাদানে নির্মিত। সেকালে ওড়িশার রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তীর্থস্থান হিসেবে ওড়িশার কোনও অঞ্চলকে প্রসিদ্ধ করার জন্য এবং সেখানে দেবমূর্তি প্রতিষ্ঠাকল্পে এক যজ্ঞ করেন। যজ্ঞ সমাপনান্তে এক রাতে ইষ্টচিন্তা করে স্বপ্ন দেখলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলছেন, ‘আমি তোমার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়েছি। কাল ভোরে তুমি একখানি কুঠার হাতে নীলাচলে সমুদ্রতীরে একাকী গমন করবে। সেখানে এক নামহীন অদ্ভুত বৃক্ষ দেখতে পাবে। সেই বৃক্ষটিকে স্বহস্তে সপ্তখণ্ডে ভাগ করবে। মূল খণ্ড দিয়েই আমার মূর্তি নির্মাণ করে বিধিমতো প্রতিষ্ঠা করবে যথাস্থানে।’ স্বপ্নভঙ্গে রাজা অতি প্রত্যুষে কুঠার হাতে একাই চললেন সমুদ্রতীরে। গিয়েই দেখতে পেলেন সেই নামহীন মহান তরু।
স্বপ্নের নির্দেশমতো রাজা সেই কল্পদ্রুমকে সাত খণ্ডে ছেদন করলেন এবং মূল খণ্ড দিয়েই নির্মাণ করলেন শ্রীজগন্নাথদেবের মূর্তি। বলভদ্রদেব ও সুভদ্রার মূর্তিও তৈরি হল আরও দুই খণ্ডে। চতুর্থ খণ্ডটির দ্বারা কাশ্মীরে আদিত্য বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা করলেন। পঞ্চম খণ্ডটি নিলেন শুক্রাচার্য। তাই দিয়ে তিনি শেণ্যদিত্য ভগবানের বিগ্রহ স্থাপন করলেন। পরে দেবগুরু বৃহস্পতি ওই বিগ্রহকে শিলামূর্তিতে রূপান্তরিত করে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ষষ্ঠখণ্ডটি বরুণদেব নিয়ে এলেন কামরূপে। তার এক ভাগ, মলয়গিরিতে এবং ঊর্ধ্বভাগ এই মণিকূট পর্বতে মাধবমূর্তি রূপে প্রতিষ্ঠা করলেন। সপ্তম খণ্ডটি নিলেন কুবের। সেই খণ্ড দ্বারা তিনি নান্দীশ ভগবানের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। মূর্তিটি উত্তর লখিমপুরে বিরাজিত। ইনি মৎস্যাক্ষ মাধব নামে অভিহিত।
পুরোহিতের মুখে এই অভিনব কাহিনী শুনে ধন্য হলাম।
পরে আরও শুনলাম, এক শ্রেণীর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মতে, গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ এখানেই হয়েছিল। তাঁদের মতে কুশীনগর অন্য কোথাও নয়, এই হাজোতেই। হাজোর নাম তখন ছিল কুশবৈ। এই কুশবৈই কুশীনগর। গৌতমবুদ্ধ এখানেই সশিষ্য মদনাচল পর্বতে দক্ষিণমুখী হয়ে বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। এবং তাঁর দেহটি শিষ্যরা মদনাচল পর্বত থেকে নিয়ে এসে মণিকূট পর্বতেই দাহ করেন। (ক্রমশ)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল