বিদ্যার্থীরা শুভ ফল লাভ করবে। মাঝে মাঝে হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় ক্ষতি হতে পারে। নতুন ... বিশদ
অপমৃত্যু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজস্ব একটা মতামত ছিল। পরিণত বয়সে তিনি এ সম্পর্কে তাঁর মতামত মংপুতে থাকাকালীন মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,‘অপমৃত্যু সম্বন্ধে একটা কথা কি মনে হয় জানো, হঠাৎ যে বন্ধন ছিন্ন হয়, হয়তো তা সুসমঞ্জসভাবে ছিন্ন হয় না। যদি আত্মা বলে কিছু থাকে তাহলে তার পুরনো বন্ধন মুক্ত হয়ে নতুন অস্তিত্বে প্রবেশ করবার জন্য হয়তো একটা পথ পার হবার প্রয়োজন আছে। কিন্তু হঠাৎ যদি যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়, সে ছেদ হয়তো ভালো ভাবে হয় না। এক অস্তিত্ব থেকে অন্য অস্তিত্বে প্রবেশ তাই বিলম্বিত অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। জানিনে অবশ্য এসব কি হতে পারে বা না পারে, সমস্তই অনিশ্চিত, তবে মনে হয় অপমৃত্যু অস্বাভাবিক বলেই তার মধ্যে একটা যন্ত্রণা থাকা সম্ভব, তার যে ব্যবস্থা প্রস্তুত ছিল না। সে জন্যে আরো একটা কথা মনে হয়, যদি কারও মৃত্যু আসন্ন হয়ে আসে তখন আসক্ত হয়ে শোকাকুল হয়ে তাকে বন্ধ করাবার চেষ্টা উচিত নয়— আমার জীবনে যতবার মৃত্যু এসেছে, যখন দেখেছি কোনো আশাই নেই, তখন আমি প্রাণপণে সমস্ত শক্তি একত্র করে মনে করেছি— তোমাকে আমি ছেড়ে দিলাম, যাও তুমি তোমার নির্দিষ্ট পথে। নিজের সন্তানকেও আঁকড়ে রাখতে চাইনি। যেতে যখন হবেই, তখন যেন আমার আসক্তি, আমার বেদনা, তাকে মর্ত্যের সঙ্গে বেঁধে না রাখে। তাকে বন্ধন ছিন্ন করবার জন্যে যেন কষ্ট পেতে না হয়, যেন সুগম হয় তার পথ— যেখানে ত্যাগেই মঙ্গল, যেখানে নিরাসক্ত হয়ে ত্যাগ করাই উচিত। ঘটনাপ্রবাহ আমার হাতে নেই, কিন্তু আমি তো আমার হাতে আছি।’
অসংখ্য প্রিয়জনের মৃত্যু খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন আমাদের প্রাণের মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই বোধহয় ঠাকুর বাড়ির প্রাচীন ঐতিহ্য প্ল্যানচেটের প্রতি তাঁর মন একসময় আকর্ষিত হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির একটি প্রিয় বিষয় ছিল প্ল্যানচেট। তার প্রথম উল্লেখ আমরা পাই ‘জীবনস্মৃতি’-তে। ঠাকুরবাড়ির জনৈক খাজাঞ্চি কৈলাস মুখুজ্জেকে যখন প্ল্যানচেটে আনা হয়, রবীন্দ্রনাথ তখন বালকমাত্র। মুখুজ্জেমশাই ইহলোকে রসিক ব্যক্তি ছিলেন। পরলোকে গিয়েও সেই রসিকতা তিনি বিস্মৃত হননি। প্ল্যানচেটের সাহায্যে তাঁকে যখন ডাকা হয় এবং জিজ্ঞাসা করা হয় পরলোক জায়গাটি কেমন, তিনি উত্তর দেন, মরে গিয়ে অতি কষ্টে যা তিনি জেনেছেন, প্রশ্নকর্তারা না মরে তা জেনে নেবেন— সেটি হবে না।
বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথের আর একটি প্ল্যানচেট-কাহিনীর উল্লেখ পাই তাঁরই একখানি চিঠি থেকে। একবার প্রমথনাথ বিশী চিঠি লিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা জানতে চান। কারণ একসময় মাইকেল নিয়মিত না হলেও প্রায়ই ঠাকুরবাড়িতে আসতেন। সেইসময়কার কোনও স্মৃতি রবীন্দ্রনাথের মনে আছে কিনা সেটাই তিনি জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমাদের বাড়িতে মাইকেলের গতিবিধির পরে আমার জন্ম। আমি তাঁকে দেখিনি। একবার প্রেতবাণীবহ চক্রযানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, সেটা সাক্ষ্যরূপে আদালতে গ্রাহ্য হবে না।’
অমিতাভ চৌধুরী লিখছেন, ‘১৯২৯ সালের পর রবীন্দ্রনাথের পারলৌকিক চিন্তাধারায় যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। সেই বছরই তিনি জানতে পারেন, তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু শান্তিনিকেতনের একদা-অধ্যাপক ‘কাব্যগ্রন্থাবলী’-র লেখক মোহিতচন্দ্র সেনের কন্যা উমা দেবীর (বুলা) মিডিয়াম হবার যোগ্যতা আছে। তখন থেকে পরলোক সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল শুধু বাড়েনি, পরলোকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের বাসনাও বেড়েছে। ঠাকুরবাড়ির ধারা অনুযায়ী, আগে যে সব পরলোকচর্চা করেছেন করেছেন সবই প্ল্যানচেট মারফত। ১৯২৯ সালেই সর্বপ্রথম মিডিয়ামের সাহায্য নিলেন। প্রথমে অবশ্য তিনি কিঞ্চিৎ সন্দিগ্ধ ছিলেন।
উমা দেবী বা বুলা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্টই উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তিনি রানি মহলানবিশকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সেদিন বুলা এসেছিল। হঠাৎ কথায় কথায় প্রকাশ পেল তার হাতে প্রেতাত্মা ভর করে পেন্সিল চালিয়ে কথা কইতে পারে। বলাবাহুল্য শুনে মনে মনে হাসলুম। বললুম— আচ্ছা দেখা যাক। প্রথমে নাম বেরোল মণিলাল গাঙ্গুলি। তার কথাগুলোর ভাষা এবং ভঙ্গির বিশেষত্ব আছে। উত্তরগুলো শুনে মনে হয় যেন সেই কথা কইছে।’
কিন্তু কে ছিলেন এই মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়! ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে তাঁর কি কোনও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল? তিনি ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের জামাতা। তাঁরই পুত্র মোহনলাল ও শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায়। ঠাকুরবড়িতেই থাকতেন। ‘ভারতী’ গোষ্ঠীর খ্যাতনামা সাহিত্যিক। বহু ছোট গল্প লিখেছেন। বাংলা রঙ্গালয়ের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। জীবিতকালে মণিলালের বাতিক ছিল প্রেতচর্চা। তিনি মারা যান ১৯২৯ সালে। মনে হয় মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই তিনি এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের পরলোক চর্চার আসরে।
তবে কয়েকদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন বুলা সত্যিই উচ্চমানের মিডিয়াম। এরপর থেকে বুলার এই অদ্ভুত ক্ষমতার প্রতি কবির সত্যই বিশ্বাস জন্মেছিল। এইপ্রসঙ্গে ‘রবীন্দ্রজীবনী’ গ্রন্থে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘বাল্যকাল ও যৌবনে রবীন্দ্রনাথ কৌতুকছলে, কখনও কৌতূহলবশে পরীক্ষা করিয়াছিলেন। বৃদ্ধবয়সে এতকাল পরে পরিচিতা কন্যার মিডিয়ামে অতিপ্রাকৃত রহস্যলোকে প্রবেশের ইচ্ছা হইল। বুলার অসামান্যতার কথা কবির মুখে শুনিয়াছি। অতি জটিল প্রশ্ন করিবার সঙ্গে সঙ্গে অসম্ভব ক্ষিপ্রবেগে তাহার কম্পমান হস্ত হইতে উত্তর লেখা হইয়া যাইত। প্রশ্নের উত্তর দেখিয়া কবি স্তম্ভিত।’
পরলোকচর্চার আসরে মিডিয়ামের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ যেসব আত্মাকে আগ্রহ করে ডেকেছেন তাঁদের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন কবিগুরুর অত্যন্ত ঘনিষ্ট প্রিয়জন তাঁদের মধ্যে ছিলেন নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী, স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, জ্যেষ্ঠাকন্যা মাধুরীলতা (বেলা), কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ, নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ, ভ্রাতুষ্পুত্র হিতেন্দ্রনাথ এবং বলেন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী সাহানা দেবী, ভ্রাতুষ্পুত্রী অভিজ্ঞা, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় সহ আরও অনেকে। শুধু তাই নয় তাঁর সেই আসরে রবীন্দ্রনাথ না ডাকলেও চলে আসতেন অনেকে এবং সেই তালিকাটা মোটেই ছোট নয়।
(ক্রমশ)