পারিবারিক ঝামেলার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি। প্রেম-প্রণয়ে শুভ। অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষে মানসিক চাপ বৃদ্ধি। প্রতিকার: আজ দই খেয়ে ... বিশদ
সন্ধের নিরিবিলি সময়ে তসবিরখানা থেকে বেরিয়ে দাসোয়ান কোথায় চলেছেন কীরকম আলুথালু মুখে দেখে ধন্দে পড়লেন বীরবর।
বেশ কয়েকদিন ধরে খুব বেতাব দেখাচ্ছে তসবিওয়ালাকে। তসবিরখানায় বসে থাকেন চুপচাপ, তুলিতে রং মাখিয়েও তা খাগের কাগজে মাখাতে ভুলে যাচ্ছেন, কেউ গায়ে হাত দিয়ে নাড়া দিলে থতমত খেয়ে ঝুঁকে পড়ছেন কাগজের উপর। কিন্তু যেখানে যে রং যাবে তা যাচ্ছে না। কোথাও শুধু হিজিবিজি রেখা।
অল হিজরি ৯৮৯ মহরম মাস, সম্রাট আকবর বিশাল ফৌজ নিয়ে রওয়ানা দিয়েছিলেন কাবুলের উদ্দেশে মির্জা হাকিমকে কড়কে দিতে। ফিরলেন প্রায় দশ মাস পরে। এই সময়কাল কাবুলে কাটালেন এক তুলকালাম বেচইন অবস্থায়। রাজপুত-জওয়ান মান সিংহের তাগদ দেখে পালিয়ে গেলেন মির্জা হাকিম। কিন্তু বন্দি করা গেল না। বন্দি করতে না পেরে বাদশাহ খুব নাখোশ ছিলেন, শেষ পর্যন্ত মানসিংহের হাতেই সিন্ধু-এলাকার দায়িত্ব দিয়ে ফিরলেন ফতেপুর সিক্রিতে।
বীরবরের সঙ্গে মুলাকাত হতে বাদশাহ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিলেন তাঁর অনুপস্থিতিতে কী পরিস্থিতি এখন কেল্লায়। আকবর ‘মহযরনামা’ পাঠ করায় কেল্লার আমির-উমরাহরা নাখোশ জেনে খুব তাজ্জব হলেন না, বরং বললেন, ধর্ম নিয়ে আবার একদিন তাবির করবেন সবার সঙ্গে। হোক আলোচনা।
মুসলমান ও হিন্দুধর্মের গোঁড়া নেতারা এলেন, এলেন পাদ্রি সাহেবরাও। কিন্তু যে কারণে ইবাদতখানায় আগের সভাগুলো বাতিল করতে হয়েছিল, একই কারণে এবারও একমত হতে পারলেন না কেউ। বাদশাহ চাইছিলেন সব ধর্মকেই নিয়ে চলতে, সবাই একমত হলে শাহানশাহিতে চালু হোক একটিই ধর্ম।
আকবরের কাছের মানুষরা ছাড়া বাকি সবাই ইবাদতখানা ছেড়ে চলে গেলে বীরবর বললেন, জাহাঁপনা, আপনার চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে বাকিদের জহিনের অনেকটাই ফারাক। সমস্ত উলেমা আপনাকেই ইসলামের তরক্কির দায়িত্ব নিতে বলেছে। ‘মহযরনামা’য় আপনাকেই ‘সুলতানে আদিল’ বলা হয়েছে। আপনিই এখন ইসলামের ইমাম—ধর্মগুরু। আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে ধর্মমত কী হবে সে-বিষয়ে।
বাদশাহ তাকালেন আবুল ফজলের দিকে, বললেন, ফজল, তুমি তো লিখছ আমার জীবনী তুরুক। তাতে এক জায়গায় লিখেছ আকবর খোদ আদমের ওয়ারিশ। মুজতাহিদ— যুগন্ধর পুরুষ। তাঁর শরীর থেকে নিয়ত বিচ্ছুরিত হয় ঐশ্বরিক আলো। দেখার চোখ থাকলেই ওই আলো দেখা যায়। বাদশাহের সার্বভৌমত্ব তো ওই ঐশ্বরিক আলোর প্রকাশ। তুমি কী বলো?
আবুল ফজল দিন দিন দানেশমন্দ হয়ে উঠছে আরও। দু’চোখে সর্বদাই একটা ঘোর। সামনে কাউকে দেখে না, তার দৃষ্টি থাকে অনেক দূরে, সে রকমই আবছা চোখে বাদশাহের কথা শুনে হাসল এক ঝলক।
বীরবর আড়চোখে তাকাচ্ছিলেন বদায়ুনের দিকে। তাকে দেখে কিছু মালুম করা যায় না, কিন্তু তার দাঁত যে কিড়মিড় করছে তা দিব্যি বুঝে নেওয়া যায়।
বাদশাহ জানতে চাইলেন, আর কেউ কিছু বলবেন?
বাকিরা চুপ করে আছে দেখে বাদশাহ একটুও চিন্তিত না হয়ে বললেন, বীরবরজি, আমি আন্দাজ করেছি আমার সঙ্গে একমত হওয়া কারও পক্ষেই মুশকিল। ঠিক আছে, ক’দিনের মধ্যে এ বিষয়ে যা ভেবেছি তা প্রকাশ করব সবার সামনে।
সম্রাট আকবরের নতুন ধর্মমত প্রকাশের ঠিক আগে হঠাৎ এন্তেকাল ঘটল হাজি বেগমের। তাঁর দাফনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আকবর পিছিয়ে দিলেন ঘোষণার দিন।
অবশেষে জুলকাদা মাস, অল হিজরি ৯৮৯, বাদশাহ সবাইকে নিয়ে বসলেন, বললেন, সকল প্রতিষ্ঠিত ধর্মই প্রকৃতপক্ষে সত্য। প্রত্যেকের ধর্ম সমানভাবে দেখা দেয় যার-যার কাছে। সমকালীন ভক্তি আন্দোলন অনুযায়ী ইনসান-ই-কামাল বা গুরুর উপর গুরুত্ব দিতে হবে। অনুসরণ করতে হবে ‘সুল্ক-ই-কুল’-এর পথ। কুল অর্থে ভ্রাতৃত্ব। সুল্হ অর্থে পথ। সুল্হ-ই-কুল— এটি শাহানশাহির এমন একটি ভাষ্য যার মাধ্যমে সকল ধর্মের সার কথাকে শ্রদ্ধা জানানো ও গ্রহণ করা হয়। এই ধর্ম বিভিন্ন ধর্মের ঐক্যের উপর জোর দেয়। এই ধর্মের নাম ‘তওহিদ-ই-ইলাহি’। আজ থেকে ইসলামের চান্দ্র-বছরের পরিবর্তে সৌর-বছর চালু হবে। এই ধর্মমতে থাকবে সর্বেস্বর বাদ। এই ধর্মমতে কোনও জীবন্ত প্রাণীকে হত্যা করা নিষেধ। জং ছাড়া অন্য কোনও সময় অস্ত্র বহন করা নিষেধ। হিন্দুরা পারবে না সতীদাহ করতে। মুসলমানরা পারবে না গোহত্যা করতে। হিন্দুদের মূর্তিপুজো যেমন সমর্থন করি না, তেমনি মানি না মুসলমানদের প্রার্থনা-রীতি। হিন্দুস্তানের সব ধর্মের গুরুদের কথা আমি শুনেছি। সব ধর্মের সারটুকু নিয়ে রচনা করেছি এই নতুন ধর্ম ‘তওহিদ-ই-ইলাহি’। এই ধর্মের আচরণবিধিতে আছে উদারতা, পরোপকার, ক্ষমা, কোমলতা। জাগতিক লিপ্সা থেকে সংযম, পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্তি। সকল ধর্মের উপর জোর দিতে চেয়েছি এই ধর্মাচরণে। শাসক ও প্রজাদের মধ্যে এক আধ্যাত্মিক বন্ধন সৃষ্টিকারী বন্ধন। এই ধর্ম অনুসরণ করলে অবসান ঘটবে সুন্নি-শিয়া ও অন্যান্য সকল ধর্মের মধ্যে বিরোধের।
এই পর্যন্ত বলে বাদশাহ তাকালেন সবাইকার দিকে। আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন উপস্থিত উলেমা, আমির-উমরাহদের কার কী মতামত। বললেন, আজ থেকে এই ধর্ম সবার মধ্যে প্রচার করব। সবাইকে অনুরোধ করব এই ধর্ম গ্রহণ করতে। আপনাদের কোনও বক্তব্য থাকলে তা স্পষ্ট করে বলুন।
বাদশাহের কথা মানেই হুকুম, তাঁর সামনে ধর্ম নিয়ে বিরোধিতা করার তাগদ কারও নেই, তবু প্রথমেই উঠলেন রাজা ভগবান দাস। বললেন, জাহাঁপনা, হিন্দুস্তানের দুটি প্রধান ধর্মের মানুষ হিন্দু ও মুসলমান। দুটি ধর্মেরই কিছু ভালো, কিছু মন্দ দিক আছে। এখানে যাঁরা উপস্থিত আছি, তাঁরা কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান। জাহাঁপনা, যদি স্পর্ধা মনে না করেন, আপনার কাছে জানতে চাই, এই নতুন ধর্ম— যাকে আপনি বললেন, ‘তওহিদ-ই-ইলাহি’ তা হিন্দু বা মুসলমান ধর্ম থেকে কতটা আলাদা?
বাদশাহের মুখ গম্ভীর, হঠাৎ বললেন, আপনার যদি এই ধর্ম গ্রহণ করতে আপত্তি থাকে, আমি নিশ্চয় জোর খাটাব না। তবে কোনও শর্ত ছাড়াই কেউ যদি এই ধর্ম গ্রহণ করতে রাজি থাকেন, তা হলে এখনই বলুন।
সারা কোঠিতে সবাই চুপচাপ। বাদশাহ হঠাৎ বললেন, মান সিংহ? তুমি কি আমার নীতি অনুসরণ করতে চাও?
মান সিংহ তার কুরশিতে বসেছিল মুখ নিচু করে, বাদশাহ তার নাম উচ্চারণ করবেন তা ভাবেনি, চমকে উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানিয়ে বলল, জাহাঁপনা, আপনি ওয়াকিফ আছেন সেই বচপনে যখন অম্বর ছেড়ে আপনার তাঁবে এসেছি, তখন থেকেই আপনার নীতি অনুসরণ করেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমার ধর্ম ত্যাগ করিনি। আমি এখনও কঠোরভাবে একজন হিন্দু। আপনি হুকুম করলে আমি মুসলমান হতে রাজি আছি, কিন্তু আপনার প্রচারিত নতুন ধর্ম বিষয়ে আমি এখনও কিছুই বুঝিনি, সেই ধর্ম গ্রহণ করতেও অপারগ।
সম্রাটের মুখ কিছুক্ষণ লাল, কিন্তু কিছু বললেন না মান সিংহকে, বরং বাকিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই সভায় কেউ কি আছেন যিনি এই নতুন ধর্ম অনুসরণ করতে ইচ্ছুক?
উঠে দাঁড়ালেন বীরবর, বললেন, জাহাঁপনা, তেইশ বছর আগে আপনার দরবারে এসেছিলাম, তখন থেকে আপনি যখন যেরকম বলেছেন তা সাধ্যমতো তামিল করার চেষ্টা করেছি। আজও আপনি যা হুকুম করছেন, আমি হাসি মুখে তামিল করছি। আমি আপনার নতুন ধর্মমত গ্রহণ করব।
এক লহমায় সম্রাট আকবরের মুখে তজল্লি, অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বীরবরের মুখের দিকে। বললেন, ঠিক আছে, আজ এই সভার এখানেই ইতি। আপনারা যে যার কোঠিতে ফিরে যান। বিষয়টা নিয়ে ভাবুন। কারও উপর কোনও চাপ থাকবে না। যিনি মনে করবেন ‘তওহিদ-ই-ইলাহি’র ধর্মমত অনুসরণ করবেন, তাঁকে দীক্ষিত করা হবে এই ধর্মে।
বদায়ুন বেরিয়ে যাওয়ার সময় বীরবরকে নিচু গলায় বললেন, ‘তওহিদ-ই-ইলাহি’ বলছেন, কেন? বলুন ‘দীন-ই-ইলাহি’।
বাদশাহ সভা ভেঙে দিতে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন সবাই। একে-একে উঠে বেরিয়ে গেলেন কোঠি থেকে। বসে রইলেন শুধুমাত্র সম্রাট আকবর আর বীরবর।
সম্রাট তখনও বিহ্বল, তাঁর মুখে কোনও রাগ বা বিরক্তির চিহ্নমাত্র নেই, বরং প্রসন্ন মুখে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, বীরবরজি, আজ আপনি আমার মুখ রক্ষা করেছেন—
বলে হঠাৎ বীরবরকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হিন্দুস্তানে এসে বহু ইনসানকে দেখলাম, বহু দানাদার আদমিকেও দেখলাম, কিন্তু আপনার মতো দানেশমন্দি কারও মধ্যে দেখতে পাইনি। আপনি আমার খুব কাছের দোস্ত। আপনি এই দীর্ঘকাল আমার পাশে পাশে থেকে আমাকে যেভাবে মদত দিয়েছেন, তার কারণেই হিন্দুস্তানের ইতিহাসে আমার নাম অন্যভাবে লেখা থাকবে।
বীরবর বিহ্বল বোধ করছিলেন, হিন্দুস্তানের বাদশাহ তাকে জড়িয়ে ধরে যে-খাতির দেখালেন তা তাঁর প্রত্যাশার বাইরে, বললেন, জাহাঁপনা, আমারও মনে হয়েছে আপনার কেল্লায় কত আমির-উমরাহ আছে, শাহানশাহিতে কত মনসবদার আছে, কিন্তু আপনি আমাকে যে খাতির করেছেন তা আর কেউ পায়নি। আবার সেই কারণেই আপনার দেওয়ান, মির বকশি, মির আতিস থেকে শুরু করে যাবতীয় দানাদার আদমি— সবারই আমি না-পছন্দ। এমনকী আবুল ফজল— যাকে আমি প্রথম থেকে নানাভাবে মদত দিয়ে আসছি, তার লেখা তুরুকেও আমার নাম তেমনভাবে উল্লেখ থাকছে না!
সম্রাট আকবর জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে বললেন, তা আমি লক্ষ করেছি, বীরবরজি। ফজল আমাকে বলল, তার লেখা তুরুকে শুধু বাদশাহের জংয়ের কথা লেখা থাকছে। আপনি তো খুব কমই গেছেন জং করতে, তাই আপনার নাম উল্লেখ করেনি। তবে তাতে কিছু যায় আসে না। আমি নিশ্চিত হিন্দুস্তানের সমস্ত ইনসান কোনও না কোনওভাবে ইয়াদ রাখবে আপনাকে। ঠিক আছে, এর পরে যদি কোনও জং করি, আপনাকে নিশ্চয় ফৌজ দিয়ে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু আজকের দিনটা ইয়াদ করে রাখতে আমি চৌগান খেলা করব।
চৌগান খেলা সম্রাটের খুব প্রিয়। বীরবর জানেন ঘোড়ার পিঠে চড়ে চৌগান খেলা খুবই ঝুঁকির। ঝুঁকির হলেও বীরবর আজ পর্যন্ত সম্রাটের সব হুকুম তামিল করেছেন, সেদিনও করলেন।
শাহেনশাহ আকবর বহুকাল পরে চৌগান খেলবেন এই সংবাদে মাঠে বহুত জমায়েত— সম্রাটের পাশে পাশে থেকে ঘোড়ায় চড়াটা ভালোই রপ্ত করেছেন বীরবর। তবে তাতে চৌগান খেলতে পারবেন কি না সংশয় ছিল তাঁর। মাঠের চারদিকে বেশুমার আদমি। আমির-উমরাহ-মনসবদার সবাই উপস্থিত।
খেলা শুরু হতেই বীরবর বুঝলেন চৌগান খেলায় সম্রাট খুবই চোস্ত। এক হাতে লাগাম, অন্য হাতে একটি ভারী লাঠি নিয়ে প্রবল গতিতে ছুটে আসছেন, তাঁর লাঠির আঘাতে চৌগানটিও দৌড়ে চলেছে মাঠের ঘাস বরাবর। বীরবর তার নাগালই পাচ্ছেন না!
কিছুক্ষণের মধ্যে বীরবর আন্দাজ করলেন চৌগান খেলা রপ্ত করতে তাঁর এখনও ঢের দেরি। আকবরের কাছে একেবারেই শিশু। বরং তীব্র গতিতে ঘোড়ায় চড়ে ছোটার মুহূর্তে হঠাৎ এক ঝাঁকুনি খেয়ে উল্টে পড়লেন মাটিতে। তিনটে পাক খেলেন ঘাসের উপরে, তার পরে আর কিছুই ইয়াদ নেই তাঁর। একটু পরে জ্ঞান ফিরতে দেখলেন তিনি শুয়ে আছেন মাটিতে, আকবর তাঁর শরীরের উপর ঝুঁকে পড়ে, পাগলের মতো তাঁর ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে ফুঁ দিয়ে হাওয়া ঢুকিয়ে চেষ্টা করছেন তাঁকে সুস্থ করতে।
একটু পরেই তিনি উঠে বসতে সম্রাট হাঁফ ছেড়ে বললেন, খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন, বীরবরজি।
বীরবর খুবই অস্বস্তিতে। স্বয়ং সম্রাট তাঁকে সুস্থ করতে যেভাবে কোশিস করলেন তা দেখে জমায়েতের সবাই তাজ্জব।
সেদিন সম্রাট তাঁকে হাতি দিলশঙ্করের পিঠে তুলে নিয়ে পৌঁছে দিলেন তাঁর কোঠির মধ্যে।
বীরবরের জন্য বাদশাহের আকুলতা, এতখানি দরদ দেখে কেল্লায় শুরু হল কানাকানি। সবচেয়ে নাখোশ বদায়ুন, বীরবরের সঙ্গে দেখা হতে চোরা হেসে বললেন, বীরবরজি, আপনি একটা—
তারপরে যে-শব্দটা উচ্চারণ করলেন তা শুনে বীরবর স্তম্ভিত। একজন দানাদার আদমি এরকম একটা অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন তা চিন্তার বাইরে। বীরবর মুচকি হেসে শুধু বললেন, বদায়ুনজি, হিংসেয় জ্বলতে থাকলে দানাদার আদমিও মিশকিন হয়ে যায়।
বদায়ুনকে তাজ্জব করে দিয়ে বীরবর ফিরে এলেন নিজের কোঠিতে। পরের দিনই সম্রাট বীরবরকে তলব করে বললেন, আপনাকে আকবরপুরে যে-জমি দেওয়া হল— সেখানে একটা কোঠি তৈয়ার করার কথা বলেছিলাম তা ইয়াদ আছে?
—ইয়াদ আছে, জাহাঁপনা। সেখানে কোঠি তৈয়ার হচ্ছে।
সম্রাট গম্ভীর গলায় বললেন, আমি সামনের মাসে ওখানে যাচ্ছি, আপনার কোঠিতে মেহমান হিসেবে ক’দিন থাকব।
বীরবর আন্দাজই করতে পারছিলেন না সম্রাট ঠিক কথা বলছেন কি না! তাঁর একটা কোঠি তৈয়ার হচ্ছে ঠিকই, সেখানে তাঁর পরিচয় একজন মনসবদার। তাঁর মনসবে দো’হাজার ঘোড়া থাকার কথা। সম্রাটের হুকুমে সেই কোঠি বেশ জেল্লাদার হচ্ছে। সেখানে তিনি থাকবেন কি না এখনও ভাবেননি। সিক্রির কেল্লায় তাঁর একটা হাভেলি আছে, সেই হাভেলি অনেক বেশি জেল্লাদার। কোথায় তাঁর আসল নিবাস হবে তা এখনও ভাবনার বাইরে।
পরের দিনই বীরবর রওয়ানা দিলেন আকবরপুরের উদ্দেশে, আর তাজ্জব কি বাত, আকবর পরের দিনই সেখানে গিয়ে হাজির, সঙ্গে বিশাল কাফেলা।
হিন্দুস্তানের শাহেনশাহ যদি মেহমান হয়ে আসেন কোঠিতে, বীরবর কীভাবে খাতির দেখাবেন!
তখনও বিস্ময়ের বাকি ছিল বীরবরের। বাদশাহ হাসি-হাসি মুখে বললেন, বীরবরজি, আমার আওলাদ— শাহজাদা সেলিমের শাদি। মহরম মাস অল হিজরি ৯৯২। আপনাকে দাওয়াত দিতে এলাম আপনার কোঠিতে।
হিন্দুস্তানের শাহেনশাহ এই দীর্ঘ সড়ক পার হয়ে তাঁর কাছে এসেছেন শাহজাদার শাদির দাওয়াত দিতে! এত তশরিফ, এত সমাদর কখনও কী প্রত্যাশা করেছিলেন বীরবর! দু’হাজারি মনসবদার হয়ে কয়েকদিন নিজের কোঠিতে কাটিয়ে বীরবর ফিরেছেন ফতেপুর সিক্রিতে, অনেক তজল্লি ছিটিয়ে সম্পন্ন হল শাহজাদা সেলিমের শাদি, কেল্লায় তখনও খুসবু ছুটছে বিরিয়ানি, হালোয়া, ফিরনির।
শাদির রওশন শেষ হলে বীরবর ব্যস্ত হয়ে তদারকি করছেন কখনও মকতবখানার তরজমার কাজ, তসবিরখানার তসবির আঁকার কাজ, খুশনবিশখানায় লিখনের কাজ, জিলখানার বাঁধাইয়ের কাজ। এক-একটা কিতাব প্রস্তুত হলে সেটি তুলে দিচ্ছেন বাদশাহের হাতে। বাদশাহ খুবসুরত আখরগুলির দিকে চোখ রেখে পরের মুহূর্তে নজর দিচ্ছেন তসবিরগুলির দিকে। কোনও তসবির পছন্দসই হলে জানতে চাইছেন কার আঁকা। বীরবর জানাচ্ছেন, কোনওটা বাসোয়ানের আঁকা, কোনওটা দাসোয়ানের আঁকা, কোনওটা কেসুলাল, মুকন্দ, জগন মহেশ, মধু, হরিবংশ বা রামের আঁকা। বীরবর খেয়াল করছিলেন দাসোয়ানের কথা উঠতেই মুখ গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিল সম্রাটের।
কেন তা বীরবর আন্দাজ করতে পারছিলেন, কয়েকদিন পরে এক সুবাহ কালে হারেমের পাহারাদার মাসুদ খাঁ ছুটতে ছুটতে এসে বীরবরের কাছে খবর দিল, হুজুর, খুদকুশি— আত্মহত্যা।
বীরবর চমকে উঠে বললেন, কোথায়? কে? কেন?
বীরবর দ্রুত উঠে চললেন কেল্লার পাঁচিলের ওপাশে, এক নিরিবিলি কোণে, তার পিছু পিছু গিয়ে স্তম্ভিত। সেখানে জমায়েত হয়েছে কেল্লার আরও বহু মানুষ। দেখলেন দাসোয়ানের অত বড় শরীরটা পড়ে আছে মাটির উপর। তার গলায় গিঁথে আছে একটি ধারালো বল্লম। চারপাশের মাটি খুনে লাল। (ক্রমশ)
অলংকরণ : সুব্রত মাজী