পারিবারিক ঝামেলার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি। প্রেম-প্রণয়ে শুভ। অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষে মানসিক চাপ বৃদ্ধি। প্রতিকার: আজ দই খেয়ে ... বিশদ
একদিন হঠাৎ সে হাজির হয়েছিল আমার বাড়ি। আমি তখন বাইরে।
স্ত্রীকে জিগ্যেস করে, ‘আচ্ছা বউদি, দাদা নাকি গপ্প নেকে?’
—‘কেন বল তো?’ কৌতূহল নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে মিতা।
—‘না, আমি এট্টা গপ্প বলতাম।’
এবার ঠোঁটে হাসি এনে মিতা বলে ‘তাকে পাওয়া কি অত সোজা! সারাদিন টো-টো করে কোথায় যে ঘোরে!’
—‘তালে নেকে ককন?’
—‘ওই রাতে। শুতে যাবার আগে।’
—‘অনেক রাত হয় বুজি!’
—‘হ্যাঁ, তা তো হয়।’
—‘দ্যাকো কাণ্ড! শরীল খারাপ হবে যে।’
মিতার তখন সংসার সামলানোর সময়। এসব কথা বেশি দূর গড়াতে দেওয়া যায় না। হয়তো একটু বিরক্তির ঢঙেই বলেছিল, ‘তা জানি না বাপু। হলে আর কী করা যাবে।’ ব্যস। মা জীবিত থাকতে পুষ্পদি এ বাড়িতে কাজের সময় যেভাবে আপনমনে ছড়ি ঘোরাত, প্রায় সেই মুড নিয়েই বলে বসল, ‘এটা কেমন কতা বউদি? দাদার শরীল দেকার নোক আর কে আচে বলো।’
মিতার কটমটে দৃষ্টিতে একটুও না টলে সে বলে, ‘মা বেঁচে থাকতে এ কতা শুনলে কী যে কষ্ট পেত!’
এরপর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার আর কোনও মানে খুঁজে পায়নি মিতা।
বেচারি পুষ্পদি বা কতক্ষণ দরজা আগলাবে। সেও বিদায় নিয়েছে, না বলেই। পুষ্পদির সঙ্গে মিতার পরিচয় হয়েছিল, আমাদের ছেলের জন্মের পরে পরেই। পুষ্পদির তখন অন্য পাড়ায় ঘর। মা খোঁজখবর করে ধরে এনেছিল বাচ্চা সামলাবার জন্য।
যা হোক, বাড়ি ফিরে মিতার থেকে এইটুকু আমার শোনা। এরপর গল্পের খোঁজে নিজেই পুষ্পদিকে খুঁজেছি এখানে ওখানে। ইদানীং সেও আমার পাড়ারই একটা বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে আছে। কিন্তু দেখা মেলেনি।
একদিন বাজার করতে করতে হঠাৎ দেখি, পাঞ্জাবি ধরে কে যেন হালকা টান দিচ্ছে। ঘুরতেই পুষ্পদির হাসি হাসি মুখ। সেই সঙ্গে চোখে কৌতূহল ও প্রশ্ন। যা দেখে নিজেই উত্তর দেওয়ার তাগিদে বললাম, ‘শুনেছি। তুমি বাড়ি গেছিলে। তা এসো না, আর একদিন।’
—‘তুমি কি বাড়ি থাকো?’
—‘হ্যাঁ, হ্যাঁ থাকব। আজই চলে এসো সন্ধেবেলা।’
—‘আচ্চা যাব কোন। তোমার বউ রাগ করবে না তো?’
বুঝলাম, মিতার সেদিনের ব্যবহার পুষ্পদির ভালো লাগেনি।
বললাম, ‘না না, তুমি এলে সে খুশি হবে বরং।’
পুষ্পদি সম্মতির ঘাড় নেড়ে বলল, ‘বাড়িতে কিচু শাকপাতা হয়েচে। তোমার জন্য নে যাব?’
—‘আনতে পার।’
—‘বাজার থেকে ওগুনো তালে আর কিনোনি দাদা।’
—‘ঠিক আছে।’
প্রায় মায়ের বয়সি মানুষটা। ছোটবেলায় কোলেপিঠেও উঠেছি। কিন্তু দাদা ডাকটা আদর করে হোক বা সমীহ করে, তা নিয়ে কোনও দিন প্রশ্ন বা আপত্তি তুলিনি। যদিও আজ কেমন ডাকটা বেমানান ঠেকল। সেটা কি মায়ের স্থানটা ইতিমধ্যে ফাঁকা হয়ে যাওয়ার জন্য! ভিতরের কথা চাপা দিয়ে বললাম, ‘বেলা হয়ে গেল। বাজারটা সেরে নিই তাহলে। তুমি কিন্তু চলে এসো।’
পুষ্পদি অন্যমনস্ক হয়ে ঠায় আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে।
বললাম, ‘কী ভাবছ?’
সে ঘাড় নেড়ে জানাল, ‘কিছু না।’
এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। পুষ্পদির দেখা নেই। আমার উশখুশ ভাব দেখে একসময় মিতা প্রশ্ন করল, ‘কী হল? কেউ আসবে নাকি!’
—‘হ্যাঁ, সকালে পুষ্পদির সঙ্গে দেখা। বলল তো সন্ধে নাগাদ আসবে। আমাকে আবার বেরতে হবে।’
—‘বসবে তো গিয়ে ওই চায়ের দোকানে। একটু ওয়েট করে গেলেই হয়।’
এই চায়ের দোকানে বসা নিয়ে মিতার কাছে মাঝে মাঝেই আমার খোঁটা শুনতে হয়। ওর মতে, যত স্ট্যাম্পড লাগানো বেকার সব ওখানে গিয়ে বসে। কী করে বোঝাই যে, আমাদের মতো লোকের জন্য ওটাই হল আসল ছিপ ফেলার জায়গা। কখন যে ফাতনা নড়ে উঠবে কেউ জানে না। একটা চালু চায়ের দোকানে যে কত খবর এসে জড়ো হয়। তার ওপর কতরকম লোক, কত চরিত্র! তাদের দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতেই কল্পানার ঘনঘটা। যাক, পুষ্পদির জন্য আরও একটু সবুর করেই না হয় বেরনো যাবে। এইসব প্রান্তিক মানুষদের গালগল্প শহুরে পাঠকের কদর পায়। কাগজের অফিস তা বোঝে। নিজেদের ভোগ আরাম-আয়েশের সঙ্গে সঙ্গে সাব অল্টার্নদের কষ্ট দুর্দশার জ্ঞানটুকু তারা প্রিন্ট কিংবা বৈদ্যুতিন মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে চায়। সেদিন তো একজন সম্পাদক বলেই বসলেন, ‘আরে! মশাই, শহরের বাইরে একটু-আধটু ঘুরুন। ঘরে বসে কি মন্দির দর্শন হয়? সিনিয়রদেরও একই বক্তব্য। কিন্তু বললেই তো হল না। ঘুরতে তো পয়সা লাগে। কে দেবে শুনি! একটা গল্প দু’পায়ে দাঁড়ালে তবে হাজারখানেক মেলে। প্রাইভেট ফার্মে লে অফ হবার পর মনে হয়েছিল, লিখেই তুলে নেব ওই টাকা। তখন টাকাকে টাকা, যশকে যশ। এখন বুঝি, কত ধানে কত চাল। নেহাত বাপের কিছু মালকড়ি ছিল, তাই চলে যাচ্ছে।
এদিকে সময়ের বেশি অপেক্ষা করেও পুষ্পদি যখন এল না, গুটি গুটি বেরিয়ে পড়লাম। আজ চায়ের দোকানে না গিয়ে, কাছাকাছি একটা পার্কের দিকে হাঁটা লাগালাম। যদিও এটা নামেই পার্ক। পুরনো দোলনাটা ভাঙা। ঘাসের আগাছায় ভেতরে পা ফেলার জো নেই। পায়ে হাঁটা রাস্তার দু’দিকে দু’টো মুখোমুখি বেঞ্চির কোনওটাই বসার উপযুক্ত না। নামমাত্র জ্বলা দু’একটা বাল্বের ম্রিয়মাণ আলো জায়গাটাোক আরও বিষণ্ণ করে তুলেছে। অতএব একটা চক্কর মেরে, সেই চায়ের দোকানেই ঢুকতে হল আবার। ভেতরে দু’চারজন অচেনা খদ্দের একটু উঁচু গলায় কথা বলছিল। আমার দেখে দিনু বলল, ‘দাদা লিকার তো? একটু লেবু চলবে?’
—‘হ্যাঁ দে।’ দিনু চায়ের গ্লাসটা আমায় এগিয়ে দিতেই ওদের একজন ধমকের সুরে দিনুকে বলল, ‘কিরে আমরা কি খদ্দের না?’
দিনু বলল, ‘ওনারটা লিকার তাই আগে দিলাম। আপনাদেরটায় দুধ ঢেলে দিচ্ছি।’
ওই তিরিক্ষি মেজাজের লোকটাকে আগেও দেখেছি বটে, কিন্তু তার বেত্তান্ত জানা নেই। ওরা চলে যেতে দিনুকে জিগ্যেস করলাম, ‘লোকটা কে রে?’
—‘আরে, এ হল কাজের মাসি পুষ্পদির বর। দিনের বেলা চা আর রাতে মদ। এই দুই নেশা নিয়ে আছে। আর যা জানি, সে দাদা আপনাকে বলা যাবে না।’
ভাবলাম, যে গল্প খোদ পুষ্পদির থেকে শোনার ছিল। তার শুরুটা অন্তত অন্যের থেকে জানা গেল। মায়ের কাছেও পুষ্পদি তার দুঃখের কথা কিছু কিছু বলত। একজন মহিলা হিসেবে মা-ও সেই দুঃখের ভাগীদার হয়ে দু’-এক কথা বলত বটে, তবে খুব নিচু গলায়। যাতে কেউ শুনতে না পায়। সেই থেকেই বুঝেছিলাম, এমন কিছু মেয়েলি দুঃখ আছে, যা পুরুষদের সঙ্গে ভাগাভাগি হয় না।
আমার চিন্তার জাল ছিঁড়ে এরপর দিনু আরও একটু এগিয়ে বলল, ‘পুষ্পদির ছেলেটাকে দেখেছেন?’ আমার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকেই বলল, ‘ও হল আসলে এই লোকটার আগের পক্ষের ছেলে। নিজের বাবাকে ছেড়ে সে সৎমায়ের সঙ্গে থাকে। ছেলের বউটাও নাকি খুব ভালো।’—‘তা তুই এসব কোত্থেকে জানলি?’ আমি বললাম। দিনু বলল, ‘পুষ্পদি নিজেই একদিন চা খেতে এসে বলছিল।’ এইটুকু বলে, দিনু নিজের ফেলে রাখা কাজে আবার মন দিল।
যাক, সংসারের এই দিকটায় পুষ্পদি অন্তত কিছুটা হলেও শান্তি পয়েছে। মনে মনে ভাবলাম। বহুদিন সম্পর্ক নেই। কিন্তু পুষ্পদি মানুষটা যে ভালো, তা অনেকের থেকেই আমার বেশি জানা। কিন্তু আসবে বলেও কেন যে এল না, কে জানে।
দিনুর চায়ের দোকান থেকে জায়গাটা ঠিক দৃশ্যমান না হলেও, শোরগোলটা হাওয়ায় ভেসে আসছে। কান খাড়া করতেই আওয়াজটা আরও স্পষ্ট হল। দিনুও শুনেছে।
বলল, ‘দেখবেন দাদা, এবার একটা কাণ্ড হবে।’
—‘কেন?’
—‘ওরা আমার এখানে বসেই ঘোঁট পাকাচ্ছিল। বলে, ছেলের বউ আর পুষ্পদি মিলেই নাকি ছেলেকে ওই লোকটার থেকে বের করে এনেছে। তাই ওদের শিক্ষে দিতে হবে। বোধহয় ওরাই কোনও গন্ডগোল বাধিয়েছে।’
—‘সে কী কথা! এটা তো জোরজুলুম হচ্ছে!’
দিনু দার্শনিকের মতো আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘এটা তো জোরজুলুমেরই যুগ দাদা। ভালো-মন্দের বিচার আর কোথায় আছে?’
বিশেষ প্রতিবাদী হিসেবে এ মহল্লায় আমার কোনও পরিচয়ই নেই। ছোটখাট সভা সমিতিতে একটু-আধটু মনের কথা বলার সুযোগ পাই, ওই পর্যন্ত। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনও এক অদৃশ্য শক্তি যেন আমায় ঠেলা মেরে দোকানের বাইরে নিয়ে এল। শরীর মনে একটা উত্তেজনা। দিনু বুঝতে পেরে বলল, ‘এই দেখো, এতসব বলেই ভুল করলাম দেখছি। আপনি আবার লেখার মশলা জোগাড় করার জন্য ওই গন্ডগোলের মধ্যে যাচ্ছেন নাকি!’
ওর কথায় কর্ণপাত না করেই শোরগোলের দিকে এগিয়ে চললাম। সামনে গিয়ে দেখি দু’পক্ষের মধ্যে অকথ্য খিস্তি-খাস্তা চলছে। এর ভেতর নাক গলানোটা কি ঠিক হবে!
ভাবতে ভাবতেই দেখি, ঘরের ভেতর থেকে অল্পবয়সি একটা বউ হাতে কাটারি উঁচিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। গলার শির ফুলিয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে বলছে, আয় দেখি কত মায়ের দুধ খেয়েছিলি তোরা। অন্যদিকে ওই লোকটা মানে পুষ্পদির বরও সবাইকে শুনিয়ে পুষ্পদির উদ্দেশে বলছে, ‘শালা ওটাই হল যত নষ্টের গোড়া।’ আশপাশে বস্তির লোক জড়ো হলেও কারওরই এগবার ইচ্ছে নেই। বস্তির ঘিঞ্জির রাস্তার টিমটিমে আলোর মধ্যেও বউটার চোখমুখে উত্তেজনার পারদ। তার হাতের কাটারিটাও তেমনই চকচকে। পরিণতি আঁচ করে লোকগুলো যেন পিছু হটছে। এবং খানিকবাদে আস্ফালনটুকু সম্বল করে তারা কেটেও পড়ল। উত্তেজনা থিতিয়ে আসতে আমি পুষ্পদির নজরে এলাম। তাতে সে যেন মস্ত বল পেল। ছুটে এসে বলল, ‘নিজের চোকেই সব দেখলে তো দাদা? বিকেল থেকেই হারামিগুলো ঘুরঘুর কচ্চে। ছেলেটা তকুন কারখানায়। বউটা ঘরে এগলা। তাই দরজা ধরে বসে ছিলুম। আরে বাবা, কাকের বাসায় কোকিল ডিম পেড়েচে তো কি, কুনোদিন কাককে সেই ডিম ছেড়ে যেতে দেকোচো? কুন ছোট থেকে মানুষ করেচি। আর ওই বদ নোকটা কুত্থেকে একটা মেয়েমানুষ ঘরে নে এল। একুন আবার এয়েচে রোজগেরে ছেলেকে ফিরিয়ে নে যেতে।’
আমি ওকে শান্ত করে ঘরের দিকে পাঠালাম। ওর সৎ ছেলে তখন বাইরের খাটিয়ায় বসে। নাকে মুখে রক্ত। বুঝলাম, মারপিটও হয়েছে। পুষ্পদি একটা ঘটির জলে তার শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে পরম স্নেহে ছেলের রক্ত মুছিয়ে দিতে লাগল।
দৃশ্যটা দেখে একটু ঈর্ষা হল। স্মৃতির অতল থেকে উঠে এল ছোটবেলার সেই দিনটা। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ছাদে ঘুড়ি উড়িয়ে সুতোর মাঞ্জায় কাটা আঙুলের করগুলোয় পুষ্পদি কী যত্ন করেই না মলম লাগিয়ে দিচ্ছিল। এছাড়াও বিভিন্ন ঘটনা দেখে মা বাবাকে বলত, পুষ্প কিন্তু আমাদের বাবুকে ছেলের মতো ভালোবাসে।
যা হোক, স্মৃতি ঝেড়ে আমি এবার একটু-একটু করে ওদের খাটিয়ার দিকে এগিয়ে এলাম। পুষ্পদি তার ছেলেকে বলল, ‘দেক তোর এক দাদা এয়েচে। ছেলেটি উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। আমি তার হাত ধরে বসিয়ে পাশে বসলাম। বললাম, ‘তুমি তোমার এই মাকে ভালোবাসো?’
শিশুর মতো সে পুষ্পদিকে একবার জড়িয়ে ধরল। সেভাবে আমি কখনও তাকে জড়িয়েছি বলে মনে পড়ছে না।
বাড়ির পথ ধরে যখন ফিরছি, আকাশের চাঁদটা তখন মেঘের ফাঁক গলে প্রায় গোলাকার। সেই আলোয় পাশের পরিত্যক্ত জমিতে গজিয়ে ওঠা কাশফুলগুলো সাদা ধবধব করছে। একটা ফুরফুরে হাওয়া আমার গা ছুঁয়ে ওদের মাথায় দোলা দিয়ে গেল। আর ক’দিন বাদেই ঢাকের তালে মায়ের আগমন।
অলংকরণ : সোমনাথ পাল