পারিবারিক ঝামেলার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি। প্রেম-প্রণয়ে শুভ। অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষে মানসিক চাপ বৃদ্ধি। প্রতিকার: আজ দই খেয়ে ... বিশদ
সুতরাং, অন্তর্বর্তী বাজেট পেশের ঘটনাটাকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী—একজন খেলোয়াড় প্রথমবার ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার মতো করে—বাজেট পেশের ঘটনাটাকে একটা প্রদর্শনীর রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। আইডিয়াটা ছিল সরকারের বিদায় সঙ্গীতে একটু ‘জোশ’ জোগান দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী এবং ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী যেমনটা ভেবে রেখেছিলেন, ফলটা দুর্ভাগ্যক্রমে, ভীষণই অন্যরকম হয়ে থাকতে পারে।
নির্লজ্জতা
প্রতিশ্রুতিগুলো খোলসা হতে আরম্ভ করেছে।
পিএম-কিষাণ স্কিমের ‘বিরাট’ প্রতিশ্রুতির দিকে তাকানো যাক। এই স্কিমে ২ একর বা তার কম জমির মালিক কৃষকদের বছরে তিন কিস্তিতে মোট ৬০০০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। স্কিমটার কার্যকারিতা পিছিয়ে ২০১৮-র ডিসেম্বরে নিয়ে গিয়ে সরকার নির্বাচন কমিশনকে বোকা বানাবার চেষ্টা করেছে! সেটা সম্ভব কীভাবে? প্রথম কিস্তিতে প্রদেয় ২০০০ টাকা সরকার কি কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে (২০১৮-র ডিসেম্বরে জমা হচ্ছে ধরে নিয়ে) জমা করে দেবে এবং ওই সময় থেকে হিসেব করে সুদও দিতে নির্দেশ দেবে ব্যাঙ্কগুলোকে? নির্বাচনী আচরণবিধি লাগু হওয়ার আগেই যদি প্রথম কিস্তির টাকা দেওয়া হয়ে গিয়ে থাকে তো নির্বাচন কমিশন তাদের অসহায়তার দোহাই দিতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয় কিস্তির টাকা দেওয়া যদি নির্বাচন কমিশন ঠেকাতে না-পারে তবে মানুষ ধরেই নেবে যে আরও একটা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার বিশ্বস্ততা ধ্বংস করে দেওয়া হল বা সেটাকে পরপারে পাঠাবার বন্দোবস্ত হল।
ঘুষ
এবার দেখা যাক পিএম-কিষাণ স্কিমের ভালোমন্দটা: প্রত্যেক প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক—যাঁরা ২ একর কিংবা তার চেয়ে কম জমির মালিক—তাঁরা এই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন। তার মানে হল, সারা দেশের মোট কৃষিজমির ৮৬.২ শতাংশ এই সুবিধার আওতায় আসবে। যখন কেউ সুবিধা পায় সেটা গুরুত্বপূর্ণ, আবার কেউ সুবিধা ‘না-পাওয়ার দলে’ পড়ে গেলে সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ:
১. জমির মালিক—তিনি নিজের হাতে চাষ করতে পারেন অথবা অন্যদের দিয়ে চাষ করান—দু’পক্ষই এই আর্থিক সুবিধা গ্রহণের যোগ্য বিবেচিত হবেন এবং টাকাটা পাবেন।
২. ভাগচাষি এই সুবিধা পাবেন না।
৩. কৃষি শ্রমিকরা এই সুবিধা পাবেন না।
৪. অকৃষি ক্ষেত্রের গ্রামীণ শ্রমজীবীরা—যেমন ছোট মুদি দোকানির মতো মানুষজন, হকার, ছুতোর, স্বর্ণশিল্পী, নাপিত প্রভৃতি এই স্কিমের বাইরে রয়ে যাচ্ছেন।
৫. আর শহুরে গরিবদের পুরোটাকেই এই স্কিমের বাইরে রাখা হয়েছে।
জমির মালিক-কৃষকরা (যাঁরা নিজের হাতে চাষ করেন না তাঁরাও) দৈনিক ১৭ টাকার একটা ‘বড়সড়’ অঙ্ক পাবেন। স্কিমটা নিয়ে আমি আদৌ মশকরা করছি না। ডিজেল, বিদ্যুৎ, সার, বীজ প্রভৃতির দাম বাড়িয়ে, ট্রাক্টর, ফসল কাটার যন্ত্র, শস্য মাড়াই করার যন্ত্রের উপর জিএসটি চাপিয়ে এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না-দিয়ে সরকার কৃষকদের প্রথমেই জখম করে রেখেছে—এখন তার উপর কৃষকদের অপমানও করছে।
পরিবারপিছু দৈনিক ১৭ টাকায় কি তাদের দুর্দশা ঘুচে যাবে অথবা কৃষক-পরিবারের দারিদ্রমুক্তি ঘটবে? নিশ্চিতভাবেই নয়। মাসে ৫০০ টাকার (বছরে ৬০০০ টাকা) এই অনুদানটা অনেক রাজ্যের বার্ধক্যভাতা, প্রতিবন্ধীভাতা বা বিধবাভাতার থেকেও কম। দৈনিক ১৭ টাকা বা প্রথম কিস্তির ২০০০ টাকাটা মোটেই দারিদ্র-দূরীকরণের উপায় নয়। এটা তাহলে কী? সোজা কথায়, এটা হচ্ছে ভোটের জন্য নগদ ইনাম। ভোটে জেতার আশায় নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকার এই টাকাটা ভোটারদের দেবে—যেভাবে কিছু দল অসদুপায়ে জোগাড় করা টাকার পুরোদস্তুর আর্ট দেখিয়ে থাকে। পিএম-কিষাণ স্কিমে, এই প্রথম সরকারি অর্থ ভোটারদের ঘুষ দিতে ব্যবহার করা হবে।
জমির মালিকানা সংক্রান্ত রেকর্ডপত্তর কি রাজ্য সরকারগুলো ‘আপডেট’ এবং ‘ভেরিফাই’ করেছে? একদিকে, জমির মালিকানা সংক্রান্ত রেকর্ড ‘আপডেট’ করে দেওয়ার জন্য সরকার গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাজ্যগুলোকে লিখেছে। অন্যদিকে, ওই একই দিনে, সংশ্লিষ্ট সচিব ঘোষণা করে দিয়েছেন যে প্রথম কিস্তির টাকা এখনই দেওয়া হবে এবং দ্বিতীয় কিস্তির টাকাটাও ভোটের আগে দিয়ে দিতে পারে সরকার। ধরে নেওয়া যায় যে সচিব হলেন সরকারের গোপনীয়তার রক্ষাকর্তা।
বাগাড়ম্বর
অন্য বড় প্রতিশ্রুতি হল পেনশন প্রকল্প—বাস্তবিক ‘অন্য-একটা’ পেনশন প্ল্যান—অটল পেনশন যোজনা নামক প্রথমটা ‘ফ্লপ’ হওয়ার কারণেই। পুরনো কনট্রিবিউটরি প্ল্যান ২০১৫-র মে মাসে চালু করা হয়েছিল এবং ২০১৮-র ডিসেম্বর অবধি ওতে গ্রাহক নথিভুক্ত করা গিয়েছে মাত্র ১ কোটি ৩৩ লক্ষ। ওই প্ল্যানে জমানো টাকার বিনিময়ে বাস্তবে যতটুকু পাওয়া যাবে সেই জটিল হিসেবটা খুব কম গ্রাহকের মাথাতেই ঢুকবে। নতুন প্ল্যানটার হিসেবপত্তর তুলনামূলকভাবে সহজ হলেও জমানো টাকার বিনিময়ে শেষাবধি যা পাওয়া যাবে বলা হচ্ছে তাতে গ্রাহকের আর্থিক লাভ কোথায়? ধরে নেওয়া যায় যে একজন গ্রাহক নিরবচ্ছিন্নভাবে ৩১-৪২ বছর মাসে মাসে ৫৫-১০০ টাকা জমা দেবেন। তার বিনিময়ে ৬০ বছর বয়স থেকে মাসিক ৩০০০ টাকা পেনশন পেলেও সেই কালে তার অর্থনৈতিক গুরুত্ব কী থাকবে? এই প্ল্যানে গ্রাহক হওয়ার সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫০ বছর, অতএব ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রীর বাজেট ভাষণ থেকে অনুমেয় যে, প্রথম ১০ বছর সরকারকে কোনও পাওনা মেটাতে হবে না। আগের প্ল্যানের অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়, প্রস্তাব অনুসারে ১০ কোটি শ্রমজীবী মানুষের নাম এই প্ল্যানে নথিভুক্ত হওয়ার কোনও আশা নেই; ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী এই কর্মসূচির জন্য মাত্রই ৫০০ কোটি টাকার সংস্থান রেখেছেন! (ও হ্যাঁ, বাজেট ভাষণের ৩৭ নং অনুচ্ছেদ ছাড়া বাজেট ডকুমেন্টের আর কোথায় অ্যালোকেশন বা বরাদ্দের উল্লেখ আছে?)
বাগাড়ম্বর করার অন্য ব্যাপারগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্মল জেলা ও গ্রামগুলো, প্রত্যেক বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়া, গরিব পরিবারগুলোকে রান্নার গ্যাসের নিখরচার সংযোগ এবং ‘মুদ্রা’ স্কিমের ঋণগ্রহীতারাই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিকারী—তৎসত্ত্বেও বাস্তবটা হল—এই সমস্ত দাবির প্রত্যেকটার অসত্যতা প্রকট হয়ে পড়েছে—জ্ঞানীগুণিমহল, এনজিও এবং সাংবাদিকদের ফিল্ড রিপোর্টে।
সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী বাজেট এটাই খোলসা করে দিল যে বিজেপির লোকসভা নির্বাচনের কৌশলটা হল ‘বাগাড়ম্বর এবং ভোটারদের ঘুষের প্রলোভন’।