পারিবারিক ঝামেলার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি। প্রেম-প্রণয়ে শুভ। অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষে মানসিক চাপ বৃদ্ধি। প্রতিকার: আজ দই খেয়ে ... বিশদ
দস্তুরমতো চমক তো বটেই। তবে সেটা কি নেহাতই চমক হয়েই থাকবে, নাকি হয়ে উঠবে নির্বাচনী ‘ম্যাজিক’? কতটা প্রভাব এই ঘটনাটার সামনের লোকসভা নির্বাচনে? বহু বছর ধরেই প্রিয়াঙ্কা গান্ধী নাকি কংগ্রেসের লুকনো তুরুপের তাস। যাকে বলে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। নির্বাচনের ময়দানে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী নামের অস্ত্রটার নাকি অমিত সম্ভাবনা—এমন কথাই শুনে এসেছি আমরা বহু বছর ধরে। তবু কংগ্রেস তাকে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল। তার কারণ অনুসন্ধান করা আমাদের কাজ নয়। হয়তো প্রিয়াঙ্কা নিজেও ততটা উৎসাহী ছিলেন না পুরোদস্তুর রাজনীতিক হতে। তবে অপ্রকাশিতকে ঘিরে জমে ওঠে রহস্য, আর সেই রহস্য গড়ে তোলে মায়ার প্রলেপ—এ তো জানা কথা। প্রকাশ পেলে আর কিছু না হলেও সেই রহস্যটা হারিয়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু লুকিয়ে রাখলে সে অস্ত্রটার ‘শেলফ লাইফ’ কতটা সময়ব্যাপী বজায় থাকে, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। বছরের পর বছর ধরে পড়ে থেকে থেকে সে অস্ত্রের ধার কি আজও অক্ষুণ্ণ? নাকি জং ধরে ধার কমে গিয়েছে তার অজানা সম্ভাবনায়?
সক্রিয় রাজনীতিতে না থাকলেও, দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতির আঙিনায় প্রিয়াঙ্কাকে দেখা গিয়েছে মাঝে মধ্যেই। ভোটের আগে আমেথি বা রায়বেরিলিতে। ২০১৭-র উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের জোটের পিছনেও নাকি প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর হাত ছিল। (অবশ্য সে নির্বাচনে এই জোটের ভরাডুবিটা এ নিবন্ধে আলোচনার বিষয়বস্তু নয়।)
যাই হোক, প্রিয়াঙ্কাকে দেখলে আজও অনেকেরই মনে পড়ে তাঁর ঠাকুমা ইন্দিরা গান্ধীর কথা। একটা প্রজন্মের কাছে ডাকসাইটে রাজনীতিক ইন্দিরার বলিষ্ঠ ভাবমূর্তি আজও অম্লান। প্রিয়াঙ্কাই ইন্দিরার রাজনৈতিক উত্তরসূরি কি না সে নিয়ে বিস্তর জল্পনা হয়েছে ভারতের মিডিয়াতে। দীর্ঘদিন ধরেই। তাই ইন্দিরার ইমেজের উত্তরাধিকার আর তার ফলশ্রুতিতে প্রাপ্য জনসমর্থন ঝরনার স্রোতের মতো প্রিয়াঙ্কার উপরে বর্তাবে, এমনটাই ভাবেন অনেকে। ভেবে এসেছেন। যদিও আমি ঠিক নিশ্চিত নই এ বিষয়ে। ইন্দিরা গান্ধী মারা গিয়েছেন ১৯৮৪ সালে। প্রায় ৩৫ বছর পার হয়ে আজকের ভারতবর্ষের একটা বেশ বড় অংশের ভোটারের কাছেই ইন্দিরা গান্ধী বইয়ের পাতায় পড়া এক ঐতিহাসিক চরিত্র মাত্র। তাই সাধারণভাবে ইন্দিরার প্রতি সমর্থনের আলাদা কোনও কারণ থাকার কথা নয় এই জনগোষ্ঠীর। তেমনি ভাবেই রাজীব গান্ধীর অন্ত্যেষ্টি হয়েছিল ২৮ বছর আগে, ১৯৯১তে। সে সময়ে প্রিয়াঙ্কাকে দূরদর্শনে যারা দেখেছিল, আজ তারা অন্তত চল্লিশের ওপিঠে। তাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই কতটা প্রিয়াঙ্কা জোয়ারে ভাসতে পারে জনগণ, সেই ঘটনার সূত্র ধরে। সময় যে এগিয়েছে অনেকটাই। স্মৃতি তাই ফিকে হতে বাধ্য। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, এবারের নির্বাচনে প্রথম বারের জন্যে ভোট দেবে এমনকী এই শতকে জন্ম নেওয়া নাগরিকরাও। বিপুল সংখ্যক ভোটারের কাছে ইন্দিরার নাতনি প্রিয়াঙ্কা কিংবা রাজীবের অন্ত্যেষ্টির দিনের প্রিয়াঙ্কার বিশেষ কোনও আবেদন থাকার কথা নয়, একথা মেনে নেওয়াটাই ভালো। ওই যে, সমস্ত কিছুরই একটা শেলফ লাইফ থাকে। শেলফে পড়ে থাকতে থাকতে ম্যাজিকের মায়াজাল দুর্বল হয়ে যায় বইকি। তাই আমার মনে একটা সন্দেহ জাগে, কংগ্রেস কি ‘প্রিয়াঙ্কা তাস’ খেলতে দেরি করে ফেলল খানিকটা?
প্রিয়াঙ্কা রাজনীতিতে আসায় কংগ্রেসের প্রতি পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ প্রবলতর করবে বিজেপির মতো প্রতিপক্ষরা। তবে তাতে নির্বাচনে কতটা প্রভাব পড়বে, তা কিন্তু বলা কঠিন। যারা কংগ্রেসকে ভোট দেয়, তারা কংগ্রেসের তথাকথিত পরিবারতন্ত্রের বিষয়টা জেনেই দেয়। প্রিয়াঙ্কা ইস্যুটা তাতে নতুন কোন ইন্ধন জোগাবে বলে মনে হয় না।
প্রিয়াঙ্কাকে উত্তরপ্রদেশের মত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের পূর্বভাগের দায়িত্ব দিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। রাজনৈতিকভাবে সেটাও বেশ আকর্ষণীয় বিষয়। এমনিতে অখিলেশ আর তাঁর বুয়াজি একপেশেভাবে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে এসপি-বিএসপি-র জোট ঘোষণা করে দিয়েছে উত্তরপ্রদেশে। কংগ্রেসের জন্যে ছাড়া আছে দু-তিনটে মাত্র আসন—রায়বেরিলি, আমেথির মতো। আপাতদৃষ্টিতে বিজেপি-বিরোধী দলগুলির পক্ষে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইতে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দাঁড় করানোটাই সেরা বাজি হওয়া উচিত। তবু কংগ্রেস কিন্তু ঘোষণা করে দিল যে, তারা সে রাজ্যের ৮০টা আসনেই প্রার্থী দেবে। সেটা হয়তো দলটার বাঁচবার তাগিদে। (সঙ্গে অন্য অঙ্কও থাকতে পারে।) তবে সেই সঙ্গে প্রিয়াঙ্কার মতো ব্রহ্মাস্ত্রকে মাঠে নামিয়ে দিয়ে কংগ্রেস কি আপাতভাবে বিজেপি-বিরোধী ভোটকেই ভাগ করতে সাহায্য করল না? এমনিতে রাজ্যটিতে কংগ্রেসের ভোট কমতে কমতে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। মোটামুটি ৬-৭ শতাংশ। তার মধ্যে কংগ্রেসের গড় বলে পরিচিত রায়বেরিলি কিংবা আমেথির ভোট বাদ দিলে বাকি রাজ্যে দলটির ভোট আরও খানিক কম হতে বাধ্য। তবু এই ভোট অধিকাংশ আসনের জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক নয় কি? বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে।
তবে উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যের ভোটের অঙ্কটা বোধকরি আরও জটিল। রাজনৈতিক দলগুলি সবাই সেটা জানে। রাহুল গান্ধীও জানেন। আসলে জাতপাতে দীর্ণ উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে অখিলেশের সমাজবাদী পার্টি আর মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির ভোট মূলত যথাক্রমে যাদব এবং দলিতদের মধ্যেই বেশি। বিজেপির মূল ভোটশক্তি ব্রাহ্মণদের মধ্যে বড় একটা থাবা বসাতে পারবে না বুয়া-ভাতিজার যুগলবন্দি। সেই ব্রাহ্মণ ভোটেই ভাগ বসানোর একটা প্রচেষ্টা করে চলেছে কংগ্রেস। রাহুল গান্ধীকে দত্তাত্রেয় গোত্রের কাশ্মিরী ব্রাহ্মণ হিসেবে ঘোষণা করার মধ্যেও হয়তো তারই প্রকাশ। জটিল পাটিগণিতের অঙ্কে এরাজ্যে জবরদস্ত ত্রিমুখী লড়াই হলে বিজেপির বিপদ তাই বাড়তে পারে। আর সেটা আরও জোরদার করতে পারবেন প্রিয়াঙ্কা—এটাই বোধকরি আশা করেছে কংগ্রেস। এটা সত্যি সত্যিই হবে, নাকি কংগ্রেসের অলীক আশা মাত্র হয়ে থাকবে, আর হাড্ডাহাড্ডি ত্রিমুখী লড়াইতে ফায়দা লুটবে বিজেপি—এটা তো সময়ই বলবে।
প্রিয়াঙ্কাকে সক্রিয় রাজনীতিতে আনার পিছনে আরও কিছু অঙ্ক থাকা সম্ভব। এমনিতে সোনিয়া গান্ধী শারীরিকভাবে খুব সুস্থ নন। কংগ্রেসের সভাপতিত্ব পুত্র রাহুলের হাতে ছেড়েছেন তিনি, বছর খানেক আগেই। এমনটাও হতে পারে যে, সোনিয়া আর নির্বাচনেও দাঁড়াতে চাইবেন না। সেক্ষেত্রে রাইবেরিলির রাজ্যপাট তাঁকে ছাড়তে হবে কোন ভরসাযোগ্য হাতে। কন্যা প্রিয়াঙ্কাই কি এক্ষেত্রে তাঁর সেই ভরসার পাত্রী?
আবার, চারিদিকে জোর জল্পনা যে, প্রিয়াঙ্কা নাকি প্রার্থী হতে পারেন বারাণসীতে, নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে। এটা হয়তো এবারের নির্বাচনে কংগ্রেসের এক মাস্টার-স্ট্রোকের প্রচেষ্টা। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের ফল যাই হোক না কেন, নরেন্দ্র মোদি বোধকরি বারাণসীকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে বাধ্য হবেন। বিজেপির নির্বাচনী স্ট্রাটেজিই, প্রচার কৌশলও বেশ খানিকটা বদলে যেতে পারে এর ফলে। কিন্তু কতটা? তা কি নির্বাচনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলার মতো? সেটাও বলবে সময়। আপাতত পুরোটাই জল্পনার পর্যায়ে। এবং প্রিয়াঙ্কা পর্বের শুরুতে এই মুহূর্তে এটুকুকেই প্রধান ফল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এটুকু হলেও ২০১৯-এর নির্বাচনটা অবশ্য একটা অতিরিক্ত মাত্রা পেয়ে যেতে পারে।
সব মিলিয়ে প্রিয়াঙ্কার নির্বাচনী প্রভাব কতটা হবে তা এই মুহূর্তে বলা অসম্ভব। লোকসভা নির্বাচনে প্রিয়াঙ্কার সার্বিক প্রভাব বুঝতে নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের অপেক্ষা করতে হবে আরও অনেকটা সময়। করতে হবে বিশ্লেষণ। যথা সময়ে সে পর্যালোচনা নিশ্চয়ই হবে, তা লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন। তবে এটাও ঠিক যে, চমকটা কেবল একবারের জন্য। প্রিয়াঙ্কা নামক বজ্রটা অবশেষে নেমে এল মাটির পৃথিবীতে। তার ফলশ্রুতিতে কংগ্রেস কতটা সমৃদ্ধ হল, চমকটা কতটা পরিণত হল ম্যাজিকে, সেটা বলবে নির্বাচকরা, নির্দিষ্ট সময়ে। কিন্তু কংগ্রেস যে বেশ খানিকটা রিক্ত হল, তা বলে দেওয়া যায় এই মুহূর্তেই। কংগ্রেসের শেলফে আর কোন ব্রহ্মাস্ত্র রইল না, সেটা নিশ্চিত।