পারিবারিক ঝামেলার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি। প্রেম-প্রণয়ে শুভ। অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষে মানসিক চাপ বৃদ্ধি। প্রতিকার: আজ দই খেয়ে ... বিশদ
অবশ্য তার সঙ্গত কারণও আছে। দেশের মোদি-বিরোধী শিবিরে এবার যে মধ্যমণি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁকে কেন্দ্র করেই জোট বাঁধছে দেশের মোদি-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো। আর তাতে ভোট রাজনীতির জাতীয় মঞ্চে বাংলার ভূমিকাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মমতা যে জাতীয় বিরোধী মঞ্চের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে উঠেছেন এবং বিরোধীরা যে তাঁকেই সামনে রেখে মোদি-বিরোধী লড়াইতে যেতে চাইছেন সাম্প্রতিকে অন্তত দুটি ঘটনায় তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রথমটি তৃণমূলের ব্রিগেড সমাবেশ এবং দ্বিতীয়টি মমতার ধর্না। দেশের প্রভাবশালী প্রথমসারির মোদি-বিরোধী নেতারা মমতার ব্রিগেডে উপস্থিত হয়ে বা ফোন করে কীভাবে তাঁর প্রতি আস্থা ও সংহতি জানিয়েছেন তা দেশ দেখেছে। জাতীয় কংগ্রেসও এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকেনি বরং প্রতিনিধি পাঠিয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী মমতার প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন ও আস্থা জ্ঞাপন করেছেন। পরবর্তীতে রাজ্যের অধিকার উপেক্ষা করে সিবিআইয়ের আচমকা অভিযানের বিরোধিতায় মমতা যখন ধর্মতলা মেট্রো চ্যানেলে ধর্নায় বসেছেন তখনও বিরোধী শিবিরের নেতানেত্রীরা কেউ ধর্নামঞ্চে এসে কেউ ফোনে মমতার প্রতিবাদকে স্বাগত জানিয়েছেন, পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন। এই দলেও কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ছিলেন। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, কংগ্রেস সমেত পদ্মবিরোধীরা প্রায় সকলেই আজ বাংলার মা-মাটি-মানুষের লড়াকু নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতার পাশে মমতার সঙ্গে এবং আসন্ন ২০১৯ ভোটযুদ্ধে তাঁকেই চাইছেন নেতৃত্বে। সত্যি বলতে কী, রাহুল গান্ধী থেকে অখিলেশ যাদব মায়াবতী চন্দ্রবাবু নাইডু কানিমোঝি প্রমুখ দেশের বিরোধী নেতানেত্রীর এহেন মমতা-প্রীতিই পশ্চিমবঙ্গের জনমনে প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা উসকে দিয়েছে। পরিস্থিতি আজ এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে ভোট-রাজনীতির জাতীয় মঞ্চে এখন রাহুল-মোদির চেয়ে মমতা-মোদির লড়াইটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ২০১৯ লোকসভা রণাঙ্গনে কংগ্রেস বিজেপির লড়াইয়ের চেয়ে মানুষজন মমতার নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদিজির গেরুয়াবাহিনীর টক্কর ও তার সম্ভাব্য ফলাফল নিয়েই বেশি কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন!
আর সেজন্যই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর পদ্মবাহিনীর প্রধান টার্গেট এখন মমতা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সভা-সমিতিতে মোদিজি ও তাঁর দলের নেতানেত্রীরা সব ছেড়ে মমতার নামে বিষোদ্গারে মাতছেন। যা মুখে আসে তাই বলছেন। নানা অভিযোগের বন্যা বহাচ্ছেন। তার সঙ্গে নতুন করে শুরু হয়েছে সারদা নারদা রোজভ্যালি নিয়ে নাড়াচাড়া, সিবিআই অভিযান! কদিন আগে কলকাতার পুলিস কমিশনার রাজীব কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অছিলায় তাঁর লাউডন স্ট্রিটের বাড়িতে আচমকা হানা দিয়েছিলেন সিবিআইয়ের কয়েকজন অফিসার। তাঁদের সঙ্গে প্রথমে পুলিস কমিশনারের বাড়িতে কর্তব্যরত পুলিসের এবং পরে উচ্চপদস্থ পুলিসকর্তাদের বাদবিতণ্ডায় রীতিমতো উত্তেজনার সৃষ্টি হল। কিন্তু, আখেরে হলটা কী? মহামান্য আদালত সাফ জানিয়ে দিলেন, রাজীব কুমারকে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে কিন্তু তাঁর ওপর বলপ্রয়োগ বা তাঁকে আটক করতে পারবে না। সেইমতো শিলংয়ে ডেকে রাজীব কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছে। এই জিজ্ঞাসাবাদ রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে সোজা পথেও করা যেত। না করে লাভটা কী হল? মহামান্য আদালতের নির্দেশে জিজ্ঞাসাবাদের বেশি কিছু করার সামর্থ্যই তো রইল না! বরং, মাঝখান থেকে সিবিআইয়ের এহেন কাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে এবং সেই প্রতিবাদে কংগ্রেসসমেত দেশের নানা প্রান্তের বিরোধী নেতানেত্রীর সমর্থন পেয়ে মমতা জাতীয় স্তরে তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি আরও বাড়িয়ে নিলেন! বলছেন দেশ-রাজ্যের মানুষ, বলছেন রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞরাও।
আচ্ছা, যাঁরা এত বছর মমতাকে দেখছেন, তাঁর রাজনৈতিক স্বভাব, মানুষের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর অনমনীয় মনোভাব এবং সর্বোপরি তাঁর সততা ও আত্মবিশ্বাসের ভূরি ভূরি উদাহরণ দেখেছেন ও দেখছেন তাঁরা কি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন এভাবে ফাঁকা অভিযোগ করে বা ভয় দেখিয়ে মমতার গতিরোধ করা যাবে? ভাবতে যে পারেন না সেটা এই বাংলার পথেঘাটে অফিস-কাছারিতে একটু ঘোরাঘুরি করলে প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর মন্ত্রী সেনাপতিরা অনায়াসে বুঝে যেতেন। ওই যে মমতা বলেছেন না, পাঙ্গা নিলে আমি চাঙ্গা হয়ে যাই—একেবারে ঠিক কথা। এই মনের জোর এই অকুতোভয় একরোখা প্রতিবাদী স্পিরিট না থাকলে কি সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামেদের ৩৪ বছরের দুর্গ তিনি ধূলিসাৎ করতে পারতেন? প্রায় একক চেষ্টায় সিপিএমের দীর্ঘ শাসনে রুগ্ন বিবর্ণ শিল্পসম্ভাবনাহীন হতাশার রাজ্যে এত তাড়াতাড়ি এমন প্রাণ সঞ্চার করতে পারতেন? পারতেন দেশ-বিদেশ থেকে লক্ষকোটির বিনিয়োগ আনতে, লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে? পারতেন, জঙ্গলমহল থেকে পাহাড় সাগর থেকে সীমান্ত এমন শান্তি সম্প্রীতি আর উন্নয়নে উজ্জ্বল এমন একটা বিশ্ববাংলা উপহার দিতে? শুধু কী তাই, জগৎসভায় আজ পশ্চিমবঙ্গ যে ফের একবার নতুন আলোয় আলোকিত। কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প যে আজ বিশ্ববন্দিত—সেও কি মমতার মতো এমন একনিষ্ঠ জননেত্রী অক্লান্তকর্মী মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া সম্ভব ছিল?
বাংলার মানুষ কি সাধে আজও এমন মমতামুগ্ধ? যাচাই করে তাঁরা তো দেখেছেন, ২০১১ সালের আগে এই রাজ্যের হাল কী ছিল আর আজ কী? সাধারণ গরিবের জীবনমান লালজমানায় কী ছিল আর মমতা রাজে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। তবেই না তাঁরা সব ভুলে মমতাকে উজাড় করে দিয়েছেন তাঁদের সমর্থনের শক্তি। সেই অপরিমেয় জনশক্তি ও সমর্থন প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর পার্ষদদের দুটো অভিযোগে শেষ হয়ে ভেঙে পড়বে? সিবিআই এসে রামাসামা অভিযোগ ঠুকে দু’-চারজনকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করলেই বাংলার পাবলিক মমতার পাশ থেকে সরে যাবেন? হয়, হতে পারে! বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মতো এমন একটি রাজনীতি সচেতন রাজ্যে তেমনটা হওয়া কি আদৌ সম্ভব! আমার এক বন্ধুর সামনে এমন একটা প্রশ্ন রেখেছিলাম। তিনি একটি অতি পরিচিত রসিকতা ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন, কইবেন না, কইবেন না দিদি, শুনলি ঘুড়ায় (ঘোড়া) হাসব!
আমার বন্ধুর মন্তব্যটি হয়তো নিছক রসিকতা। কিন্তু, আমাদের দেশে ভোট এলে এমন রসের কাণ্ডকীর্তি যে চিরকালই ঘটে তা কি কেউ অস্বীকার করতে পারেন? এই যেমন ধরুন কেউ যদি প্রশ্ন করেন, সারদা রোজভ্যালিতে সর্বস্বান্ত মানুষজনের দুঃখে যে প্রধানমন্ত্রীর আজ বুক ফেটে যাচ্ছে নোট বন্দি, জমা টাকায় সুদ কমানো, কৃষি সরঞ্জামের মতো গরিব সাধারণের নিত্যদিনের রুটিরুজির অবলম্বনে ভর্তুকি বন্ধ করা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সেই দরদ কোথায় ছিল—কী জবাব দেবেন মোদিজি? জানি, বলবেন, দেশের আর্থিক সংস্কারের স্বার্থে কিছু কষ্ট সকলকেই করতে হয়। কিন্তু, কেউ যদি জানতে চান, সে না হয় হল, সারদা রোজভ্যালি কাণ্ড নিয়ে এমন মাঝে মাঝে জেগে ওঠা ও ঘুমিয়ে পড়া কেন? আর লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে ভোটের সময়ই যেন বেশি বেশি করে তেড়েফুঁড়ে উঠছে সিবিআই—কেন? কংগ্রেসের প্রিয়াঙ্কা যতদিন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসেননি ততদিন তাঁর স্বামী রবার্ট ওয়াধেরাকে নিয়ে কথা নেই। প্রিয়াঙ্কা রাজনীতির ময়দানে নামতেই ওয়াধেরার পিছনে সিবিআই, ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদ! মানেটা কী? উত্তর মিলবে?
বঙ্গ রাজনীতির তথ্যভিজ্ঞজনেদের অনেকেই মনে করছেন, ২০১৯ ভোট মহাযুদ্ধের আগে বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবার কেবল মুখের বাণী নয় সিবিআইয়ের মতো শক্তিরও যথেচ্ছ প্রয়োগ হবে। কারও জেলযাত্রার ঘটনা ঘটলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু দিনের শেষে প্রশ্ন একটাই, ফাঁকা অভিযোগ করে বা সিবিআই জুজু দেখিয়ে কি মমতার মতো মহানেত্রীর গতিরোধ করা যায়? দেয়ালের লিখনটা কিন্তু ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। গেরুয়া বন্ধুরা একটু চোখ মেলে দেখুন।