পারিবারিক ঝামেলার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি। প্রেম-প্রণয়ে শুভ। অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষে মানসিক চাপ বৃদ্ধি। প্রতিকার: আজ দই খেয়ে ... বিশদ
সেবার লোকসভা ভোটে আর মাত্র সপ্তাখানেক বাকি। গোটা দেশের সঙ্গে বিহারেও রাজনীতির ময়দান সরগরম। হাজিপুর লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম রামবিলাস পাসোয়ান। ততদিনে বেশ কয়েকটি ভোটেই হাজিপুর রামবিলাসের গড় বলে পরিচিতি পেয়েছে। উপস্থিত জনতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল ভোট নিয়েই। একসময় রামবিলাসের কথা তুললাম। নামটা শুনেই ফোঁস করে উঠলেন এক প্রবীণ। মাথা নেড়ে বললেন, ‘ওর কথা আর বলবেন না। মানুষ ক্ষমতা পেয়ে যে এত বদলে যেতে পারে রামবিলাসকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।’ আশপাশের অনেককেই মাথা নেড়ে সায় দিতে দেখলাম। উনি ঠিকই বলেছেন। ও ভীষণ বদলে গেছে। এমনসব কাণ্ড করেছে যা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। উও আভি রামবিলাস নেহি হ্যায়। উও বন গয়া ভোগবিলাস।
কী রকম?
আমার প্রশ্নে জবাব এল, দেশে এমন সতী সাধ্বী স্ত্রী থাকতে দিল্লিতে গিয়ে পাঞ্জাবি না কোন জাতের এক মহিলাকে বিয়ে করেছে শুনেছি। এরকম কেউ করে! দেখলাম, আশপাশে ভিড় বাড়ছে। রামবিলাসের বিরুদ্ধে হরেকরকম আলগা মন্তব্যও ভেসে আসছে। আমার দিকে ফিরে অঞ্জন বাংলায় বলল, এখানকার মানুষের মুড দেখলে তো! বেচারা রামবিলাসের কপালে এবার দুঃখ আছে। চলো আর দু’একটা এলাকায় যাই।
সেই মুহূর্তে আমিও ওর সঙ্গে প্রায় একমতই। মনে হল, আরও কয়েকটি এলাকায় সম্ভবত একইরকম নমুনা দেখব। একই মুড মিলবে সাধারণ মানুষের। আসন্ন ভোটে নিজের গড়ে রামবিলাস সম্ভবত ঠোক্করই খেতে চলেছেন।
তবু হঠাৎ কী মনে হল, প্রশ্নটা সোজাসুজি করেই ফেললাম। বললাম, তাহলে এবার রামবিলাসজি তো গোহারা হারবেন?
কিঁউ?
মুহূর্তে ফুঁসে উঠলেন সেই বয়স্ক মানুষটি, যিনি এতক্ষণ রামবিলাসের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছিলেন। হারেগা কিঁউ? আমার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন—না, না। ও কখনও হারবে না। আমরা ওকে হারতে দেব না।
তাহলে যে এতক্ষণ এত কথা বললেন!
বলেছি, ঠিকই তো বলেছি। তবে মনে রাখবেন ঘরের ছেলে অন্যায় করলে, খারাপ কিছু করলে তাকে বকবো, দরকার হলে মারধর করবো। কিন্তু ঘর থেকে বের করে দেবো কি? আমরা সেরকম মানুষ নই। রামবিলাস আমাদের জাতের ছেলে। আমাদের গর্ব। ওর কোনও ক্ষতি হতে দেবো না। জনতার গুঞ্জন কানে এল, চাচাজি সঠিক কথাই বলেছেন।
ব্যাপারটা ভিন রাজ্যের দুই সাংবাদিকের কাছে যারপরনাই অপ্রত্যাশিত। ফলে পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করছি। সেই প্রবীণ বললেন, আপলোগ লিখ লিজিয়ে—ইয়ে হাজিপুরসে রামবিলাস পাসোয়ান নে ফির জরুর জিতেগা।
মনে পড়ছে, একবার বিহারের এক প্রবীণ সিপিআই নেতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। পাটনা লাগোয়া একটি এলাকায়। ভদ্রলোক বললেন, সবচেয়ে আক্ষেপের বিষয় কী জানেন, আমরা গত পঞ্চাশ ষাট বছর ধরে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার লড়াই চালিয়েও এখনও প্রতিবার ভোটে রাজ্য বিধানসভায় সদস্যসংখ্যা দুই অঙ্কে পৌঁছতে হিমশিম খাই। আর, দেখুন না লালু যাদব কেমন মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে দিব্যি ক’বছরেই রাজ্যটা দখল করে নিল! প্রসঙ্গত সেই সময় লালুপ্রসাদ যাদবের প্রধান স্লোগান ছিল—ভূরাবাল সাফ করো। ‘ভূরাবাল’ শব্দের আপাত অর্থ পাকাচুল হলেও রাজনীতির ময়দানে তার অন্তর্নিহিত বক্তব্য ছিল বিহারের দাপুটে চার উচ্চবর্ণ অর্থাৎ ভূমিহার, রাজপুত, ব্রাক্ষ্মণ ও লালা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অঘোষিত লড়াই। চার উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে অন্যদের একজোট করে লালুপ্রসাদ বিহারের রাজনীতিতে বাজিমাত করেছিলেন। সঙ্গে নিয়েছিলেন মুসলিমদের। নানা ইস্যুতে বার বার ঘটানো সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার শিকার হওয়া মুসলিমরাও লালুপ্রসাদকেই তাঁদের মসিহা তথা রক্ষাকর্তা মেনে নেওয়ায় এম-ওয়াই ফ্যাক্টর অর্থাৎ মুসলিম-যাদব যৌথ অভিযান ওইসময় বিহার রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরে নীতীশকুমার কুর্মি ও কৈরি সম্প্রদায়কে লালুপ্রসাদের মুঠো থেকে বের করে এনে তাঁর প্রায় দেড় দশকের মৌরসিপাট্টা অনেকটাই খর্ব করে দেন। নীতীশের সাফল্যের পিছনেও সেই জাতপাতের রাজনীতিই প্রধান ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়।
একেবারে পাশের রাজ্য বলে বিহারের প্রত্যক্ষ উদাহরণগুলি তুলে ধরলাম। কিন্তু বাস্তবে প্রায় গোটা দেশটাই জাতপাতের রাজনীতির বিচারে বিহারের বৃহত্তর সংস্করণ বললে খুব ভুল বলা হবে না। হিন্দি তথা গো বলয়ে বিষয়টি যত নগ্নভাবে চোখে পড়ে, দেশের অন্যান্য অধিকাংশ এলাকায় ততটা না দেখা গেলেও প্রকৃত পরিস্থিতির খুব একটা হেরফের নেই। রাজনীতির বাবুরা মুখে যতই উদারতা, মহানুভবতার বড়াই করুন না কেন দিনের শেষের মতো ভোটের বেলায় এসে প্রায়ই সবাই একই নিক্তিতে নিজেদের পাওনাগণ্ডা বুঝে নেওয়ার হিসেব কষেন। ভোটারের সংখ্যার বিচারে প্রার্থী বাছাই হয়। জাঠ অধ্যুষিত এলাকায় সব দলেরই প্রথম পছন্দ জাঠ সম্প্রদায়ের কোনও প্রার্থী। একইভাবে কোথাও গুর্জর, কোথাও প্যাটেল, কোথাও লিঙ্গায়েত, কোথাও হরিজন, কোথাও যাদব এরকম হরেকরকম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের ভোটে নামিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করতে তৎপর হয় রাজনৈতিক দলগুলি। এই পথেই ক্ষমতায় এসেছেন চরণ সিং, দেবীলাল থেকে শুরু করে মূলায়ম সিং যাদব, কুমারী মায়াবতীর মতো নেতানেত্রীরা। মণ্ডল কমিশনের নামে জাতপাতের রাজনীতিই বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংয়ের সাফল্যের সপ্তডিঙার পালে হাওয়া লাগিয়ে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল।
এমনকী বামপন্থীরাও পুরোপুরি এই ভাবনার বাইরে নন। তাঁরাও বেশিরভাগ সময়ই এলাকার জনবিন্যাসের চরিত্র বিচার করে প্রার্থী বাছাই করেন। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় কোনও মুসলিমকে প্রার্থী মনোনয়নের আগে চল্লিশবার ভাবেন। শুধু ভোটের প্রার্থীইবা কেন, সংগঠনের নেতা তৈরির ক্ষেত্রেও তাঁদের নীতি একইরকম। অন্তত বাস্তবচিত্রটা সেরকমই বলে। দেশে বাম রাজনীতির জ্যাঠামশাই সিপিএমের পলিটব্যুরো থেকে শুরু করে জেলা সম্পাদকমণ্ডলী পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে আতসকাচ ফেললে এই দৃশ্যই ধরা পড়বে।
তবে, একটা ব্যাপারে বিজেপি ব্যতিক্রম। অন্তত উত্তরপ্রদেশের ক্ষেত্রে তারা করে দেখিয়েছে। বিভাজনের রাজনীতির ভিত্তিকে আরও সংহত করতে ওই রাজ্যে গত বিধানসভা ভোটে প্রার্থীতালিকায় মুসলিম নামের কোনও গন্ধ রাখেনি। কারণ, ওই দলটির আসল চালকদের মাথায় ভারত নামের দেশটির অর্থ কয়েক হাজার বছরের লালিত ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ভারত’ নয়। তা হল হিন্দু ভারত। এবং খুব সম্ভবত তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের স্বার্থপূরণে সদা তৎপর থাকা একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ। বহু আলোচিত বৈদিক সমাজব্যবস্থার ভারত।
আর, একারণেই ভোটের মুখে শিক্ষা ও চাকরিতে উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণের নয়ানীতি প্রণয়ন। আশা, এর জেরে অন্তত গো-বলয়ের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা একজোট হয়ে পদ্মপতাকার তলায় এসে সমবেত হবেন। এবারও উচ্চবর্ণের ভোটের একমাত্র দাবিদার হয়ে উঠতে পারবে গেরুয়াশিবির।
আবার, ঠিক এই জায়গাটিতেই আঘাত হানতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস। একসময় উচ্চবর্ণের হিন্দু জনগোষ্ঠী কংগ্রেসের অন্যতম ভোটব্যাঙ্ক ছিল। পরে নানা কারণে তার অনেকটাই গেরুয়াশিবিরের দিকে সরে যায়। সেই সরে যাওয়া ভোটব্যাঙ্ককে ফিরিয়ে আনতে কংগ্রেস এবার লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশকেই প্রধান পরীক্ষাগার করতে চাইছে। সম্ভবত সেকারণেই হিসেব কষে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে সরাসরি রাজনীতিতে নামানো হচ্ছে। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে উত্তর প্রদেশের প্রায় অর্ধেক এলাকার।
আদর্শ নয়। জাতপাত, ধর্ম-বর্ণ-সাম্প্রদায়িক তাসই দেশের রাজনীতির প্রধান ধারক। স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর বাদেও রাজনীতি দাঁড়াতে পারল না রাজনৈতিক আদর্শ ও সততার পায়ে। তার প্রধান ভরসা এখনও সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাত থেকে শুরু করে বিদ্বেষমূলক প্ররোচনা, বিভ্রান্তিমূলক প্রচার প্রভৃতি নানা নামের ক্র্যাচ। জনতার দরবারে প্রত্যাখ্যান এড়াতে শঠতার তরবারিতে শান দেয় বহু রাজনৈতিক দল। এ আমাদের দুর্ভাগ্য। পোড়া দেশ এই খোঁড়া রাজনীতিকে আরও কতকাল কাঁধে করে বইতে বাধ্য হবে কে জানে!