পারিবারিক ঝামেলার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি। প্রেম-প্রণয়ে শুভ। অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষে মানসিক চাপ বৃদ্ধি। প্রতিকার: আজ দই খেয়ে ... বিশদ
ওদিকে ছবি একটা ময়রা কারখানায় কাজ করে। সকালে কাজে গিয়ে সন্ধের সময় বাড়ি ফেরে। তার অল্প মাইনে, বেশি খাটুনি। তবু সে পুষিয়ে নেয়। বউ আর দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে খুব ছোট। এখনও মুখেভাত হয়নি। বউ বলেছে নমনম করে হলেও করতে হবে। ছবি তাই চিন্তিত। কম করে হাজার দুয়েক টাকা তো চাই।
শেষমেশ হল। প্রথমে পাল খাটানো হল। তার পরদিন দোকান বাজার হল। তার পরদিন শাঁখ বাজল, মুখেভাত হল, দু-একজন লোক খেল। সব হল, বাদ গেল শুধু অস্কা। অস্কার ভারী দুঃখ হল। আর কেউ নয়, ছবি তাকে বাদ দিল! এ দুনিয়ায় আর কে রইল তার। কেউ নয়। এখন গোবিন্দই একমাত্র ভরসা। এ জগতে গোবিন্দই তার একমাত্র কাছের লোক। গোবিন্দ চা দেয়, নিজে গান শোনায়, বেঞ্চে জায়গা না থাকলে ভেতর থেকে টুল এনে বসতে দেয়। ঠান্ডা জল দেয়। বলে অস্কাদা আগে জল খেয়ে নাও, একটু জিরোও তারপর চা দিচ্ছি। আহা, কে এমন করে বলে! তার বউ ভেলকিও বলে না। গোবিন্দর ভালো হোক। একখানা মোটরগাড়ি কিনুক। মোটরগাড়ি চেপে সুখ হোক।
সেই অস্কার এখন ঘর-বার সব সমান। মনের কথা কাকে বলবে। ভেলকি সারাদিন রেগে টং হয়ে থাকে। বাড়ি ফিরতে দেখলে আড়চোখে তাকায়। তারপর বলে বাবু এলেন। অস্কা রাগ করে না। সে ভাবতে জানে। ভেবে দেখল ভেলকির দোষ নেই। এই যে বাবু এলেন, বাবুর পায়ে হাওয়াই চটি, বাবুর পরনে জেল্লাহীন জামা। বাবু চটকলের মজুর। বাবুর তাই মান নেই। বাবু যদি অফিসার হতো, বাবুর কোমরে বেল্ট থাকত, পায়ে বুট পরত, বাবুর মোটা মাইনে হতো তাহলে ভেলকির মুখ দিয়ে পুষ্প বৃষ্টি হতো, গলায় মধু জমত। সারা পৃথিবীটাই ব্রজেন ময়রার মাখন হয়ে যেত। কিন্তু হয়নি। পৃথিবীটা যেমন, তেমনই আছে। তার টং মেজাজি বউকে নিয়েই সংসার করতে হয়।
তা অস্কা একদিন বলল, জানো ছবি আমায় বাদ দিয়েছে।
ভেলকি বলল, বেশ করেছে।
—বেশ করেছে বলছ!
—হ্যাঁ, তো কী বলব। তোমার খরচ বেঁচে গেল।
ভারী দুঃখ হল অস্কার। এইসব দুঃখের কথা এখন কাকে বলবে।
মোটকথা ভেলকিও তাকে গুরুত্ব দেয় না। নবীনকাকাও গুরুত্ব দেয়নি। এই জন্যেই তো অস্কা এত ভাবে। সেই অনেক ছোটবেলায় নবীনকাকা তাকে স্টেজে তোলেনি। যোগাসন ক্লাবের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সবাই একে একে উঠল— শিবশঙ্কর, বিশ্বনাথ, প্রদীপ আদক সবাই। বাদ পড়ল অস্কা। সেই ছোট থেকেই সবাই তাকে বাদ দেয়। হয়তো সে হেরে ভূত হয়ে যেত। তারপর সব ভুলে যেত। কিন্তু ভোলা যায়নি। নবীনকাকাকে দেখলেই মনে পড়ে। অথচ অস্কা এখনও পারে। মাঝেমাঝেই পরখ করে নেয়। এই এখন যেমন পরখ করে নিল। পদ্মাসন থেকে ৯-কারাসন সব করে ফেলল। তারপর শেষে কঠিনতম আসন করার সময় ভাবল ভেলকি যেন দেখে না ফেলে। আশ্চর্য, সেই মুহূর্তেই ভেলকি ঘরে ঢুকল।
—কী হচ্ছে এসব! বুড়ো বয়সে হাড়-পাঁজড়া ভেঙে বসে থাকলে আমায় ডেকো না কিন্তু।
অস্কা বলল, আহা, ভাঙব কেন, এসব আমার অভ্যেস। দেখছিলাম ঠিক ঠিক পারি কি না।
—তা কী দেখলে?
—দিব্যি পারছি।
ভেলকি আর জবাব দিল না। ওই জন্যেই তো ছবিকে তার দরকার। ছবি হলে বলত, আমরা অনেক কিছুই পারি বল, তবু আমাদের দাম নেই। সেই ছবি হয়তো নেমতন্ন করতে না পারার লজ্জায় দেখাই করছে না। এতে লজ্জার কী আছে। অস্কা ওসব কিছু মনেই করে না। সামর্থ্যে কুলোয়নি, ব্যস মিটে গেল। এতে লজ্জার কী আছে।
এসবের মধ্যে ঝুপ করে একদিন মিলটা বন্ধ হয়ে গেল। জুটমিলের ওপর কোনও ভরসা নেই। আছে আছে, হুট করে তালা ঝুলে গেল। এমনিতেই সারামাস চলে না তার ওপর বন্ধ। অনেক সময় মালিকের চালাকি থাকে। অস্কা সেই কথাটাই বলতে গেল ভেলকিকে। ভেলকি মিল মালিককে দুষল। তারপর ভগবানকে দুষল। শেষে অস্কাকে আর দুষল না, পিষল।
তাতে ফের দুঃখ হল অস্কার। সে হাঁটতে হাঁটতে গোবিন্দর দোকানে গেল। গোবিন্দকেই সব বলবে। এরকম উত্তেজনার পরিস্থিতিতে অস্কা জোরে হাঁটে। কাউকে অহেতুক পিছনে ফেলে এগিয়ে চলে যায়। সাইকেল থাকলে প্যাডেলে চাপ মেরে হু হু করে ছোটে। সে দুটো লোককে পাশ কাটিয়ে আগে আগে হেঁটে গেল। ওরা ভাবল লোকটার তাড়া আছে হয়তো। কিন্তু না, লোকটা একটা চায়ের দোকানে এসে বসল।
অস্কা দেওয়ালে পিঠ ঠেসিয়ে বেঞ্চের ওপর পা ছড়াল। আহা, কী আরাম! নদীর ধারে গোবিন্দর এ যেন দোকান নয়, ঠাকুরদালান। নদীর ওপারটা হল কাঁকিনাড়া। তারপর ঘোষপাড়া, নৈহাটি, হালিশহর তারপর বাঘমোড় হয়ে কাঁচরাপাড়া। অস্কার ভাবনার ভেতর এই সমান্য অকিঞ্চিৎকর ক’টা কথা এসে গেল। আবার একথাও এল যেমন সে অঙ্কে কাঁচা ছিল। এখন একটু বুদ্ধি হয়েছে। এখন বুঝতে পারে পয়েন্ট টু আর পয়েন্ট টু গুণ করলে পয়েন্ট ফোর হয় না। গুণটা সেদিন অস্কা বলতে পারেনি। লোকটা ব্যঙ্গ করে হেসেছিল। ব্যঙ্গ করে হাসা লোকটির সঙ্গে ভেলকির সম্পর্ক আছে। যদি ওই অঙ্কটার বদলে সহজ অঙ্ক ধরত তাহলে ভেলকির হাসিতে আজ গোলাপ ফুটত। ভেলকির দোষ নেই। ওই লোকটিই পক্ষান্তরে দায়ী।
এদিকে গোবিন্দ জলের একটা বোতল দিয়ে গেল নিঃশব্দে। ও জানে অস্কাদা বসে বসে ভাবে কত কী। তারপর ফের নিঃশব্দে চা আর বিস্কুট ধরিয়ে দিয়ে গেল। অস্কার মনে হল বাঘমোড় থেকে কাঁচরাপাড়া স্টেশন কমপক্ষে পাঁচ কিমি রাস্তা। এরপর অস্কা দুটো বক দেখল প্রায় জল ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে। তারপর বলল, আচ্ছা গোবিন্দ?
গোবিন্দ বলল, হ্যাঁ বলুন।
—ছবি দোকানে আসে রে?
—কই না তো। ক’দিন আসেনি। সেই ছেলের মুখেভাত হবার পর থেকেই দেখছি না।
—ভাবলাম যদি আসে।
—না তো এখন আসছে না।
ছবিকে খুব দরকার অস্কার। ছবি না হলে যে তার চলবে না। এ দুনিয়ায় ছবিই তার আপনজন। দুটো মনের কথা বলে সুখ পাওয়া যায়। অথচ সেই ছবিরই দেখা নেই। পরের দিনও ছবির দেখা পাবে বলে বেরল। সে রথের সড়ক ধরল। কেন যে সে রথের সড়ক ধরে যাচ্ছে তাও সে জানে না। তবে মনে হল আজই সে ছবির দেখা পাবে। ছবিও বোধহয় বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। সে বুঝি রথের সড়ক ধরেই হাঁটছে।
অস্কা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ গতি বাড়াল। তার সামনের লোকটাকে টার্গেট অস্কার। লোকটাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে।
অস্কা গতি বাড়াল। লোকটা জোরে হাঁটছে। নিশ্চয়ই তাড়া আছে। কিন্তু অস্কা এগিয়ে যাবেই। অন ইয়োর মার্ক, স্টার্ট, ডুম। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে অস্কাকে ফেলে, সবাই। এমনকী পুষ্প, সেও। একটা মেয়ে সেও তাকে পিছনে ফেলে দিল। ছোট্ট অস্কা হেরে গিয়েও কাঁদল না। পরাজয়ের লজ্জা ভেতরে গেঁথে নিল। লোকটাকে আর একটু ধরতে বাকি আছে। অস্কা গতি বাড়াল। লোকটাও কি গতি বাড়াল? তারপর চোখের নিমিষে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
তখনই একটা পুলিসের গাড়ি এসে থামল। আশ্চর্য, পুলিস কেন? যে লোকটা এইমাত্র অদৃশ্য হয়ে গেল তাকে কি পুলিস খুঁজছে? গাড়ি থেকে নামল একজন পুলিস। তারপর দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে ফের গাড়িতে উঠল, তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল। না, ব্যাপারটা তাহলে তা নয়।
অস্কা ব্যাপারটাকে আর একবার ছবির মতো চোখের সামনে ভাসিয়ে তুলল। প্রথমে পুলিসের গাড়িটা এসে থামল। তারপর গাড়ি থেকে নামল— কে নামল? পুলিসের পোশাকে অস্কা নামল। সিগারেট কিনে পুলিস অফিসার অস্কা গাড়িতে উঠল। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিল। থানার ওসি সে। ঘরে ঢুকতে হলে স্লিপ লাগে। একদিন স্লিপ এল— নবীনচন্দ্র দাস।
—কী দরকার বলুন—
নবীন দাস পেশ করলেন তাঁর আসার কারণ।
ওসি অস্কা মুখ না তুলে লিখতে লিখতে বললেন, একটা দরখাস্ত লিখে বাইরে জমা দিয়ে যান।
তারপর একদিন স্লিপ এল এম কে মণ্ডল। অফিসার অস্কা চমকে উঠলেন। সেই লোকটা! পয়েন্ট টু আর পয়েন্ট টু মাল্টিপ্লাই করলে কত হয়? আজ অস্কা ছুরির ফলার মতো তাকালেন।
—বলুন, কী দরকার?
—স্যার আমার এই এই কারণে আসা। আপনাকে যদি গেস্ট হিসাবে পাই—
—পেলে কী হবে? থামলেন কেন? ধন্য হয়ে যাবেন তো? আসলে আমরা পুলিসের লোক। চোর ডাকাত গুন্ডা বদমাশ নিয়ে আমাদের কাজ। তারচেয়ে একজন গানের শিল্পী বা সাহিত্যিককে নিয়ে আসুন। সঠিক সম্মান দেখানো হবে। সব জায়গায় সবাইকে ডাকবেন না। আসুন।
অস্কার মনে হল ভেলকির দোষ নেই। ওই লোকটাই দায়ী। সেদিন লোকটা ইচ্ছা করলেই পাশ করিয়ে দিতে পারত। হয়তো ইচ্ছাটাই ছিল না। থাকলে ভেলকি একখানা ছাতা অন্তত এগিয়ে দিত। ক’দিন অস্কা ঠাঠা রোদ্দুরে কাজে গেছে। ভেলকি বলত, ছাতাটা নাও, রাস্তায় এত রোদ্দুর।
অস্কা আবার নিজের মতো হয়ে গেছে। সে পুলিস-ফুলিস কিচ্ছু নয়। সে অস্কা পাল। সে এখন রথের সড়ক ধরে হাঁটা দিচ্ছে। কোথায় যাবে সে জানে না। বড় রাস্তা, ছোট রাস্তা, গলি-ঘুঁজির ভেতর সে হারিয়ে যাবে। এখানে কেউ তাকে চেনে না। কেউ তার নাম ধরে ডাকবে না। যেমন খুশি ভাবতে ভাবতে চলে যাও। এই যে তার বুকের ভেতর কেউ একজন থাকে। সে আর কেউ নয়, স্বয়ং অস্কা পালের মন। সেই মনটা দিয়ে সে যা খুশি ভাবতে পারে। সে দেশের রাজা, উজির, সম্রাট বনে যেতে পারে। যেমন সে রাজা হয়ে নগর ভ্রমণে বেরিয়েছে। সামনে শত শত মানুষ তার স্তুতি করছে। অনেকের হাতে ফুলের মালা। এই যে দূরে দেখা যাচ্ছে জুটমিলের এক নম্বর সাহেব। সাহেব সেলাম করল। রাজা অস্কা বললেন, তোর নাম কী? লোকটি সসম্ভ্রমে মাথা নেড়ে বলল, হুজুর আমার নাম মোহনলাল শর্মা।
—তুই কী করিস?
—আজ্ঞে, আমি জুটমিলের এক নম্বর সাহেব।
—রাজামশাই আমার অপরাধ?
রাজা অস্কা গর্জে উঠলেন, অপরাধ? অনেক অপরাধ রয়েছে তোর নামে। তুই মিলের মজদুরদের দিয়ে নিজের বাড়ির কাজে লাগাস। তোর শাস্তি চাই। আজ থেকে তোকে মজুরের কাজ করতে হবে। মজুরের কী কষ্ট মজুর হয়ে দেখ।
রাজা অস্কা এগচ্ছেন। রাস্তার দু’পাশে অগণিত প্রজা। কিন্তু ওই লোকটি কে? রাজাকে দেখেও যার ভ্রুক্ষেপ নেই! কী স্পর্ধা!
মন্ত্রী?
মন্ত্রী করজোড়ে সামনে এসে দাঁড়াল।
—ওই লোকটি কে? আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে?
—আজ্ঞে রাজামশাই ও হল ছবিলাল।
—কে ছবিলাল?
—আজ্ঞে সবাই ওকে ছবি বলে ডাকে। ময়রার দোকানে কাজ করে।
—ডাকো ওকে।
ছবিলাল সামনে এসে দাঁড়াল। সে আদব-কায়দা কিচ্ছু জানে না। সামান্য ভদ্রতাবশত নমস্কারটুকুও করল না। সবাই ভাবল এই বুঝি রাজা কঠিন শাস্তি বিধান করবেন। কিন্তু না। রাজা কোনও শাস্তির কথা বললেন না।
—মন্ত্রী, ওকে এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দাও।
ছবিলাল স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করল। কিন্তু তার চেয়েও বিস্মিত হয়ে বলল, অস্কা তুই এখানে!
অস্কার শরীর থেকে রাজবেশ খসে পড়ল। হাতি উধাও হয়ে গেল। মন্ত্রী, সান্ত্রী, স্তাবক, উমেদার সব উধাও।
—ছবি তোকেই তো আমি খুঁজতে বেরিয়েছি।
—কী আশ্চর্য আমিও তোকে খুঁজতে বেরিয়েছি।
অস্কা বলল, চল, হাঁটতে হাঁটতে গোবিন্দর দোকানে যাই।
অলংকরণ : সোমনাথ পাল