মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
পাবলিক রিলেশনস বা জনসংযোগ শব্দটা বর্তমানে অতিপরিচিত। এই শব্দবন্ধের প্রথম প্রয়োগ দেখা যায় ১৮০৭ সালের ২৭ অক্টোবর কংগ্রেসের সপ্তম অধিবেশনে টমাস জেফারসনের লিখিত ভাষণে। তবে পেশাগত এবং প্রথাগতভাবে পাবলিক রিলেশনসের সেঞ্চুরি পূর্ণ করল ২০২০ সালে। পাবলিক রিলেশনসের আধুনিক কৌশলাদির জনক এডওয়ার্ড এল বার্নেজ ১৯২০ সালে আমেরিকায় পাবলিক রিলেশনসকে পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
তার আগে থেকেই অবশ্য তিনি পাবলিক রিলেশনসের সঙ্গে যুক্ত। তিনিই প্রথম ১৯২১ সালে নিজেকে পাবলিক রিলেশনসের পরামর্শদাতা হিসেবে জাহির করেন। ১৯২৩ সালে নিউ ইয়র্কের কলেজে পাবলিক রিলেশনস বিষয়ে ক্লাস নেন। অবশ্য তার আগে তিনি একটি বইও লিখেছিলেন। তারও আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অর্থাৎ ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত তিনি আমেরিকার প্রতিরক্ষা দপ্তরের সমর বিভাগের পাবলিক ইনফরমেশন শাখায় কাজ করেন। তবে তখন তাঁর কাজ ছিল মূলত প্রোপাগান্ডাধর্মী।
অনেকের অবশ্য ধারণা, পাবলিক রিলেশনস অতি সহজ ব্যাপার। হাসি মুখে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করাতেই পাবলিক রিলেশনস সীমাবদ্ধ। আদতে কিন্তু মোটেই তা নয়। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ওকালতি ইত্যাদির মতো পাবলিক রিলেশনসও একটি পেশা। জ্বর, সর্দি-কাশিতে নিজেই কিছু ওষুধ খেয়ে নিলে যেমন ডাক্তার হওয়া যায় না, তেমনই অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করলেই জনসংযোগবিদ হওয়া যায় না।
এডওয়ার্ড এল বার্নেজের আগে আইভি লেডবেটার লি নামে আরেক আমেরিকান ১৯০৩ সালে বস্টনে একটি পাবলিসিটি অফিস খোলেন। অনেকে আইভি লি-কেই জনসংযোগ পেশার সূচনাকারীর মর্যাদা দেন। রকফেলার এবং পেনসিলভানিয়া রেলরোড কোম্পানির জনসংযোগের কাজ করে বিখ্যাত হন লি। দু’টির ক্ষেত্রেই সঙ্কটজনক অবস্থার মোকাবিলায় (ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট) সংবাদ চেপে না রেখে, নিয়মিতভাবে সংবাদমাধ্যমের দ্বারা বার্তা পরিবেশন করে সংস্থার প্রতি কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের পরামর্শ দেন। এর ফলে দু’টি কোম্পানিই সঙ্কটজনক অবস্থা থেকে উদ্ধার পায়।
আইভি লি ১৯০৬ সালে ২৮ অক্টোবর বিশ্বে প্রথম ‘প্রেস রিলিজ’ ইস্যু করেন। জনগণকে উপেক্ষা করার পরিবর্তে, নিয়মিত বার্তা বিনিময়ের মাধ্যমে জনগণের মন জয়ের উপদেশ তিনিই দিয়েছিলেন কোম্পানিদের। Instead of ‘Public be damned’ to ‘Public be informed’।
***
এখন আসল প্রশ্নে আসা যাক। পাবলিক রিলেশনস বা জনসংযোগ কাকে বলে? এককথায় উত্তর দিতে গেলে বলা যায়, বিভিন্ন মাধ্যমের দ্বারা নিয়মিতভাবে প্রতিষ্ঠানের সাফল্য, যদি কোনও ক্ষেত্রে বিচ্যুতি দেখা দেয় তার কারণ ব্যাখ্যা, কোম্পানির আদর্শ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ইত্যাদি জনসমক্ষে তুলে ধরে মানুষের মন জয় বা আস্থা অর্জনকেই পাবলিক রিলেশনস বা জনসংযোগ বলে।
যদিও পাবলিক রিলেশনসের যে সব বিস্তর সংজ্ঞা পাওয়া যায়, তার মধ্যে লন্ডনের ‘দ্য চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব পাবলিক রিলেশনস’ (আগে যাকে ‘দ্য ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব পাবলিক রিলেশনস’ বলা হতো)-এর সংজ্ঞাটিই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। তাঁদের মতে, পাবলিক রিলেশনস হচ্ছে, ‘প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন ও তা বজায় রাখার জন্য সুচিন্তিত, পরিকল্পিত ও নিয়মিতভাবে বিভিন্ন মাধ্যমের দ্বারা নিয়মিত বার্তা প্রেরণ।’
অর্থাৎ জনগণের সমর্থন লাভের কৌশলাদিকেই পাবলিক রিলেশনস বলে। জনসংযোগের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের পরিমণ্ডলে সুস্থ, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলা, যার মধ্যে প্রতিষ্ঠান মসৃণ ও নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পারে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, ক্ষুদ্র বা মাঝারি অনেক প্রতিষ্ঠানের এখনও জনসংযোগ সম্বন্ধে ধারণা স্পষ্ট নয়। যার জন্য ‘শ্রেণীবদ্ধ (ক্লাসিফায়েড) বিজ্ঞাপনে’ কর্মী নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপনে দেখা যায় ‘রিসেপশনিস্ট-কাম-টেলিফোন অপারেটর-কাম-পিআরও’ চাই। অর্থাৎ এই তিনটিই যেন একই ধরনের কাজ। আসলে তো আদৌ তা নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার, উচ্চপদের কর্তাব্যক্তি বা ভিআইপিদের আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে রেল স্টেশনে বা বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা বা বিদায় জানানোর জন্য হাজির থাকা এবং সেইসঙ্গে ট্রেন বা বিমান ও হোটেল বুকিং ইত্যাদি অর্থাৎ প্রোটোকল অফিসার কাজ করিয়ে থাকে পিআরওদের।
আসলে বিভিন্ন সংস্থায় মজা করে একটা কথা প্রচলিত আছে, যে কাজ বা দায়িত্ব অন্য কোনও বিভাগকে দেওয়া যাবে না। সেইসব কাজ বা দায়িত্ব পাবলিক রিলেশনস অফিসারকে দিয়ে দাও।
***
তাহলে পাবলিক রিলেশনসের আসল দায়িত্ব কী? আগেই বলা হয়েছে, বিভিন্ন মাধ্যমের দ্বারা প্রতিষ্ঠানের সকল সংবাদ সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরা। যার দ্বারা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি বা ‘ইমেজ’ উজ্জ্বল করা। ‘ইমেজ’ বলতে কোনও, প্রতিষ্ঠানের, ব্যক্তি বা পণ্যের সম্বন্ধে ধারণাকে বোঝায়। সচেতন বা অচেতনভাবে প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বস্তু প্রতি মুহূর্তে গড়ে চলেছে। এই জন্যই কোনও একজন ক্রেতা কোনও প্রতিষ্ঠানের একটি ব্র্যান্ড পছন্দ করে থাকেন। আবার অন্য একজন, প্রতিযোগী কোম্পানির অন্য ব্র্যান্ড পছন্দ করে থাকেন।
‘ইমেজ’ কিন্তু দুই ধরনের। ‘পজিটিভ’ ও ‘নেগেটিভ’। অসামাজিক কাজ যারা করে থাকে, তাদেরও ‘ইমেজ’ আছে। কিন্তু সেটা ‘নেগেটিভ ইমেজ’।
জনসংযোগের অপর দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক অর্থাৎ সুন্দর বোঝাপড়া তৈরি করা। কারণ, বোঝাপড়া না থাকলেই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে।
আগে জনসংযোগ বা পাবলিক রিলেশনসের ভূমিকা ছিল অনেকটা ‘মাউথপিস’-এর মতো। প্রতিষ্ঠান যা তথ্য পরিবেশন করতে বলবে তার প্রচার করা। কিন্তু এখন হয়েছে ‘ম্যানেজমেন্ট ফাংশান’। অর্থাৎ ম্যানেজমেন্ট-এর সভায় পিআরও-কে উপস্থিত থেকে নীতি-নির্ধারণকালে কী সিদ্ধান্ত নিলে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি বা ‘ইমেজ’ বজায় থাকবে বা বৃদ্ধি পাবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া। একইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘মার্কেটিং পিআর’। অর্থাৎ ‘বাজারে’ নতুন প্রতিষ্ঠান বা পণ্যের প্রবেশকাল থেকে শুরু করে অন্তহীনভাবে প্রতিটি পর্যায়ে, নিয়মিত তথ্য প্রদানের দ্বারা প্রতিষ্ঠান ও পণ্যের পরিচিতি ঘটিয়ে আগ্রহ বা চাহিদা সৃষ্টি করা। অর্থাৎ, এখন পাবলিক রিলেশনস শুধু প্রতিষ্ঠানের ‘মুখ’ নয়। চোখ-কানও। জনগণ বা সমাজ প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে কী ধারণা পোষণ করছেন বা বলছেন, তার সম্বন্ধে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে এবং ‘ফিডব্যাক’ অনুসারে প্রয়োজন হলে জনগণের প্রত্যাশানুযায়ী সংস্থার প্রশাসনকে নীতি বা কর্মপদ্ধতি পরিবর্তনের পরামর্শ দিতে হবে।
পাবলিক রিলেশনসের মূল দায়িত্বকে ইংরেজি বর্ণমালার চারটি ‘আর’ (R) অক্ষর দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। প্রথমত, ‘রিলেশনস’ অর্থাৎ সম্পর্ক বা জনসংযোগ গড়ে তোলা ও বজায় রাখা। দ্বিতীয় হচ্ছে ‘রেপুটেশন’ বা সুনাম, ‘ইমেজ’ বাড়ানো। তৃতীয়ত, ‘রিমাইন্ডার’। নিয়মিত তথ্য প্রদানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান ও তার ব্র্যান্ডকে মনে পড়িয়ে জনগণের মনের মধ্যে একটা জায়গা তৈরি করা। চতুর্থত, ‘রেকগনিশন’ (Recognition)। কোনও ভালো কাজ জনসমর্থন বা স্বীকৃতি না পেলে মূল্যহীন হয়ে যায়।
জনসংযোগকে একাধারে শিল্প বা কলাবিদ্যা (আর্ট) ও বিজ্ঞান বলে অভিহিত করা হয়। কারণ, পাবলিক রিলেশনস ক্যাম্পেনে সাফল্য লাভ করতে হলে যুগপৎ কল্পনা শক্তির প্রয়োগ ও গবেষণার মাধ্যমে কোনও কৌশল অবলম্বন করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু অনেকে জনসংযোগকে দমকলের মতো কাজ বলে মনে করেন। অর্থাৎ, আগুন লাগলে যেমন নেভানোর জন্য দমকলের ডাক পড়ে, ঠিক তেমনই কোম্পানির সুনাম ক্ষুণ্ণ হলে জনসংযোগের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ, পাবলিক রিলেশনস মানে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের ‘কালো’ দিকগুলিকে ‘সাদা’ বলে প্রচার করা। বাস্তব চিত্র কিন্তু অন্যরকম। প্রতিষ্ঠানের অবস্থা যে রকমই হোক না কেন, সবক্ষেত্রেই জনসংযোগ বা পাবলিক রিলেশনসের প্রয়োজন। যদি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ হয়, তাহলে উদ্ধার পাওয়ার জন্য তো বটেই, যদি উল্টো মানে প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ভালো হয়, তাহলে সেই অবস্থা বজায় রাখার জন্য এবং আরও ভালো করার জন্য জনসংযোগে গুরুত্ব দিতে হয়। যথেচ্ছ বাড়িয়ে বলা অর্থাৎ মিথ্যার ফানুস তৈরি করা কখনওই জনসংযোগের কাজ নয়। বলা হয়, ৭০ শতাংশ কাজ করে ৩০ শতাংশ প্রচার করো।
প্রতিযোগিতামূলক বাজারে থাকুক বা না থাকুক, সব প্রতিষ্ঠানেরই পাবলিক রিলেশনস দরকার। সরকারি, বেসরকারি, এনজিও, ব্যাঙ্ক, হাসপাতাল তো বটেই এমনকী সেবামূলক বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেরও জনসংযোগ দরকার হয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিজেদের অগ্রগতি বা কোনও সমস্যা, কাজকর্ম, ‘পলিসি’ ইত্যাদি বিষয়ে মানুষকে ওয়াকিবহাল করা, মানুষের নজর কাড়া, নিজেদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানান দেওয়া প্রভৃতি। এমনকী, ধর্মীয় বা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও জনসংযোগ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ‘ইসকন’-এর পিআরও আছে। অন্য বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পিআরও পদ হয়তো নেই। কিন্তু অন্য কোনও সন্ন্যাসী বা ব্যক্তিকে জনসংযোগের দায়িত্বে রেখেছেন। যেমন, ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের পক্ষ থেকে জনসংযোগ অফিসার বা পিআরও নিয়োগের জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। দু’টি সর্বভারতীয় ইংরাজি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের কথাও মনে পড়ছে। প্রথমটি ২০০২ সাল। আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধের পর তালিবানের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল, তারা হেরে গিয়েছিল ‘জনসংযোগের অভাবে’। আবার, ২০০৭ সালে তিহার জেলে পাবলিক রিলেশনস অফিস খোলার পরে, প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সে খবর ইংরাজি দৈনিকে প্রকাশ করা হয়েছিল।
জনসংযোগ কিন্তু শুধু প্রতিষ্ঠানের বাইরের জনগণকে উদ্দেশ্য করে করলেই হবে না। অভ্যন্তরীণ অর্থাৎ নিজেদের কর্মচারীদের সঙ্গেও সেটা অত্যন্ত জরুরি। তাঁদের কোম্পানি সম্বন্ধে উৎসাহী করতে না পারলে, কোম্পানির মঙ্গল কখনওই সম্ভব হবে না। প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে তাঁদের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে ভালো-মন্দ যে মন্তব্যই তাঁরা করুন না কেন, সাধারণ মানুষ সেটাই বিশ্বাস করে। কারণ তাঁরা মনে করেন, কর্মীরা যেহেতু প্রতিষ্ঠানকে ভেতর থেকে দেখছেন, তাঁরা প্রতিষ্ঠানকে অনেক ভালো করে জানেন। এই জন্য প্রতিষ্ঠানও কর্মীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে, তাঁদের ‘গুড উইল অ্যাম্বাসাডর’ বানাতে চায়। মানে, তাঁদের দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধি করতে চায়। এক্ষেত্রে টাটা কোম্পানির রুশি মোদির কথা মনে পড়ে। তাঁর আমলে কর্মীদের সঙ্গে সংস্থার সম্পর্ক নজির স্থাপন করেছিল।
***
ভারতে জনসংযোগ কয়েকটি ধাপে বিভক্ত। আমাদের দেশে জনসংযোগে পৌরাণিককালেও কিছু হদিশ মেলে। দেবর্ষি নারদও জনসংযোগে রত ছিলেন বলে অনেকে মত পোষণ করেন। কারণ তিনি সুরলোকে বার্তা পরিবেশন করে মতামত তৈরি করতেন। বীণা ছিল তাঁর মাধ্যম। রামায়ণ, মহাভারতেও সেকালে রাজ্যের অবস্থা, রাজ্য শাসন পদ্ধতির কথা বর্ণিত আছে। ধৃতরাষ্ট্রের সখা বিদুর বা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বহুক্ষেত্রে আলোচনা ও নীতিব্যাখ্যার দ্বারা অন্যদের পরিচালনা করার উল্লেখ রয়েছে।
আবার, বৈদিক যুগেও জনমত গঠনের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন সেকালের ইতিহাস বহন করে। পরবর্তীকালে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ‘জনসংযোগ’ শব্দের উল্লেখ না থাকলেও, কীভাবে তথ্যপ্রদান ও সংগ্রহ করতে হবে সে কথা বলা আছে। সম্রাট অশোক স্তম্ভ, শিলালিপি, স্তূপ ইত্যাদিতে তাঁর সময়কার শাসনব্যবস্থা, ধর্মের কথা লিপি ও চিত্রের মাধ্যমে জানিয়েছিলেন। অতীশ দীপঙ্কর ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিব্বত গিয়েছিলেন। গুপ্তযুগেও লৌহস্তম্ভ ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল। অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্র আজও আমাদের সেকালের সমাজব্যবস্থা জানতে সাহায্য করে।
মুঘল আমলেও জনসংযোগে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। বাদশারা নিজেদের পছন্দের লোককে ইতিহাস লেখার কাজে নিয়োজিত করতেন। এছাড়া, ‘হরকরা’ বা ‘মোকবার’ নামে কর্মী নিয়োগ করা হতো। যাদের কাজ ছিল মৌখিকভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছে তথ্য প্রদান করা। ‘ঝারোখা দর্শন’-এর মারফৎও সম্রাট আকবর জনসংযোগের প্রক্রিয়া গড়ে তুলেছিলেন। ‘ঝারোখা’ মানে হচ্ছে জানলা। সম্রাট নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে ‘ঝারোখা’য় এসে বসতেন এবং জনগণ সামনাসামনি তাদের অভাব-অভিযোগ বা বক্তব্য সম্রাটের কাছে জানাবার সুযোগ পেতেন। আকবরের পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর জনগণের সমস্যা সুরাহা করার জন্য ঘণ্টার ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রাসাদের বাইরে বিশাল এক ঘণ্টা লাগানো হয়েছিল। কারও কোনও বক্তব্য থাকলে, ঘণ্টা বাজাতে পারতেন এবং পরে সম্রাটের কাছে গিয়ে অভিযোগ বা বক্তব্য জানাতে পারতেন।
জমিদার বা শাসকগণ নিজ এলাকায় সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে স্কুল, কলেজ, জলাশয়, রাস্তা, দাতব্য চিকিৎসালয় ইত্যাদি করে দিতেন এবং সাধুবাদ পেতেন। এগুলো আজকের দিনের ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’ বা সিএসআর-এর সূত্রপাত বলে ধরা যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে বাংলার রঘু ডাকাতের কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। রবিনহুডের মতো সেও ডাকাতির একটা অংশ গরিব মানুষের উপকারার্থে ব্যয় করতেন এবং সেই সকল মানুষের কাছ থেকে জনসমর্থন পেতেন। পরবর্তীকালে আমরা পাই, বিভিন্ন ধর্মপ্রচারকদের যাঁরা নিজেদের সাধনালব্ধ ফল বা ধর্মীয় মতবাদের প্রচার করে সাধারণ মানুষকে দৈনন্দিন যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পাওয়ায় উদ্বুদ্ধ করতেন। যেমন, গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর জৈন, আদি শংকরাচার্য, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ।
ক্রমে আমরা আধুনিক জনসংযোগ বা পাবলিক রিলেশনসের কাজে ব্রতী হলাম এবং বলতে গেলে এখন সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান পাবলিক রিলেশনসের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠানই নিজস্ব পাবলিক রিলেশনস বিভাগ রাখার পরিবর্তে অথবা ছোট অফিস রেখে ‘পাবলিক রিলেশনস এজেন্সি’ নির্ভর হয়ে পড়ছে। তার কারণ এর ফলে ব্যয়সঙ্কোচ ঘটে এবং বিশেষজ্ঞদের সাহায্য পাওয়ায় সাফল্য বেশি পাওয়া যায়।
আরেকটি যেটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে, মাস মিডিয়া অপেক্ষা ‘সোশ্যাল মিডিয়া’র প্রতি ঝোঁক লক্ষ করা যাচ্ছে। এর কারণ একটাই। সরাসরি বার্তা বিনিময় করা যায় এই মাধ্যমে। এমনকী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারা বার্তা জ্ঞাপন করেন মূলত দুটি উদ্দেশ্যে— প্রথমত, মানুষের কাছে অবিলম্বে প্রত্যক্ষভাবে পৌঁছানো যায়। আবার সংবাদমাধ্যমও পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া সেই খবর ‘কভার’ করে।
ইতিহাসে গতি-প্রকৃতি লক্ষ করে বলা যায়, জনসংযোগ বা পাবলিক রিলেশনস কখনওই এক জায়গায় থেমে থাকবে না। কারণ, পাবলিক রিলেশনস পরিবর্তনশীল বিষয়।
গ্রাফিক্স সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় স্বাগত মুখোপাধ্যায়