মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
সুতরাং তেহরান দখল হয়ে গেলে সম্ভাব্য পাকিস্তান আর কতই বা দূর! অতএব জিন্নার তখন থেকেই আতঙ্ক শুরু হয়েছিল। কারণ, পাকিস্তান পাওয়ার পর সেটা যদি রক্ষাই করতে না পারা যায়, তা হলে গোটা দুনিয়ার কাছে আর নিজের মুসলিম দেশবাসীর কাছে তাঁর চরম অপমান হবে। জিন্না তাই গোপন পরামর্শ চাইছেন স্মিথের কাছে। স্মিথ স্পষ্ট কথার লোক। মালয় থেকে মায়ানমার, জার্মান যুদ্ধ থেকে সাউথ আফ্রিকা, তাঁর এযাবৎকালের অভিজ্ঞতা প্রচুর। অতএব তিনি একটা ডায়েরি বের করে রীতিমতো ম্যাপ এঁকে জিন্নাকে বুঝিয়ে দিলেন, গোটা পাঞ্জাব আর সম্পূর্ণ বেঙ্গল, যদি পাকিস্তানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে না পারেন জিন্না, তা হলে কিন্তু তাঁর নতুন দেশের ডিফেন্স মারাত্মক নড়বড়ে হয়ে যাবে। ‘গোটা বেঙ্গলের দরকার কেন?’ জিন্না জানতে চাইছিলেন। মৃদু হেসে স্মিথ বেঙ্গলের একটা পৃথক ম্যাপিং করে বললেন, ‘মিস্টার জিন্না! বেঙ্গলের ইস্ট আর ওয়েস্ট সবটা যদি আপনি না পান, তা হলে আজ নয় কাল, আপনার ডিফেন্স ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাবে এবং তার থেকেও বেশি হবে আপনার ইকনমি। কারণ একটাই, ক্যালকাটা। ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাপাসিটির ৮৫ শতাংশই ক্যালকাটায়। আর সমুদ্রপথের বাণিজ্য অর্থাৎ সি ট্রেড, অর্ধেক কলকাতার।’ স্মিথ থামলেন না। বললেন, ‘আপনার জুট প্রোডাকশন যতই ইস্টার্ন বেঙ্গলে হোক, জুটমিলের সিংহভাগ কিন্তু ওয়েস্ট বেঙ্গলে। বিশেষ করে ক্যালকাটার কাছে। তার মানে জুট ট্রেড মার খাবে যদি আপনি মিলই হাতে না পান। ওয়েস্ট বেঙ্গলে আইসিএস, গভর্নমেন্ট, অফিসারস, ডক্টরস, ব্যারিস্টারস বেশি। সেটা না পেলে শুধু ইস্ট বেঙ্গলে দেখবেন আপনার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালানোর মতো যোগ্য লোক পাচ্ছেন না। তাই পাঞ্জাব আর বেঙ্গল পুরোটা না পেলে আপনার পক্ষে সম্ভব নয় সোভিয়েত হানা থেকে পাকিস্তানকে বাঁচানো।’ জিন্না এই ভয়ঙ্কর সতর্কবাতা শুনে রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। ‘তা হলে আমার কী করা উচিত মিস্টার স্মিথ?’ স্মিথ হেসে বললেন, ‘ট্রাই টু গেট বোথ, অর এলস দেয়ার মাস্ট বি সাম আদার অলটারনেটিভ উইথ আওয়ার গভর্নমেন্ট ইন ব্রিটেন!’
জিন্না জানতে চান কী বিকল্প আছে এর? তিনি ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের কাছেও জানতে চাইছেন। ওয়াভেল কিছু বললেন না। তবে মেসেজটা তিনি পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনে। প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলির সরকার কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগকে একটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিল। সেটা হল, ভারত বিভাজনের দরকার নেই। ভারত ঐক্যবদ্ধ থাকুক। তবে দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে। অর্থাৎ কেন্দ্রের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং যোগাযোগ অর্থাৎ রেল, টেলিগ্রাফ ইত্যাদি। আর রাজ্যগুলো পাক বাকি ক্ষমতা। ঠিক একইসঙ্গে সিন্ধ, পাঞ্জাব, বালুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেঙ্গল আর অসম নিজেরাই ভোটাভুটিতে স্থির করুক যে তারা একজোট হয়ে একটি পৃথক স্বশাসিত রাজ্যে পরিণত হবে কি না। বস্তুত সেটাই হবে জিন্নার দাবি মতো একটা শ্যাডো ভারত। অখণ্ড থাকবে ইন্ডিয়ান আর্মিও। একইভাবে অখণ্ড থাকবে পাঞ্জাব আর বাংলাও। ঠিক এই সময়টায় জিন্নাকে গ্রাস করেছিল টেনশন। তিনি নার্ভাস হয়ে যান। কারণ ৫ জুন দিল্লিতে মুসলিম লিগের একটি রুদ্ধদ্বার সেশনে মুসলিম লিগের একের পর এক নেতা জিন্নার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘আপনি কি এরকম পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আমাদের? এটা কোনও সলিউশন হল? এটা মেনে নেওয়া যায় না!’ কিন্তু অন্যদিকে জিন্না জানেন যে গোটা বেঙ্গল, গোটা পাঞ্জাব কিছুতেই কংগ্রেস অথবা ব্রিটিশ তাঁকে দেবে না।
ঠিক এরকম অবস্থায় নিজের ইমেজ বাঁচাতে জিন্না ২৬ জুলাই বম্বের মালাবার হিলসে নিজের বাংলোয় রিপোর্টারদের ডাকলেন। প্রেস কনফারেন্স করবেন। এটা হল জওহরলাল নেহরুর বক্তব্যের পাল্টা প্রেস কনফারেন্স। কারণ, নেহরু ৭ জুলাই দিল্লিতে এআইসিসি অধিবেশনে ব্রিটিশ সরকার ও মুসলিম লিগ উভয়কেই হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘ভারত স্বাধীন হওয়ার পর নিজের ইচ্ছায় চলবে। একটিও শর্ত আরোপ করা যাবে না ভারতের উপর। ভারত ঠিক করবে তারা কীভাবে প্রশাসন চালাবে।’ জিন্না ২৬ জুলাই বললেন, ‘নেহরু আর কংগ্রেস কী মনে করেছে? আমরা হাতজোড় করে ভিক্ষা চাইছি! কখন তাঁরা ভিক্ষা দেবে? একেবারেই নয়। আমরা নিজেদের দাবি নিজেদের মতো করে আদায় করতে জানি।’ এটুকু বলেই সেদিন জিন্না শেষ করেছিলেন। পরদিন বাকিটা বললেন, ২৭ জুলাই। মুসলিম লিগের বিশেষ বৈঠকে তিনি ব্রিটিশদের ওই ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘আমাদের পূর্ণাঙ্গ পাকিস্তান চাই। এবার ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে!’
ওই ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে কথাটির অর্থ কী বোঝা গেল না। স্পষ্ট করে বলাও হয়নি। তবে ১৬ আগস্ট তার অর্থটা জানিয়ে দিল কলকাতা। সেখান থেকেই শুরু হল এক চরম অন্ধকার সময়। দাঙ্গা। ঠিক তিনবছর আগে এরকমই এক আগস্ট মাসে বেঙ্গলে শুরু হয়েছিল দুর্ভিক্ষ। আর তিনবছর পর শুরু হল দাঙ্গা। এবং ঠিক একবছর পর দেশভাগ। দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ-ভারতের একটি জাতি আর একটি রাজ্যের অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দিল বহুকালের জন্য! বেঙ্গল ও বাঙালি!
..................................
কলকাতার বদলা নেওয়া শুরু হয়েছিল নোয়াখালিতে। নোয়াখালির প্রতিশোধ শুরু হল বিহারে। বিহারের দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল পাঞ্জাবে। গোটা দেশ জ্বলছে। এরকম একটি সময়ে জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথগ্রহণ করল। তার ঠিক আগে ওয়াভেল নেহরু আর মহাত্মা গান্ধীকে ডেকে বললেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারে মুসলিম লিগ না এলে সমস্যা কিন্তু মিটবে না। বরং বাড়বে। আপনারা জিন্নার সঙ্গে একটা মীমাংসার পথে হাঁটছেন না কেন?’ গান্ধী বললেন, ‘আমাদের তো কোনও আপত্তি নেই! জিন্না আর নেহরু তো কথা বলতেই পারেন।’ ততদিনে অবশ্য কংগ্রেসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিসভাও প্রায় গঠিত। সর্দার প্যাটেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজাগোপালাচারী শিক্ষামন্ত্রী, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রী, মুসলিম প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লির কংগ্রেস নেতা আসফ আলি হলেন রেলমন্ত্রী। শিখ প্রতিনিধি বলদেব সিং প্রতিরক্ষামন্ত্রী। কিন্তু মুসলিম লিগ নিজেদের সরিয়ে রাখল। ওয়াভেল প্রাণপণে চেষ্টা করলেন, যাতে লিগ যোগ দেয় মন্ত্রিসভায়। সেই প্রয়াস সফল হল। যখন ভোপালের নবাব দিল্লিতে এসে গান্ধীজির সঙ্গে মিটিং করলেন। এবং দীর্ঘ আলোচনার পর একটি বিবৃতি জারি হল। সেই বিবৃতিতে লেখা হয়েছিল, ‘ভারতের সিংহভাগ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি যে মুসলিম লিগ, সেটা স্বীকার করতে আপত্তি নেই কংগ্রেসের। আপত্তি না থাকার কারণ সাম্প্রতিক নির্বাচনে সিংহভাগ মুসলিম আসনই লিগের দখলেই এসেছে।’ এই বিবৃতির ফলেই মুসলিম লিগ রাজি হল সরকারে যোগ দিতে। কিন্তু কংগ্রেসের শর্ত হল, এর অর্থ এই নয় যে, কংগ্রেস কোনও মুসলিমকে নিজেদের প্রতিনিধি করতে পারবে না সরকারে। তারাও মুসলিম নেতাকে মন্ত্রী করতে পারবে। কিন্তু সেটা পছন্দ হয়নি জিন্নার। তাই কংগ্রেস যখন আসফ আলিকে নিজেদের মন্ত্রী হিসেবে বহাল রাখল, তখন জিন্না পাল্টা কৌশলে একজন হিন্দুকে মনোনীত করলেন মন্ত্রিসভায় নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। তিনি ছিলেন এক তফসিলি জাতিভুক্ত নেতা, বেঙ্গলের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।
স্বাধীনতা আসছে। তার আগে অন্তর্বর্তী সরকারও গঠন হয়ে গেল। অন্যদিকে চলছে নিরন্তর দাঙ্গার অন্ধকার। ঠিক এই সময়ই অন্তর্বর্তী সরকার এবং লর্ড ওয়াভেল স্থির করলেন এবার সময় এসেছে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার। গঠন করা হল সংবিধান সভা। স্থির হল, প্রাদেশিক বিধানসভাগুলির মাধ্যমে সংবিধান-সভার সদস্য নির্বাচিত হবে। সংবিধান-সভার সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৮৯। রাজ্যগুলি দুটি ভাগে বিভাজিত ছিল। ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজন্যবর্গের রাজ্য। সংবিধান সভায় ২৯৬ জন ব্রিটিশশাসিত ভারতের সদস্য এলেন। আর ৯৩ জন এলেন রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলি থেকে। সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে মাথায় রাখা হয়েছিল, প্রশাসন পরিচালনা পদ্ধতি সম্পর্কে দক্ষ, জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ কিছু মানুষ যেন সংবিধান রচনার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারেন।
মুসলিম লিগ চায়নি সংবিধান-সভার অধিবেশন বসুক। বরং আলোচনা থেকে সরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বহু চেষ্টা করেও মুসলিম লিগকে রাজি করাতে না পেরে ১৯৪৬ সালে ২০ নভেম্বর ঘোষণা করা হয়, সংবিধান-সভার প্রথম অধিবেশন বসবে ৯ ডিসেম্বর, ১৯৪৬। সেদিন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু প্রস্তাবনা এনেছিলেন। প্রস্তাবনার প্রতিপাদ্য হল, সংবিধানের ‘লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য’। জওহরলাল নেহরু ভারতের সংবিধান রচনার প্রথম প্রস্তাবনার দীর্ঘ বক্তৃতা সমাপ্তির ক্ষণে বলেছিলেন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কিছু বাক্য। বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যৎ আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি এই সংবিধান-সভার কাছে আবেদন করছি, এই প্রস্তাবনাকে বিবেচনা করে আমাদের পবিত্র অতীতকে মনে রেখে, বর্তমানের অস্থিরতাকে উপলব্ধি করে এবং এখনও না আসা মহান ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতা বজায় রেখেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হোক।’
১৯৪৬ সালের শেষভাগে যখন সংবিধান সভার কাজ শুরু হওয়ার প্রস্তুতি চলছে, তার ঠিক আগে হঠাৎ করে এক বিদগ্ধ ভারতীয় রাজনীতিক অকস্মাৎ লক্ষ্য করলেন, তিনি যেন নতুন ভারতের রূপায়ণ পর্বের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টায় একাকী হয়ে গিয়েছেন। সংবিধান সভায় তাঁকে একজন সদস্য মনোনীত করা হয়েছে। তিনি বেঙ্গল থেকে নির্বাচিত এক সদস্য। ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর। তাঁর কংগ্রেস এবং বিশেষ করে তীব্র গান্ধী বিরোধিতা সর্বজনবিদিত। কিন্তু আম্বেদকর সংবিধান সভা চলাকালীন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সদস্যদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার সময় বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি কংগ্রেস বিরোধী হলেও, তার থেকেও বেশি বিরোধী জিন্নার আগ্রাসী পাকিস্তান অবস্থানের। এ ব্যাপারে তিনি অনেক বেশি জাতীয়তাবাদী। অর্থাৎ আম্বেদকর যেন সামান্য হলেও কংগ্রেসের সঙ্গে একটু হলেও নরম মনোভাব প্রদর্শন করছেন। সেটা লক্ষ্য করে তাঁর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বললেন প্রথম যিনি, তিনি হলেন রাজকুমারী অমৃতা কাউর। সংবিধানের মৌলিক অধিকার রচনার জন্য একটি পৃথক কমিটি হয়েছে। তার নাম ফান্ডামেন্টাল রাইটস কমিটি। ওই কমিটির বৈঠক চলাকালীন অমৃতা কাউরের সঙ্গে আলাদাভাবে আম্বেদকরের বৈঠক হয়। অমৃতা কাউর ওই আলোচনার প্রেক্ষিতে মহাত্মা গান্ধীকে চিঠি লিখে জানালেন, ‘ডঃ আম্বেদকর চাইছেন তাঁর সামান্য দাবি যেন মানা হয়। সেটি হল দলিত সমাজের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী।’
কিন্তু মহাত্মা গান্ধী অমৃতা কাউরকে চিঠি লিখে বললেন, ‘আমার মনে হয় না ওটা কোনও সলিউশন। সেরা পথ হল সাধারণ নির্বাচকমণ্ডলী এবং দলিতদের জন্য সংরক্ষণ। যেটা আমাদের ঘোষিত নীতি। শিক্ষার আলো ছাড়া এভাবে নিছক পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী করে দলিতদের উত্থান হবে না।’ কয়েকমাসের মধ্যেই নেহরু রাজাগোপালাচারীকে জানালেন, ‘আম্বেদকর রাজি হয়েছেন সরকারে যোগ দিতে।’ সেটা জুলাই মাস। একমাস পর স্বাধীনতা আসছে। ডঃ আম্বেদকর সেই নতুন ভারতের প্রথম সরকারের শুধু যে আইনমন্ত্রী হলেন তাই নয়, সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যানও মনোনীত হলেন। দেশভাগের ফলে তাঁর ইস্ট বেঙ্গলের আসনটি হাতছাড়া হল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের উদ্যোগে কংগ্রেসের এক সদস্য নিজের আসন ছেড়ে দিলেন। বম্বে থেকে নির্বাচিত হলেন ডঃ আম্বেদকর!
১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ভারতের সংবিধান রচনার কাজটি হয়েছিল প্রবল সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার আবহে। এই বহুধা বিস্তৃত ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, উপভাষার দেশে একটিই সংবিধান রচনা যে কতটা কঠিন, তা সহজেই অনুমেয়। একদিকে দেশ জ্বলছে, দাঙ্গা, দেশভাগ, শরণার্থীর স্রোত। অন্যদিকে এই মানুষগুলি ভারতকে একটি আধুনিক উদার সর্বধর্মসমন্বয় আর উন্নত দেশে পরিণত করার কাজে ব্যাপৃত। ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর সংবিধান সভায় অনুমোদিত তথা পাশ হয়েছিল ভারতের সংবিধান। স্থির হয়েছিল ঠিক ২ মাস পর অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে সেই নয়া সংবিধান অনুযায়ী ভারত হবে নয়া সাধারণতন্ত্র।
সুতরাং, এই ২০১৯ সাল ভারতের সংবিধান অনুমোদন তথা গ্রহণের ৭০তম বর্ষ। অথচ আজ আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক আবহ তথা নিত্যদিনের চর্চা, মনোভাব ও আচরণ বহু ক্ষেত্রে কিন্তু সংবিধানের লক্ষ্য, আদর্শ ও স্পিরিটের সম্পূর্ণ বিপরীত। ওরকম এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আবহে যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা নিবিষ্টমনে এরকম একটি নিপুণ সংবিধান রচনা করে গেলেন, তাকে নস্যাৎ করে সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করে আমরা কি সেই ঐতিহ্য আজ অনুসরণ করছি? তাঁদের ওই নিষ্ঠা, পরিশ্রমকে সম্মান দিচ্ছি? ধর্ম নিয়ে হানাহানি, জাতপাত নিয়ে রাজনীতি, ভাষার আগ্রাসন, সংস্কৃতির সাম্রাজ্যবাদ, জাতিগত বিভাজনই কি আজকের সমাজের প্রবল ধারাভাষ্য নয়?
সংবিধানের খসড়া রচনা কমিটি সংবিধান-সভা গঠন করেছিল ১৯৪৭ সালের ২৯ আগস্ট। সেই কমিটির প্রথম বৈঠক হয়েছিল ৩০ আগস্ট। ৩০ আগস্ট থেকে ১৪১ দিন ধরে মিলিত হয়েছিল সংবিধানের খসড়া রচনা কমিটি। প্রথমে হল খসড়া সংবিধানের একটি ভিত্তি। তারপর সেই ভিত্তিকেই সম্প্রসারিত করে খসড়া রচনা কমিটি নিয়োজিত হয়েছিল ২৪৩টি ধারা এবং ১৩টি তফসিলকে সমন্বিত একটি রূপ দিতে। খসড়া কমিটির পেশ করা রিপোর্টে প্রথমে ছিল ৩১৫টি ধারা এবং ৮টি তফসিল। প্রাথমিক বিবেচনার পর খসড়া সংবিধানে ধারার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ৩৮৬। আর খসড়া সংবিধান যখন চূড়ান্ত রূপ ধারণ, তখন সেখানে ৩৯৫টি ধারা এবং ৮টি তফসিল। খসড়া সংবিধানের উপর প্রায় ৭৬৩৫টি সংশোধনী জমা পড়ে। আর তার মধ্যে সভায় চূড়ান্তভাবে পেশ হয়েছিল মোট ২৪৭৩টি সংশোধনী। সংবিধান সভা বসেছিল ১৬৬ দিন ধরে। এসব কথা বলার অর্থ কী? অর্থ হল, এটা উপলব্ধি করা যে, কতটা পরিশ্রম করেছিলেন ওই মানুষগুলি। বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্ব করার পৃথক কারণ আছে। খসড়া কমিটির সর্বপ্রথম খসড়া রচয়িতার নাম এস এন মুখার্জি। স্বয়ং ডঃ আম্বেদকর তাঁর সর্বশেষ বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘মিস্টার মুখার্জির বৈদগ্ধ ছাড়া আমরা কাজ শুরু করতেই পারতাম না।’
১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বর সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করে সংবিধান সভায় পেশ করার পর তাঁর শেষ বক্তৃতায় ডঃ আম্বেদকর একঝাঁক প্রশ্ন করেছিলেন ভবিষ্যতের উদ্দেশে। আমাদের উদ্দেশে। পরবর্তীকালের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের উদ্দেশে। সেগুলি সাধারণ প্রশ্ন ছিল না। ছিল এক চরম সতর্কবার্তা! আমরা ঠিক ৭০ বছর পর ডঃ আম্বেদকরের উত্থাপিত কয়েকটি প্রশ্ন আজ স্মরণ করতে পারি। সেটি আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারত হবে এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অর্থাৎ সেই দিন থেকে ভারত হবে এমন এক রাষ্ট্র, যা একান্তই জণগণের, জণগণের দ্বারা এবং জণগণেরই জন্য....আমাদের গণতান্ত্রিক সংবিধানের ভাগ্যে ভবিষ্যতে কী লেখা আছে? ভারত কি এটা রক্ষা করতে সক্ষম হবে?.......যদি রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের নীতি আদর্শকে, দেশের স্বার্থেরও উপরে স্থান দেয়, তা হলে আমাদের স্বাধীনতা দ্বিতীয়বারের জন্য আবার সঙ্কটে পড়বে এবং হয়তো চিরকালের মতো সেই স্বাধীনতা লুপ্ত হবে। আমাদের সকলকেই এই প্রবণতাকে প্রতিরোধ করে রক্ষা করতে হবে দেশকে। আমাদের স্বাধীনতাকে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সুরক্ষিত করার শপথ নিতে হবে আমাদের।’
আমরা কি পারব সংবিধান, গণতন্ত্র, স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে? ডঃ আম্বেদকরের তোলা সেই অমোঘ প্রশ্নটি আমাদের এবার করতে হবে নিজেদের। এখন।
সহযোগিতায় উজ্জ্বল দাস