উচ্চশিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় দিনটি শুভ। কর্মস্থলে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। আর্থিক দিক অপেক্ষাকৃত শুভ। ... বিশদ
বিজ্ঞানের পরিভাষায় উপরের গল্পটি কন্ট্রোলড ট্রায়ালের একটি উদাহরণ। যে কোনও ট্রায়ালের মতো এতে একটি ট্রিটমেন্ট গ্রুপ (যারা দুধ পেল) এবং একটি কন্ট্রোল গ্রুপ (যারা দুধ পেল না) ছিল। কিন্তু সমস্যা হল ট্রায়ালটি র্যান্ডমাইসড ছিল না। অর্থাৎ, কোন বাচ্চা কন্ট্রোল গ্রুপে এবং কোন বাচ্চা ট্রিটমেন্টে যাবে, তা লটারি বা অন্য কোনও র্যান্ডমাইসেশন পদ্ধতির মাধ্যমে ঠিক না করে, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার সাপেক্ষে ঠিক করা হয়েছিল। সহজভাবে বললে গরিবদের দুধ দেওয়া হয়েছে এবং বড়লোকদের দেওয়া হয়নি। তার ফলে এই পরীক্ষা থেকে যে ফলাফল পাওয়া গেল, তা বিভ্রান্তিকর।
২০১৯-এ অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্থার ডাফলো এবং মাইকেল ক্রেমারের মূল অবদান হল বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের মূল্যায়নে এই র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়ালের (RCT) ব্যবহার। কেন এই কাজটি গুরুত্বপূর্ণ? কারণ এর মাধ্যমে জানা যেতে পারে কোন সামাজিক প্রকল্পটি তার ঈপ্সিত ফল লাভ করবে আর কোনটি করবে না। কিন্তু এই র্যান্ডমাইজেশন পদ্ধতি এক ধরনের নৈতিকতার সমস্যা তৈরি করে, তাই কোনও রাজনৈতিক দল তথা সরকার চট করে এটা রূপায়ণ করতে চায় না। দুধের উদাহরণটি ভেবে দেখুন। আমাদের সাধারণ নৈতিকতা বলবে গরিব বাচ্চাদেরই দুধ পাওয়া উচিত। কিন্তু বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষার স্বার্থে করা র্যান্ডমাইজেশন এই নৈতিকতার বিপ্রতীপ অবস্থান নেয়। কারণ র্যান্ডম ট্রায়ালে, কে দুধ পাবে তা ঠিক হবে লটারি করে। তাই দুধ পাওয়া এবং না পাওয়া—দু’টি দলেই গরিব, বড়লোক সব রকম ছেলে থাকবে। এককথায় প্রকল্পের মূল্যায়নে র্যান্ডমাইজেশন ব্যবহারের অর্থ হল কোনও প্রকল্পের অন্তত প্রাথমিক পর্যায়ের সুবিধা মানুষ প্রয়োজনের ভিত্তিতে না পেয়ে লটারির ভিত্তিতে পাবে।
র্যান্ডমাইজেশনের গুরুত্ব বোঝার জন্য এবছরের অন্যতম নোবেল প্রাপক ক্রেমারের একটি বিখ্যাত গবেষণার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি ও তাঁর সহ গবেষক মিগেল RCT পদ্ধতি অনুসরণ করে স্কুলের বাচ্চাদের মধ্যে কৃমির ওষুধ বিতরণ করেন। তাঁরা দেখতে চাইছিলেন কৃমির ওষুধ খাওয়ার ফলে বাচ্চাদের স্কুলে আসা এবং পড়াশোনার মান কীভাবে বাড়ে। কিন্তু স্কুলে কিছু বাচ্চা এমনিই পাওয়া যায় যাদের বাবা-মা তাদের কৃমির ওষুধ খাইয়েছে আর কিছু বাবা-মা তা করেননি। এক্ষেত্রে RCT পদ্ধতিতে ওষুধ বিতরণ না করে শুধু বাচ্চাদের মধ্যে ক্ষেত্রসমীক্ষা করলে কী ক্ষতি হতো? সমস্যা হল, যে বাবা-মায়েরা ওষুধ খাইয়েছেন, তাঁরা সচেতন বাবা-মা। যে বাবা-মায়েরা ওষুধ খাওয়াননি, তাদের থেকে তাঁরা চরিত্রগতভাবে আলাদা। সচেতন বাবা-মায়ের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় এই জন্যও ভালো করতে পারে, কারণ তাঁরা ছেলেমেয়েদের জন্য সময় দেন, তাদের পড়াশুনোয় উৎসাহ দেন, তাদের জন্য অন্য সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করেন ইত্যাদি। সুতরাং, এই ছেলেমেয়েরা পড়াশুনোয় ভালো করলেও এটা বলা মুশকিল যে তারা কৃমির ওষুধের কারণে করছে নাকি তাদের বাবা-মায়ের সাধারণ প্রভাবে করছে। এখানেই সাধারণ ক্ষেত্রসমীক্ষার থেকে RCT অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ফলাফল দেয়।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, গবেষণা পদ্ধতি হিসেবে RCT’র ব্যবহার কি সম্পূর্ণ মৌলিক কিছু? না। সেটা একেবারেই নয়। বিজ্ঞানের অনেক শাখায়, বিশেষত ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষায় RCT বহুদিন ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। সেক্ষেত্রেও কিন্তু রাজনৈতিক চাপ এসেছে র্যান্ডমাইজেশনের বিরুদ্ধে। যখন ওষুধের নিরীক্ষা চলে তখন কন্ট্রোল (যারা ওষুধ পাবে না) এবং ট্রিটমেন্ট (যারা ওষুধ পাবে) গ্রুপের মধ্যে রোগের বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা রোগী থাকে। আমাদের মানবিক বোধ দাবি করে যে রোগী মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে, যার আর কোনও চিকিৎসার আশা নেই, পরীক্ষামূলক ওষুধ পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হোক। কিন্তু মানবিকতার এই দাবি মেটাতে গেলে র্যান্ডমাইজেশনের নীতি থেকে বিচ্যুতি ঘটবে, নিরীক্ষার ফলাফল আর ওষুধটির কার্যকারিতা বোঝার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে থাকা এইডস রোগীদের আগে পরীক্ষামূলক ওষুধ দেওয়ার দাবিকে কেন্দ্র করে আশির দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে।
এক কথায় এ বছরের নোবেলজয়ীদের অবদান হল, সামাজিক প্রকল্পের কার্যকারিতা বোঝার ক্ষেত্রে RCT’র ব্যবহারকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। এই ধরনের নিরীক্ষার বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব যতই থাক না কেন, এর বিরুদ্ধে সবসময়েই এক ধরনের নৈতিক (এবং রাজনৈতিক) চাপ কাজ করে। বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাফলো, ক্রেমারের সাফল্য হল, বিভিন্ন দেশে এই রাজনৈতিক চাপকে অতিক্রম করে এই নিরীক্ষাগুলি সম্পন্ন করা যা থেকে বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের কার্যকারিতা আমরা নতুনভাবে বুঝতে পেরেছি। সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, সমাজবিজ্ঞানে এই পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়ে একটি বড় বিতর্কও রয়েছে যার পক্ষে বা বিপক্ষে বহু প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ বক্তব্য রেখেছেন। এই পুরস্কার কিন্তু সেই প্রয়োজনীয় বিতর্ককে আরও একটু উস্কে দিল।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়